Durga Puja 2022: দাম্পত্য || ছোটগল্প ||
তুষার সেনগুপ্ত
Updated By: Sep 30, 2022, 04:41 PM IST
দাম্পত্য
তুষার সেনগুপ্ত
মোড়লদের পুকুরে পায়ের চেটো ডোবানো জলে দাঁড়িয়ে দয়াল জেলে খুব সন্তর্পণে জাল টানছে। বাঁ হাতে ছড়ানো জাল চেপে ধরে ডান হাতের চেটো থেকে কনুইয়ে জাল গোটাচ্ছে। জালে আটকানো মাছের ছটফটানি জলের ভেতরেই টের পাওয়া যায়। জালটাকে গুটিয়ে পুকুর পাড়ে টেনে তুলল। বড় মেজো রুই কাতলা কালবাউশের সঙ্গে কিছু কই মাগুর শোল ল্যাটা চুনোপুঁটিও। ডাঙায় টেনে তুলতেই বড় মেজো কয়েক মুহূর্ত দাপাদাপি করেই নিথর। চুনোপুঁটিগুলো আরও কিছুক্ষণ ছটফটিয়ে থেমে গেল। জাল ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে খালুইয়ে বড় মেজো সেজো সব ঢুকিয়ে চুনোপুঁটিগুলো থলেতে পুরে মোড়ল বাড়ির পথে হাঁটা দিল দয়াল। মোড়ল বাড়ির মেজো জামাই এসেছে। শাঁসাল জামাই তাই ভারি খাতির। বড় কাতলাটা আর সঙ্গে রুই কালবাউশ মাগুর কই যা উঠেছে সব মোড়ল বাড়িতে দিয়ে দয়াল ঠিক করল অবশিষ্ট শোল ল্যাটা আর থলের চুনোপুঁটি নিয়ে বাড়ি ফেরার পথেই রোজকার খদ্দেরদের বাড়ি বাড়ি একটু হেঁকে যাবে। শুধু চুনো মাছে তো আর পেট ভরে না। চালটা তেলটাও তো নিয়ে যেতে হবে। ছোট বেটার তিনদিন ধরে ঘুসঘুসে জ্বর। মুখে রুচি নেই মোটেও। জাল গুটিয়ে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময়ই লক্ষ্মী বলে দিয়েছিল আজ যদি অন্তত কিছু চুনো মাছও আনতে পারে। ছেলেটা অনেকদিন ধরেই চুনোমাছের ঝালচচ্চড়ি খাবে বলে ঘ্যানঘ্যান করছে।
শোল আর ল্যাটাগুলো সরিয়ে মোড়ল গিন্নির ঝুঁড়িতে খালুইটা উপুড় করে দয়াল পেছন ফিরতেই বড়বাবুর ডাক,
- "আব্বে দয়াল, শোল ল্যাটা লিয়ে যেছিস মাগ ভাতার বেটা মিলে খাবি ঠিক আচে। কিন্তু থলির মধ্যি কী লুকাইছিস র্যা?"
কিছুটা থতমত খেয়ে দয়াল মিনমিন করে উঠল,
- "আজ্ঞে কত্তা, তেমন কিছুই নাই। চাড্ডি চুনোপুঁটি।"
- "জামাই চুনো মাছের অম্বল ভালবাসে। ওগুলো রেখে ঘর যা..."
বিনা বাক্যব্যয়ে দয়াল থলেটা দাওয়ায় উপুড় করে বাড়ির পথ ধরে। পথেই ছোট ইস্কুলের হেডমাস্টারকে শোল মাছটা গছিয়ে ল্যাটা মাছ'কটা নিয়ে বাড়ির পথ ধরবে। ধোঁয়া ওঠা গরম ভাতে লক্ষ্মীর হাতের ঝালঝাল ল্যাটার ঝাল। খিদেয় পেটটা যেন টনটন করে উঠল। মাস্টারের বাড়ির সামনে গিয়ে হাঁক পাড়তেই ভেতর থেকে মাস্টারের পাল্টা হাঁক,
- "কী এনেচিস র্যা? কই মাগুর কিচু আছে? নাকি মোড়লদের সব দিয়ে বাঁচাকাচা নিয়ে হাঁক পাচ্চিস?
- "আজ্ঞে মাস্টার জব্বর পাকা শোল আছে একখান। আপনার জন্যি বাঁচাইয়া আনচি।"
দয়ালের কথা শেষ হতে না হতেই বারদরজায় হাজির মাস্টার। শোলটা টিপেটুপে দেখে খানিক তাচ্ছিল্যের সুরে বলে উঠল,
- "আমার জন্যি না মাথা। মোড়লদের মুখে রোচে না বলি ছাড়ান দিচে। দেখি দেখি শোলের পাশে ওইগুলান কী? অ ল্যাটা? তা কষ্ট করে যখন এনেচিস তখন দে শোল খানা। একশোর বেশি কিন্তু দোবো না, তাও যদি ফাউ ল্যাটা ক'খান দিস...
- " আজ্ঞে মাস্টার ওই ল্যাটা ক'খান ছাড়ান দ্যান। বেটার জন্যি...''
দয়ালের কথা শেষ হওয়ার আগেই "তাইলে থাক" বলে মাস্টার পিছটান দিতেই মরীয়া হয়ে দয়াল বলে উঠল,
- "আঃ চটেন ক্যান মাস্টার। ঠিকাচে আর দশ টাকা ধরে দিয়েন। ফেরার পথে বেটার জন্যি না হয় দুটো ডিম...''
- "আমার ওই এককথা! একশো! পোষালে দে নইলে...''
দয়াল আর কথা বাড়ায় না। খালুইয়ের বাকি মাছ মাস্টারের দাওয়ায় উপুড় করে বাড়ির পথ ধরে। ওর বাড়ির পথেই ধানুর মুদির দোকান। মুদিখানার সঙ্গে আলু পেঁয়াজ ডিমও রাখে। ধানুর দোকান থেকে এক সের চাল আর আাড়াইশো ডাল নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
- "হ্যাঁ রে হাঁসের ডিম জোড়া কত?"
"দশ" বলে ধানু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই দয়াল বলল,
- "দে দিকি একজোড়া..."
থলেতে সবকিছু ভরে মনে মনে ঠিক করল সামনের হপ্তায় ঘোষেদের পুকুর ছেঁচে যা পাবে তার থেকে নির্ঘাত কিছু চুনোপুঁটি হলেও আগেভাগেই সরিয়ে রাখবে বেটার জন্যে। আজ লক্ষ্মীকে বলবে ঝালঝাল করে ডিমের ঝোল রাঁধতে। মা বেটায় খাবে। দয়ালের ডিম লাগে না। আলু ঝোল হলেই একথালা উড়ে যায়। লক্ষ্মীর হাতে জাদু আছে।
পুকুরে ডুব দিয়ে এসে খেতে বসল দয়াল। ধোঁয়া ওঠা ভাতের সঙ্গে প্রথম পাতে ডাল আর কলমি শাক। শাকভাত খাওয়া হতেই পাতে পড়ল রগরগে ডিমের ঝোল। পাতে ডিম দেখেই ধমক দিল দয়াল,
- "তুই জানিস না ডিম আমার পছন্দ নয়কো?"
- "জানি তো! দাম দিয়ে কেনা জিনিস ফেলে দোবো? আজ কষ্ট করে খেয়ে নাও দিকিনি। আজ আমার নিরিমিষি। ব্রত আচে।"
- "কিসের ব্রত শুনি? আমায় বোকা ঠাওরেচিস? ম্যালা সেয়ানা হয়েচিস, না?"
দয়ালের ধমকানি গ্রাহ্য না করেই ডাল আর কলমি শাক চটকে মেখে মুখে তুলতে তুলতেই ঝাঁঝালো সুরে উত্তর দেয় লক্ষ্মী,
- "খেতে খেতে চিল্লাওনি তো, গলায় লাগবে..."
Tags: