আত্মহত্যাই শ্রেষ্ঠ

Updated By: May 12, 2016, 08:02 PM IST
আত্মহত্যাই শ্রেষ্ঠ

"Suicide Is Painless"

That suicide is painless
It brings on many changes
And I can take or leave it if I please

The game of life is hard to play
I'm gonna lose it anyway
The losing card I'll someday lay
So this is all I have to say

-আ সং অব MASH মার্চ। ১৯৬৯ সালে প্রথম রেকর্ড। প্রথম আত্মপ্রকাশ ১৯৭০ সালে। আমি তখনও জন্মায়নি। গানটা গোটা বিশ্ব জেনে যাওয়ার ২২ বছর পর পৃথিবীটা আমার বাসভূমি হয়েছিল, আর তার আগের ১০ মাস ১০ দিন মায়ের গর্ভই ছিল আমার নিরাপদ আশ্রয়। আজ হঠাৎ এই গানের কথা বলছি 'অথৈ' এর জন্য। দলিত লোধাদের প্রতিনিধি অথৈ। 'অথৈ' নটধা'র একটি সৃষ্টি।

বিশ্বাস আর বন্ধু সবার জীবনেই এই শব্দ যুগল একে অপরের পরিপূরক। আর প্রত্যেকের জীবনেই কম বেশি বিশ্বাসভঙ্গের দায়ভার নিয়ে এসেছে বন্ধুরাই। মিত্র আর শত্রু দুটো শব্দই যখন একজনের জন্য বরাদ্দ থাকে সে বোধহয় বন্ধু। বিষয়টা গণিতের সরল সূত্রের মত, 'শত্রু হতে চাইলে আগে বন্ধু হও'। ইতিহাসে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও তো ভারতের বন্ধু ছিল, বিশ্বাসের যোগ্য নজির স্থাপন করে গিয়েছেন মিরজাফরও। সব ক্ষেত্রেই যে এমনটা হয়, তা একেবারেই নয়। ব্যতিক্রম থাকেই। তবে সৃষ্টি সেটাই যেটা জীবন্ত, আর সেটাই জীবন্ত যেটা বাস্তব। হ্যাঁ। সমাজের ময়না তদন্তে 'অথৈ' তুলে ধরেছে সেই বাস্তব, যেখানে কুলীনের কুলীনতায় 'তৃণমূল' হয়েই থেকেছে দলিতরা। দলিত কেবল কোনও গোষ্ঠী নয়, আসলে তা সমাজের নিপীড়িত অংশের একটা প্রস্তর খণ্ড। তবে এই তৃণের মধ্যে ব্যতিক্রমীরাই হয় মহীরুহ। আর যখন এক তৃণ মহীরুহ হয়ে ওঠে তখন জীব জগতের নিয়মেই জন্ম হয় ইর্ষার। নাটকেও তেমনটা হয়েছে, যেমনটা হয়ে চলেছে জীবনে।  

দিদিমার ভেপসে যাওয়া শরীর, মায়ের গর্তে ঢোকা চোখ 'অথৈ' ভোলে না। অথৈর মনে আছে প্রতিটি দিন, প্রতিটি গভীর রাত, মনে আছে না খেতে পাওয়ার জীবন্ত উপন্যাস। জীবনের প্রত্যেক পাতায় 'শক্তি' লেখা। নদী নদী নদী/সোজা যেতিস যদি/সঙ্গে যেতুম তোর/আমি জীবনভোর, না নদী সোজা যায় না, পাহাড় থেকে আছাড় খেতে খেতেই তো ওর জীবন শুরু, আর তাই বলেই তো নদীর যৌবন হয় খরস্রোতা। অথৈও খরস্রোতা এক নদী। সমাজের পাথরচাঁই ভেঙে ভেঙে বড় হয়ে ওঠা। নাস্তিক, তবে জেঠামশাই'ই ওর দেবতা। অথৈ বিপ্লবের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ছিল ছোট বেলা থেকেই। দারিদ্রতা, লড়াই ওর রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ওর আরও এক বন্ধু ছিল 'দ্য ডার্ক নাইটের জোকার'। জেঠামশাইয়ের ছেলে অনির্বাণ ভট্টাচার্য ওরফে অনগ্র। সমস্ত নাটক জুড়ে 'অনগ্র' না থাকলে হয়ত অথৈ নাটকের জীবন অগ্রসরই হত না। সাদামাটা জীবনে বিশ্বাস নেই, উতরাই চড়াই ছাড়া জীবন, আর ভিক্টোরিয়ার বাদাম ভাজা-কোনওটাই পছন্দ নয় অথৈয়ের। আর এই 'হতচ্ছাড়া' গতানুগতিক প্রেমিক নয় এমন মানুষগুলোর প্রেমে যারা পড়ে তাঁরা খানিকটা 'ঘরের খেয়ে পরের বনে মোষ তাড়ানোর' মতই। অথৈ মিলনে বিশ্বাসী। তাই ওর মনের মিলনও হল। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রী তুর্না দাস ওরফে দিয়া বা মুন। তিন নামের একজন মানুষ। অথৈ প্রেমে হাবুডুবু দিয়ার। বাগবাজার ঘাটের কত সন্ধ্যা, কলেজ স্ট্রীটে কতটা পথ একসঙ্গে চলা, কফি হাউসের আড্ডা তারপর 'লিভ ইন', তথাকথিত সভ্য সমাজে যা 'নষ্টামি'। তারপর লেখাপড়ি করে বিয়ে, মানে রেজিস্ট্রি ম্যারেজ। এখান থেকেই ছন্দ পতন। হানিমুন পিরিয়ডটা কেটে একেবারে বিষপান, তাও জেনে শুনে।

বিশ্বাসের কথা বলে যে চার হাত এক হয়েছিল, সেই চার হাত আলাদা হতেও বেশি সময় নেয়নি, কারণটা 'অবিশ্বাস'। আর এই হাত অদল বদল করার পিছনেও বন্ধু, 'দ্য ডার্ক নাইটের জোকার'। নাটকের শুরু থেকে কখনও তেরে ব্যাট চালানো, কখনও একটু ধীরে আর কখনও ছয়ের পর ছয়, নেগেটিভ অনগ্র নাট্যমঞ্চে যথেষ্ট পজিটিভ। ভালো মানুষের মুখোশের ভিতরে আদ্যোপান্ত ইর্ষার একটা হৃৎপিণ্ড নিয়ে যে মানুষটা রাজ করল, সে 'হ্যান্ডসাম হাঙ্ক' অনগ্র, ম্যাচ একেবারে পকেটে ছিল যার। নাটকের নিয়মে চরিত্রের আনা গোনা ছিল বটে, তবে চরিত্রের অদল বদল আর 'দ্যা ম্যান টু ওয়াচ' একজনই 'দ্য ডার্ক নাইটের জোকার'। রহস্যের প্রতিটা গন্ধ যার নাকে স্নিফার ডগের থেকেও বেশি আগে পৌঁছে যায়, যে গোটা ম্যাচটাকে পকেটে পুড়েও শেষবেলায় এসে নায়ককে বলে 'কাম, ফাইট উইথ মি', সে হল 'অনলি অনগ্র'। লাল আলো আর অনগ্রর দাঁত খিঁচে ওর ঐ ভয়ঙ্কর রূপটা! হাস্কি টোন, খুনের ছক, আর তার সঙ্গে 'বদ হাওয়া' লাগিয়ে দেওয়া মানুষটার পরিচালনায় হত্যা হল বিপ্লবীর। আদর্শের মৃত্যু। হত্যা হল বন্ধুত্বের, বিশ্বাসের, দলিত শেষে হারলেন জীবনের বাজি। অথৈর হাত দিয়ে খুন করালেন ভালোবাসার দিয়াকে।

প্রেমটা প্রথম দিন যেমন ছিল, শেষের দিনও তাই। দিয়ার শরীরের মিষ্টি গন্ধ অথৈকে ছুঁয়েছে। নাক বন্ধ না মন বন্ধের দ্বন্দ্ব মিটল শ্বাসরোধে। পাতাঝড়া বসন্তে বটতলার গাছ শুকিয়ে কাঠ। ভিংসুরা গ্রামেই সলীল সমাধি হল অথৈয়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ার স্বপ্ন। সমাজের বদলের স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল। মৃত্যু, মৃত্যু খেলায় জয় পরাজয়ের অঙ্ক কষতে কষতে জীবন হারিয়ে যায়, তাঁদের কাছে 'আত্মহত্যাই শ্রেষ্ঠ' আর 'আত্মহত্যা বেদনাদায়ক নয়' ("Suicide Is Painless")। নিজের প্রেয়সীকে অন্য পুরুষের বিছানায় ভাবনাতেই হৃদয়ে ভূমিকম্প, মদ মাতালের সুনামিতে সমাজ যায় রসাতলে, জীবনে যা হয়, তাই তো হল গোটা নাট্যমঞ্চে। শেষটায় থেকে গেল যা, প্রেমিকার প্রশ্ন প্রেমিককে ,'কেন করলে এ রকম', বন্ধুর প্রশ্ন বন্ধুকে, 'কেন করলে এ রকম'?

নাটক- অথৈ
নির্দেশনা- অর্ণ মুখোপাধ্যায়

আর শেষে অথৈয়ের সংলাপের মত, আমি 'অকৃতজ্ঞ' নই, ধন্যবাদ মেঘমা।
উইলিয়াম শেক্সপিয়রের ওথেলো'র 'অনুসরণে' অথৈ।

.