তাঁর নিবিড় সাধনতন্ত্রে মিশে থাকত গণ-তন্ত্রের নিভৃত ধারাও

সাধারণের মনকে উচ্চ অনুভূতির গোমুখে পৌঁছে দেওয়ার প্রকল্পই হয়তো ছিল তাঁর!

Updated By: Mar 15, 2021, 06:38 PM IST
তাঁর নিবিড় সাধনতন্ত্রে মিশে থাকত গণ-তন্ত্রের নিভৃত ধারাও

সৌমিত্র সেন

করোনার চোখরাঙানি তো ছিলই। তার উপর ভোটবাংলা এখন হিংসা, কাদাছোড়াছুড়ির ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। নেতাদের নানা প্রতিশ্রুতি, পাল্টা প্রতিশ্রুতির বন্যা নিত্যদিন পেড়ে ফেলছে সাধারণ মানুষকে। নানা প্রকল্পের ঘোষণা। দল বদলের রমরমা। গণতন্ত্রের সর্ববৃহৎ উৎসব-লগ্নেই ঘোর কলরোলময় অস্থির অগভীর এক আবহে এল শ্রীরামকৃষ্ণের ১৮৬তম জন্মতিথির এই দিনটি।

অ্যাংলো-আমেরিকান ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ক্রিস্টোফার ইশারউড (Christopher Isherwood) ছিলেন বিশ শতকের বিশ্বসাহিত্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক মুখ। তিনি ছিলেন অলডাস হাক্সলের বন্ধুও। হাক্সলে একটা সময়ে ভারতীয় শাস্ত্রের প্রতি গভীর ভাবে আকৃষ্ট হন। আসেন শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত সাহিত্যের সংস্পর্শে। তিনিই ইশারউডকে বেদান্তের সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দেন। বন্ধুর সূত্রে এসে ইশারউডও ক্রমশ ডুবে যান বেদান্তচর্চায়। ধীরে ধীরে সরে আসেন রসসাহিত্য রচনা থেকে। জীবনের শেষ ৩৫ বছর তিনি বেদান্ত ও রামকৃষ্ণচর্চাতেই নিয়োজিত থাকেন। শ্রীরামকৃষ্ণকে নিয়ে একটি অসাধারণ বইও লেখেন--Ramakrishna and His Disciples। বইটির প্রথম বাক্যটিই হল--This is the story of a phenomenon!

'ফেনোমেনন' না হয় হলেন, কিন্তু সে তা উচ্চচিন্তার মানুষের স্তরে, সাধারণ কোনও ভাবে 'রিলেট' করে কি গভীর শান্ত সাধনার মিস্টিক সহজিয়া শ্রীরামকৃষ্ণের (Sri Ramakrishna) সঙ্গে? দেশের 'গণে'র কোনও যোগ ছিল কি তাঁর সাধন-তন্ত্রের? বরং তিনি তো চিরকাল বৃহত্তর গণের থেকে দূরে একান্তে আড়ালে নিভৃতেই রইলেন! হ্যাঁ, আপাতভাবে তেমনটা মনে হলেও, শ্রীরামকৃষ্ণজীবন ও কর্ম ভাল করে দেখলে বলতেই হয়, তিনি কখনওই সেই অর্থে গণ-বিচ্ছিন্ন নন; বরং আশ্চর্যজনক ভাবে সাধারণের দৈনন্দিনের খুঁটিনাটির খবরাখবর তিনি রাখতেন। তাঁদের দুঃখদুর্দশা অনুভব করতেন। না হলে কাশী যাওয়ার পথে এক জায়গায় মানুষের দুর্দশা দেখে কেন তিনি বেঁকে বসবেন? কেন তিনি মথুরবাবুকে বলবেন-- গরিব মানুষকে পেট ভরে খাবার আর পরনের কাপড় না দিলে, রইল তাঁর তীর্থভ্রমণ? প্রায় একই ঘটনা দেখা গিয়েছিল নদিয়ার কলাইঘাটাতেও। সেখানেও দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের জন্য প্রাণ কেঁদে উঠেছিল তাঁর।

আরও পড়ুন: সঙ্ঘজননী সারদাদেবী, এক শাশ্বত মাতৃমূর্তি

অর্থাৎ, শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর ভাবসমাধির চূড়ান্ত ট্রান্সেই শুধু নিমজ্জিত থাকতেন না, তাঁর দৃষ্টি মাটির দিকেও ছিল। না হলে পরবর্তীকালের বিবেকানন্দের (Vivekananda) সেবাধর্মের দর্শনই তো দাঁড়ায় না। শিষ্য নির্বিকল্প সমাধিতে লীন হয়ে থাকতে চায় জেনে কোন গুরু না তৃপ্ত-আনন্দিত হন! শ্রীরামকৃষ্ণ কিন্তু তীব্র তিরস্কার করেন নরেন্দ্রনাথকে। তাঁকে 'বটবৃক্ষে'র মতো হতে বলেন, বলেন এমন এক আশ্রয় হতে যেখানে বহু মানুষ এসে জিরিয়ে নেবে। জীবনের একেবারে শেষ প্রান্তে এসেও মানুষের জন্য ভাবনা যায়নি তাঁর। তখন তিনি কাশীপুরে। কাশীপুরের ঘর থেকে কলকাতার দিকে আঙুল তুলে শ্রীশ্রীমাকে (Sarada Devi) বলেন, কলকাতার মানুষগুলো কিলবিল করছে, ওদের দেখো।

শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনভাবনা, আধ্য়াত্মিকতা ও সাধনার কেন্দ্রে বরাবরই ছিল মানুষ। কখনও স্পষ্ট ভাবে, কখনও কিঞ্চিৎ অস্পষ্ট ভাবে। অর্থাৎ, যতই তিনি কালীর সন্তান হিসাবে ভাব-মুখে থাকেন না কেন তাঁর ভাবনাতন্ত্রে সাধনমন্ত্রে গণ-তন্ত্রও ছিল।

হ্যাঁ, শ্রীরামকৃষ্ণ 'ফেনোমেনন' তো বটেই, সম্ভবত আর চেয়েও আরও বেশি কিছু। তাঁর অসাধারণত্ব যুগে-যুগে অনুভূত হয়েছে। এ দেশের অসংখ্য বিশিষ্ট তো আছেনই। এ ছাড়াও অন্য নানা দেশের নানা সংস্কৃতির মানুষও তাঁর ভাবনাসম্পদের সংস্পর্শে এসে মুগ্ধ হয়েছেন, লিখে গিয়েছেন সেই অভিজ্ঞতার কথা। লিও তলস্তয়, রঁমা রঁলা, অলডাস হাক্সলে, ক্রিস্টোফার ইশারউড, থমাস মের্টন, আঁদ্রে জিদ, আর্নল্ড টয়েনবি, জোসেফ ক্যাম্পবেল...ছোট নয় তালিকাটা।

শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কিত তাঁর লেখার এক জায়গায় টয়েনবি (Arnold Toynbee) যেমন বলেছিলেন-- শ্রীরামকৃষ্ণের আধ্যাত্মিক কর্মপ্রক্রিয়া এবং তার অভিজ্ঞতা এমন ব্যাপক মাত্রার যে হয়তো কোনওদিনই ভারত বা তার বাইরের কোনও আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব ধর্মানুভূতির সেই উত্তুঙ্গ উচ্চতায় পৌঁছতে পারেননি!

আসলে 'গণ'কে নিত্যদিনের ছোটখাটো তুচ্ছতার চঞ্চল মোহানা থেকে টেনে তুলে তাকে ক্রমশ উচ্চ অনুভূতির গোমুখে পৌঁছে দেওয়ার প্রকল্পই হয়তো ছিল তাঁর! 

আরও পড়ুন: যুবসমাজের শক্তি ফেরাতে স্মরণে রাখুন স্বামীজির বাণী

.