ইস্টকোষ্টের ডাইরি

সুমনা চক্রবর্তী

১লা জুলাই, ২০১৭

জন এফ  কেনেডি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে থেকে বেরিয়ে হঠাৎ করেই গরমের হাওয়া লাগলো চোখে মুখে। বুঝতেই পারলাম নিউজার্সির আবহাওয়া বেশ গরম। এখন এখানে সকাল সাতটা, বেশ ঘেমোঘেমো। আবহাওয়া দপ্তর বলছে দু’চারদিন গরমটা থাকবে। তবে মাঝে মাঝে বৃষ্টির ও পূর্বাভাস আছে।  অবস্থাটা খানিকটা দেশের মতো।  অতিরিক্ত গরমের মাঝে দু’চার পশলা বৃষ্টি।  আমাদের আত্মীয় সকাল সকাল প্রস্তুত আমাদের বাড়ী নিয়ে যাবে বলে। ওদের বাড়ী পৌঁছেই প্ল্যান করে নিলাম যে কোথায় কোথায় ঘুরতে যাবো। হাতে ছুটি মাত্র চারদিন এরমধ্যেই ভাললাগার জায়গা গুলো দেখে নিতে হবে। সবাই মিলে প্ল্যান করে নিলাম আজ জ্যাকসন হাইটস এ ঘুরতে যাব। আর তার সাথে দেখে নেওয়া হবে নিউজার্সি শহর টা। বহু পুরানো শহর, এবং এই জ্যাকসন হাইটস এই বসবাস বহু বাঙালীর। রাস্তার দুধারে ইটের বাড়ী। বাড়ীগুলো দোতলা, তিনতলা বা বহুতল। প্রত্যেকটা বাড়ীর পাস দিয়ে সিঁড়ি। আমেরিকার সব জায়গায় এই ধরনের বাড়ী দেখা যায় না। গাড়ী পার্কিং এর অবস্থাও খুব খারাপ। তার কারন এখানে ঘন বসতি আর বাঙালিরা রাস্তার দুধারে যেখানে সেখানে গাড়ী পার্ক করে বাজার দোকান শুরু করে দেয়। বেশ অনেক দূরে গাড়ী পার্ক করে যেখানে বাংলা বাজার এসে পৌঁছলাম। বেশ বাংলায় কথা চলছে, দেখে বেশ ভালো লাগলো। মূলত ভাষাটা যখন আমার ভাষা তখন সেখানে ভাললাগার মাত্রাটা দ্বিগুন হয়ে যায়। এখানে বাংলাদেশ থেকে আসা বাঙালীরাই তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। আমেরিকার অর্থনীতি চাঙ্গা করতে এদের অবদান অনেকটাই। কি নেই এখানে! বড় বড় রেস্তরাঁ, বাংলাদেশের বিখ্যাত ও জনপ্রিয় শাড়ীর দোকান , মুদির দোকান , রাস্তার দুধারে উপচে পড়া সবজি ও ফলের পসরা নিয়ে দোকানীরা। ডিনারটা এখানেই সেরে চলে এলাম এক্সচেঞ্জ পয়েন্টে। রাত তখন গাঢ় হচ্ছে।  এখানে আসতেই চোখ ধাঁধিয়ে  গেলো। ঝাঁ চকচকে বহুতল অফিস হাডসন রিভারের ধারে। রাতের বিস্তীর্ন ঝিকিমিকি আলো রিভারের জলে পরে হাজারো প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়েছে। অপরপ্রান্তে পৃথিবী বিখ্যাত ওয়ার্ল্ডট্রেড সেন্টারের চূড়া দেখা যাচ্ছে তবে খানিকটা অস্পষ্ট, পুঞ্জীভূত বাষ্প শিখরটাকে হালকা করে ঢেকে রেখেছে। বহু মানুষ রিভারের ধারে তাদের একান্ত সময় কাটাচ্ছে। ২০০৯ জানুয়ারীর  ১৫ তারিখ ১৫৫ জন যাত্রী নিয়ে একটি প্লেনের অবতরণ ঘটেছিল এই নদীতেই। তখন তা CNN এর বিখ্যাত খবর হয়েছিল তাই হাডসন নদীর এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আমারও মনে নানা প্রশ্নের ভীড় শুরু হয়ে গেল। এখন এখানে বাতাস বড়ই মধুর। সকালের সেই গরম নেই।  ক্লান্ত শরীর বলছে আরও খানিকক্ষণ শুধু জলের দিকে তাকিয়ে বসে থাকো।

জ্যাকসন হাইটস

বাংলা বাজার

২রা জুলাই,

আজ সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে সূর্যের চোখ রাঙানি দেখে বোঝা যাচ্ছে আজকের দিনটা কোনমতেই স্বস্তিদায়ক হবে না। হালকা জামাকাপড় পরে হালকা প্রাতঃরাশ সেরে বেরিয়ে পড়লাম ওয়ার্ল্ডট্রেড সেন্টার, ওয়াল স্ট্রীট ও মাদাম তুসো দেখবো বলে। ওয়ার্ল্ডট্রেড সেন্টারে যেতে গেলে পার্কিং লটে গাড়ী পার্ক করে মেট্রো ধরে যেতে হয়। এসে পৌঁছলাম ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে।  একশোতলা  বিল্ডিং, নিচ থেকে দেখলে মনে হয় আকাশ ফুঁড়ে উপরে উঠে গিয়েছে। আমার মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছে বিল্ডিংটা দুলছে, যে কোন সময় পরে যেতে পারে। তবে নিউইয়র্কে  ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এরকম বহু উঁচু উঁচু অফিস। এগুলো মূলত: কর্মস্থল। সেন্টারের পাশেই পথচারীদের বসার জন্য আছে বাঁধানো বসবার জায়গা।  যাদের উঁচুতে উঠতে গিয়ে শারীরিক সমস্যা দেখা দেয় তারা এখানে বসেই ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের শিখরকে সহজে ছোঁয়া যায় না।  ছুঁতে গেলে লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটতে হয় তারপর লিফট হুশ করে সাতচল্লিশ সেকেন্ডের মধ্যে একশো তলায় পৌঁছে দেবে। যেখান থেকে গোটা নিউইয়র্ক শহরটাকে দেখে নেওয়া যায়। শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে আমিও পৌঁছে গেলাম একশো তলায়। চোখের ও মনের জানলা কোন বাধা ছাড়াই খুলে গেল। শিখরে চলছে রমরমিয়ে ব্যবসা। অবিস্মরণীয় ভিউ, সমগ্র নিউইয়র্ক  শহর, জলরাশি, মানুষজন , সাজানো আলো কোন কিছুই চোখকে এড়িয়ে গেলো না। এটা নতুন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার।  আমেরিকানদের আবেগকে সম্মান জানাতেই আবার নতুন করে গড়ে তোলা। দেখা সম্পূর্ণ করে ফিরে  এলাম নীচে।  এগিয়ে গেলাম একদম পাশেই স্মৃতি থেকে না মুছে যাওয়া পুরোনো ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার দেখতে। না দেখলে বিশ্বাস করা অসম্ভব যে কত বড় জায়গার উপর এটি প্রতিষ্ঠিত ছিল। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের এগারো তারিখ ওসামা বিন লাদেনের পরামর্শে এক ধাক্কায় এটি তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়েছিল। এটি এখন সমাধি ক্ষেত্র। চারিদিক বাঁধিয়ে মাঝখানে মসৃন ফোয়ারার সৃষ্টি করে রেখেছে। বাঁধানো জায়গায় স্মৃতি হিসাবে মৃতদের নাম গাঁথা আছে। দেশ বিদেশের হাজারে হাজারে মানুষ জায়গাটির পরশ পাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছে।  আমিও দাঁড়িয়ে ছিলাম ঠিকই কিন্তু বিস্ময় কিছুতেই কাটাতে পারছিলাম না। দেখাপর্ব শেষ এখানে, এবার যেতে হবে ওয়ালস্ট্রীট।  পনের মিনিটের হাঁটাপথ। এখানে রাস্তায় প্রচন্ড হাঁটতে হয় গাড়ী পার্কিং এর সমস্যা। নির্দিষ্ট জায়গায় গাড়ী পার্ক করে পদযুগল কে সম্বল করে এগিয়ে চলতে হয়। পৌঁছলাম ওয়ালস্ট্রীটএ, আমেরিকার ব্যস্ততম জায়গা।  গোটা বিশ্ব সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত তাকিয়ে থাকে যেই শেয়ার মার্কেটের ওঠা পড়ার দিকে। রাখা আছে বুল অর্থাৎ ষাঁড়।  ষাঁড় যেমন রেগে গেলে এক গুঁতোয় যে কোন জিনিষ উপরে তুলতে পারে  সেই ধারণা থেকেই  বুল।  বিখ্যাত বুলের সঙ্গে ছবি তোলার জন্য দেশী ও  বিদেশী প্রচুর লোকের লাইন। খানিকটা ধাক্কাধাক্কি করে ছবি তোলার প্রতিযোগিতা চলছে। বিকেল ঘনিয়ে সন্ধ্যা প্রায় হবহব।  গুটিঘটি পায়ে এগোতে থাকলাম টাইম স্কোয়ারের দিকে। টাইম স্কোয়ার কে ঘিরে আছে বাণিজ্য, ট্যুরিজম ও এন্টারটেনমেন্ট। সন্ধ্যের টাইম স্কয়ারে আছে বারোমাস তিনশ পঁয়ষট্টি দিন উৎসবের মেজাজ। উঁচু উঁচু অফিস গুলো আলোয় ঝলমল।  মিউজিক, ম্যাজিক ব্রডওয়ে শো কিছুই বাকী নেই। রাস্তার ধারে দোকান পাট গুলোতে চলছে প্রবল পরিমানে কেনাবেচা। এই টাইম স্কয়ারের মূল আকর্ষণ হল নববর্ষের প্রাক্কালে ওপর থেকে বল পড়া। প্রতিবছর ৩১শে  ডিসেম্বর রাত বারোটার সময় বল পড়ে এবং নতুন বছর সেলিব্রেট করা হয়। ১৯০৭ সালের ৩১শে ডিসেম্বর প্রথম এই প্রথা শুরু হয়েছিল, সেই প্রথা এখনো চলে আসছে। বল পড়া শুরু হয় রাত ১২টার ঠিক এক মিনিট আগে এবং ঠিক যখন ১২টা বাজে বল তখন মাটি স্পর্শ করে। সেই মুহূর্তে সকলে হ্যাপি নিউ ইয়ার বলে নতুন বছরকে স্বাগত জানায়।   আছে মাদাম তুসোর মোমের মূর্তি।  যা এক কথায় অনবদ্য।  বিভিন্ন পেশায় বিখ্যাত মানুষদের মোমের মূর্তি শিল্পীদের নরম হাতের ছোঁয়ায় একেবারে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। না জানলে  আসল কি নকল বোঝা মুশকিল। চোখ ধাঁধানো টাইম স্কোয়ারের আলোয় কখন যে সন্ধ্যা পার হয়ে রাত ঘনিয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি।  রাত বারোটার মধ্যে পার্কিং লট থেকে গাড়ী নিতে হবে আবার পথ চলা শুরু।  সামনে সমুদ্দুর যেতে হবে বহুদূর। টাইম স্কয়ারকে পিছনে ফেলে চলে আসতে বড্ড মায়া  লাগছিল, আবেগ টা ছিল অনেকটা নবমী নিশির মতো।

৩রা জুলাই,

আজ আমাদের গন্তব্য ওয়াশিংটন ডিসি।  নিউজার্সি থেকে ওয়াশিংটনা ডিসির দূরত্ব গাড়ীতে ঘন্টা সাড়ে তিন।  তাই সকাল সকাল না বেরোলে পৌঁছতে অনেক দেরী হয়ে যাবে। কাল রাতে টাইমস্কয়ার থেকে ফিরতে অনেক দেরী হয়ে যাওয়ায় ঘুমের সময়টা একটু কম হয়ে গেছে। নতুন কিছু দেখা বা পাওয়ার মধ্যে উত্তেজনা এতটাই থাকে তখন আর ছোটখাটো জিনিস নিয়ে ভাববার অবকাশ থাকে না। সকাল সকাল অল্প কিছু খবার ও জল নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম ওয়াশিংটন ডিসির উদ্দেশে। গাড়ী পার্ক করে এসে পৌঁছলাম আমেরিকার প্রেসিডেন্টের বাসস্থান ও কর্মস্থল হোয়াইট হাউসের সামনে। খানিকটা বলা যায় স্বপ্নটা সত্যি হল। ছোটো থেকে বড় হওয়া এই শুনে যে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউসে থাকেন, সেটা কিরকম একবার দেখবার ইচ্ছে ছিল। হোয়াইট হাউসের সামনে সবুজ লন, তার চারিদিকে লাহার তৈরী বেড়া। চোখে কালো চশমা পরে আমেরিকার পুলিশ প্রশাসন সদা জাগ্রত। বেড়ার ঠিক বাইরে চলছে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন। জানানো যে ওদের দাবী মেনে নিতে হবে। সামনে গিয়ে কটা  ছবি তুলে নিলাম।  এ জিনিস যে দেখব তা স্বপ্নেও ভাবিনি। হোয়াইট হাউস থেকে হাঁটা পথেই আছে ইউনাইটেড স্টেটস ক্যাপিটল। এটাকে ক্যাপিটাল বিল্ডিং বলা হয়। ১৭৯৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর এটির কাজ শুরু হয়েছিল ১৮০০ সালে এই বিল্ডিং এর কাজ সমাপ্ত হয়। পরবর্তীকালে কিছু জিনিস যুক্ত করা হয় যেমন ডোম, হাউস অফ রিপ্রেজেনটেটিভ, সেনেট। পাশেই রয়েছে আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোটেল ও বলরুম। এই হোটেলে সাধারণ জনগণ আগের থেকে বুক করে থাকতে পারেন। সকাল থেকে ভ্রমণ শুরু করেও দুপুর গড়িয়ে গেল মনে হচ্ছে কিছুই দেখে উঠতে পারিনি। এখানে আছে প্রচুর মিউজিয়াম।  ইচ্ছে ছিল পৃথিবী বিখ্যাত স্মিথসোনিয়ান মিয়াজিয়ামটা দেখে যাওয়ার। এসে লাইনে দাঁড়ালাম। এখানকার বিশেষত্ব হল প্রবেশ মূল্যহীন, শুধু প্রবেশ পথের সম্মুখে গার্ডরা রয়েছে যারা আপাদমস্তক ও হাতের ব্যাগ পরীক্ষা করেই ভেতরে ঢুকতে দেয়। পরীক্ষায় পাশ করে ঢুকে পড়লাম।  এটি একটি আর্কিওলজিক্যাল ইনস্টিটিউট। বহু ছাত্রছাত্রী এখানে গবেষণা করেন।  কোটি কোটি বছরের বিভিন্ন মূল্যবান জিনিস সংরক্ষন করা আছে এখানে। তা খনি হোক বা সমুদ্রের অতল গহ্বর থেকে তুলে আনা সম্পদই হোক। চোখ ধাঁধানো বড় মাপের হীরে, মনকাড়া বিভিন্ন নামীদামী রঙিন পাথর যা সবই প্রাকৃতিক, সংরক্ষিত আছে এখানে। মিউজিয়াম দেখে আবার হাঁটা শুরু। চলতি পথেই আছে নেভি মেরিয়াল, ন্যাশনাল থিয়েটার, ওয়াশিংটন মনুমেন্ট, লিংকন মেমোরিয়াল, জেফারসন মেমোরিয়াল, ভিয়েতনাম ও কোরিয়ান মেমোরিয়াল।  আস্থা বা ভরসার জায়গা সুপ্রিম কোর্টটি দেখবার মতো।  এখানে বেশিরভাগ বিখ্যাত জিনিসের রঙ সাদা এবং বেশ উঁচু উঁচু।  তাই মাথা নীচু করার সুযোগ এখানে খুব কম। ভীষণ পরিষ্কার, ঝকঝকে একটি জায়গা, এরকম জায়গা চোখের পক্ষে খুব আরাম দায়ক। আজকের মতো দেখা শেষ। কাল ফোর্থ অফ জুলাই, আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস। পুলিশ ও প্রশাসন নিরাপত্তার স্বার্থে বহু দর্শনীয় স্থান বন্ধ করে দিয়েছে। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, দুধ সাদা বাড়ী গুলোতে জ্বলে উঠেছে হাজারো আলো। গাড়ী স্টার্ট দিয়ে আজকের মত বিদায় জানালাম ওয়াশিন্টন ডিসি কে।

ট্রাম্প ইন্টারন্যাশনাল হোটেল বলরুম

৪ঠা জুলাই,

তিনদিন বেশ গরমের পর আজকের আবহাওয়া বেশ আরামদায়ক। আজ আমাদের গন্তব্য স্থল স্ট্যাচু অফ লিবার্টি। লম্বায় ১৫৪ ফিট, ওজন ৪৫০,০০০ পাউন্ড সমুদ্রের মাঝখানে উনি অবস্থিত মাথা উঁচু করে।

আমেরিকার একশতম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে  এই উপহারটি এসেছিল ফ্রান্স থেকে জাহাজে করে। এতে ছিল ৩৫০ টি টুকরো। সেই টুকরো গুলোকে একসাথে করে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি গড়তে সময় লেগেছিল চারমাস। লিবার্টি স্টেট পার্কে গাড়ী রেখে ফেরির টিকিট কেটে নিলাম।  এই ফেরিই পৌঁছে দেবে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি তে ও এলিস আইল্যান্ডে।  এখন যেখানে ফেরির টিকিট কাটার জায়গা তা ছিল আগে প্রথম আমেরিকার রেল স্টেশন। ইংল্যান্ড থেকে পণ্য এখানে আসত এবং তা পরে আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্তে নিয়ে যাওয়া হত। রেলস্টেশন, তার আশপাশের পরিবেশ দেখে বেশ আবেগ তাড়িত হয়ে পড়লাম। কিছুই ওখানে পরিবর্তন করা হয়নি যেমন ছিল তেমনিই রেখে দেওয়া হয়েছে।  রেল লাইনের ওপর দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল যেন আমি সেই পুরোনো সময়কে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছি। ফেরির ভেপু বাঁশি বেজে গেছে এবার উঠে পড়তে হবে।  দোতলা ফেরি, ওপরের তলায়  ছাদ খোলা, বসার জায়গা আছে।  বসে বা দাঁড়িয়ে যার যেমন ইচ্ছে সেই ভাবেই সমুদ্রকে উপভোগ করতে পারা যায়।  অপর প্রান্তে সমুদ্রের ধারে ছবির মতো সুন্দর আকাশ ছোঁয়া বিল্ডিং। শুকনো জলের হাওয়ায় দোল খেতে খেতে ফেরি এসে দাড়াল এলিস আইল্যান্ডে। যা আপার নিউইয়র্ক-এ অবস্থিত। এটিই প্রথম আমেরিকার ফেডারেল ইমিগ্রেন্ট স্টেশন। ১৮৯২ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত এটি ছিল ব্যস্ততম আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেন্ট স্টেশন। ১৯০৫ থেকে ১৯১৪ সাল অবধি প্রত্যেক বছর এক মিলিয়ন করে ইমিগ্রেন্ট আসত। যারা আসত তাদের ঊনত্রিশ টা প্রশ্ন করা হত, তার মধ্যে ছিল নাম, জীবিকা, এবং কত টাকা নিয়ে সে এসেছে। এটা জানা আমেরিকান সরকারের কাছে খুব জরুরী ছিল, কারণ তারা যেন এই টাকা দিয়ে ন্যূনতম প্রয়োজনগুলো চালিয়ে নিতে পারে। এখন এলিস আইল্যান্ড একটি মিউজিয়াম। সংরক্ষিত আছে তখনকার দিনের বাক্স, সুটকেস, ট্রাঙ্ক, গাড়ী,  বড় বড় পিপে যাতে খাদ্য ও জল সংরক্ষণ করত। আইল্যান্ড দেখা শেষ, মিস নিউজার্সি  ফেরি এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে এখন থেকে নিয়ে যাবে স্ট্যাচু অফ লিবার্টিতে। আজ আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস।  এমন দিনে এখানে ঘুরতে আসতে পেরে নিজেকে বেশ ভাগ্যবান বলে মনে হয়েছে।  ফেরি এসে নোঙর করেছে, নেমে পড়লাম চোখের সামনে পৃথীবি বিখ্যাত বিস্ময়টিকে দেখার জন্য। অগুনতি মানুষ আজ ভীড় জমিয়েছে।  লিবার্টির ক্রাউনে অর্থাৎ শিরদেশে  উঠতে গেলে ৩৯৩ টি সিঁড়ি টপকে সেখানে পৌঁছতে হোত। তবে তা দেখতে হলে মাস খানেক আগে টিকিট কেটে রাখতে হয়, আমাদের জানা ছিল না বলে এ যাত্রায় সেই সুভাগ্য থেকে বঞ্চিত হলাম। এখন অবশ্য লিফট আছে এবং অসুস্থ লোকেদের জন্য হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা আছে। তবে পাদদেশ  থেকেও এর সৌন্দর্য কোন অংশে কম নয়।  চারিদিকে জল, ঢেউ আর পঞ্জীভূত ফেনা, উদার নীল আকাশ, মাঝে মাঝেই উড়ে এসে সিগাল পাখির ছো মেরে মাছ তুলে নেওয়া আর তার মাঝখানে একটুকরো স্থলের উপর সবুজ অঙ্গসজ্জায় চোখের পলক না ফেলে স্ট্যাচুর সবাইকে নিরন্তর দেখে যাওয়া। দেখা গেল নামীদামী প্রচুর ক্যামেরাও।  এই দিনকে সাক্ষী করতে ক্যামেরার লেন্স ছেড়ে কেউ বেরতে চাইছে না। দেখার সমাপ্তি , এবার ফেরার পালা।  সমুদ্রের জলে সূর্যটা আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে, বাতাসের আদ্রতায় গায়ে হিমেল চাদরের স্পর্শ। ফেরির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, এবারের মত বিদায় জানাতেই হবে।  পেছন ফিরে স্ট্যাচু কে বলে আসলাম তোমার শিরোদেশকে স্পর্শ করতে হলে যে আমাকে আবার ফিরে আসতেই হবে। তাই আজকের মত আমাকে আজ্ঞা দাও।

আরও পড়ুন- আদর্শ শঙ্কর, দুর্গমকে সুগম করাই প্যাশন অভিযাত্রী অনিন্দ্যর

English Title: 
Diary of East Coast
News Source: 
Home Title: 

ইস্টকোষ্টের ডাইরি

ইস্টকোষ্টের ডাইরি
Yes
Is Blog?: 
No