Durga Puja 2022: কোনও দেবী নন, দুর্গার পুজো যে আদতে কয়েকটি গাছেরই পুজো, জানেন?

Durga Puja 2022: মানুষ তখনও যেহেতু প্রকৃতিপুজোতেই অভ্যস্ত ছিল এবং মূর্তিপূজায় অনভ্যস্ত ছিল, তাই শস্যসমৃদ্ধি প্রার্থনা করে তাঁরা এক লৌকিক দেবীর পুজো করতেন, বলা ভালো, সরাসরি প্রকৃতিরই পুজো করতেন!

Updated By: Sep 29, 2022, 04:55 PM IST
Durga Puja 2022: কোনও দেবী নন, দুর্গার পুজো যে আদতে কয়েকটি গাছেরই পুজো, জানেন?

সৌমিত্র সেন

পঞ্জিকা বলছে, দুর্গাসপ্তমীর দিন সকালে নবপত্রিকা স্নান বিধি। বাড়ি বা মণ্ডপ থেকে কলাবউকে গঙ্গা বা কোনও স্থানীয় নদী বা কোনও জলাশয়ে নিয়ে গিয়ে তাঁকে স্নান করানো হয়। একান্ত নদী জলাশয় না পেলে মন্দিরেই এউ স্নানের বিধি। সে না হয় হল। কিন্তু কী এই নবপত্রিকা? দুর্গাপুজোর সঙ্গে তার যোগাযোগ কী? কেনই-বা দুর্গাপুজোয় কিছু উদ্ভিদ-সংবলিত এক নারীপ্রতিম মূর্তির এই স্নান বা পুজোর নিয়ম চলে আসছে?
 
এই 'কেন'গুলির উত্তর পেতে গেলে আমাদের একটু পিছিয়ে যেতে হবে। বহু বহু বছর আগে একটা সময় শরৎকালই ছিল শস্য সংগ্রহের, মানে যাকে আমরা 'হার্ভেস্ট' বলে থাকি, তার সময়কাল (বৃষ্টিপাতের প্যাটার্নের পরিবর্তন, ঋতুচক্রগত বদল, জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে এখন সেটা কিছুমাস পিছিয়ে অঘ্রহায়ণে পৌঁছেছে)। তখন শরৎকালেই আমন ধান কাটা হত। আর মানুষ তখনও যেহেতু প্রকৃতিপুজোতেই অভ্যস্ত ছিল এবং মূর্তিপূজা সেভাবে জানতও না, তাই তারা শস্যসমৃদ্ধি প্রার্থনা করে এক লৌকিক দেবীর পুজো করত, বা বলা ভালো, সরাসরি প্রকৃতিরই পুজো করত। শস্যই যে সমৃদ্ধি (আর প্রকারান্তরে অন্নই যে ব্রহ্ম) এই ভাবনাই নিহিত সেই আচারে। তখনও শরতে বা আশ্বিন মাসে দুর্গাপুজোর প্রচলন হয়নি। তখনও বাসন্তীপুজোই ছিল দুর্গাপুজো। অনাদি সময় থেকে সেই সময় (মোটামুটি চোদ্দো শতকের আগে, কেননা চোদ্দো শতকের শেষে বা পনেরো শতকের শুরুতেই আশ্বিনে নতুন করে দুর্গাপুজোর চল) পর্যন্তই সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে শস্য বা উদ্ভিদের পুজো করা হত। যা পরে শরতে দুর্গাপুজো শুরু হলে কোনও ভাবে তার সঙ্গে অন্বিত হয়ে যায় এবং ক্রমে দুর্গার পাশেই স্থান পায় সেই উদ্ভিদ-দেবী, তথা নবপত্রিকা।

পড়ুন, বাঙালির প্রাণের উৎসবে আমার 'e' উৎসব। Zee ২৪ ঘণ্টা ডিজিটাল শারদসংখ্যা

গবেষকদের মতেও নবপত্রিকার পুজো প্রকৃতপক্ষে শস্যদেবীরই পুজো। ড. শশিভূষণ দাশগুপ্ত লিখছেন, 'এই শস্যবধূকেই দেবীর প্রতীক গ্রহণ করিয়া প্রথমে পূজা করিতে হয়, তাহার কারণ শারদীয়া পূজা মূলে বোধহয় এই শস্য-দেবীরই পূজা। পরবর্তীকালের বিভিন্ন দুর্গাপূজার বিধিতে এই নবপত্রিকার বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া হইয়াছে। ... বলাবাহুল্য এই সবই হইল পৌরাণিক দুর্গাদেবীর সহিত এই শস্যদেবীকে সর্বাংশে মিলাইয়া লইবার একটা সচেতন চেষ্টা। এই শস্য-দেবী মাতা পৃথিবীরই রূপভেদ, সুতরাং আমাদের জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে আমাদের দুর্গাপূজার ভিতরে এখনও সেই আদিমাতা পৃথিবীর পূজা অনেকখানি মিশিয়া আছে।'

আরও পড়ুন: Durga Puja 2022: কী এই দুর্গার বোধন? কেন বছর-বছর প্রতি ষষ্ঠীতে দুর্গার ঘুম ভাঙাতে হয়?

একটি নিরীহ 'বোধহয়' যোগ করে শশিভূষণ এই জরুরি ব্যাখ্যাটা দিয়েছেন বটে, তবে তাঁর মতো তন্নিষ্ঠ গবেষকের মন্তব্যকে কোনও রকম সংশয় ছাড়াই মান্যতা দিতে হয়। অর্থাৎ, আমরা বুঝলাম, উদ্ভিদ বা নবপত্রিকার মাধ্যমে আমরা আসলে আমাদের আদিমাতা পৃথিবীরই পুজো করছি এবং সেই পুজো পৌরাণিক দুর্গাদেবীর সঙ্গে মিলিয়েও নিয়েছি। কিন্তু কী এই উদ্ভিদ-দেবী তথা নবপত্রিকা? কীসের পুজো সেই পুরাকালের মানুষ করতেন?

সপ্তমীর ভোরে নবপত্রিকায় যে ন'টি গাছকে স্নান করানো হয়, সেগুলি হল-- কলা গাছ, সাধারণ কচু, মানকচু, হলুদ, জয়ন্তী, বেল, ডালিম, অশোক এবং অবশ্যই ধান। এই ন'টি গাছ শস্যসমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন পুরাকালের মানুষ। তাঁরা হয়তো কিছু ভেবেচিন্তেই এই গাছগুলি নির্বাচন করেছিলেন। অথবা পরবর্তীকালে এতে কোনও পরিবর্তন ঘটে থাকতে পারে, যার কোনও তথ্য পরবর্তীকালে আমাদের হাতে পৌঁছয়নি।

তবে যেটা খুব ইন্টারেস্টিং, সেটা হল এই ন'টি গাছকেই দেবীত্বের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। এটা খুবই বিতর্কিত। প্রথমত, যদি উপরোক্ত তথ্যই ইতিহাসসিদ্ধ হয়, তবে নিশ্চয়ই পরবর্তীকালে উক্ত উদ্ভিদসমূহের উপর দেবীত্বের আরোপ ঘটে থাকবে। আর যদি, অন্য মতে, দুর্গাপুজোর শাস্ত্রবিহিত আচারের মধ্যেই এটা বরাবর থেকে থাকে, তবে নবপত্রিকার মধ্যে আলাদা করে শস্যপুজোর কৃষিজীবী-সঞ্জাত উদযাপনের তত্ত্ব খোঁজাটা বাহুল্যই।

আপাতত, নবপত্রিকার শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যাটার দিকে চোখ রাখা যাক:

নবপত্রিকার ন'টি উদ্ভিদ আসলে দেবী দুর্গার ন'টি বিশেষ রূপের প্রতীকরূপে কল্পিত।

কলা বা কদলী বা রম্ভা: এর অধিষ্টাত্রী দেবী ব্রহ্মাণী;
কচু (সাধারণ): এর অধিষ্টাত্রী দেবী কালিকা;
হলুদ বা হরিদ্রা: এর অধিষ্টাত্রী দেবী উমা;
জয়ন্তী: এর অধিষ্টাত্রী দেবী কার্তিকী;
বেল বা বিল্ব: এর অধিষ্টাত্রী দেবী শিবা;
ডালিম বা বেদানা বা দাড়িম্ব: এর অধিষ্টাত্রী দেবী রক্তদন্তিকা;
অশোক: এর অধিষ্টাত্রী দেবী শোকরহিতা;
মানকচু: এর অধিষ্টাত্রী দেবী চামুণ্ডা;
ধান: এর অধিষ্টাত্রী দেবী লক্ষ্মী;

এই ন'টি উদ্ভিদের শাখাপল্লবকে একত্রিত করে অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে একে শাড়ি পরিয়ে গণেশের পাশে রেখে দুর্গাপুজোর চারদিন এঁর পুজো করা হয়। এই নয় দেবীকে একত্রে 'নবপত্রিকাবাসিনী নবদুর্গা' বলা হয়। ইনি 'নবপত্রিকাবাসিন্যৈ নবদুর্গায়ৈ নমঃ' মন্ত্রে পূজিতা হন।

এতকিছুর পরেও নবপত্রিকা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। অনেক গবেষক ও শাস্ত্রবিদই বিষটিকে দুর্গা-আরাধনায় প্রক্ষিপ্ত বলেই মনে করেন। কেউ কেউ স্পষ্টই বলে দিয়েছেন, কোনও কোনও অন্ত্যজ জাতি দুর্গারপজোর সময়ে ন'টি উদ্ভিদের সম্মিলিত এক রূপকে পুজো করত এবং সেই থেকেই কোনও ভাবে মূল পুজোয় এটি যুক্ত হয়ে পড়েছে। অতএব, দুর্গাপুজোর সঙ্গে এর কোনও নাড়ির যোগ নেই। সত্যি বলতে কী, পণ্ডিতেরাও মনে করিয়ে দিয়েছেন, মার্কণ্ডেয় পুরাণে নবপত্রিকার উল্লেখ নেই, কালিকাপুরাণেও নবপত্রিকার সেভাবে উল্লেখ নেই; তবে কালিকাপুরাণে নবপত্রিকার উল্লেখ না থাকলেও সপ্তমী তিথিতে সেখানে পত্রিকাপূজার একটি নির্দেশ রয়েছে।

(Zee 24 Ghanta App দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App) 

.