বহু যুগ ধরে ‘সিঙ্গল মাদার’রাই সমাজ চালাচ্ছেন এখানে
এমন এক প্রাচীন জাতিগোষ্ঠী আছে, যারা শত শত বছর ধরে এই ‘সিঙ্গল মাদার’ বা একক মাতৃত্বের অধিকারকেই প্রাধান্য দিয়ে আসছে।
সুদীপ দে: বছর খানেক আগে সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল, অবিবাহিত মা সন্তানের একমাত্র অভিভাবক হতে পারে। তাই সরকারি নিয়মে এখন আধার কার্ড, ভোটার কার্ডে বাবার নাম না দিলেও সমস্যা হয় না। সাম্প্রতিক অতীতে ‘সিঙ্গল মাদার’ বা একক মাতৃত্বের অধিকারকে এ ভাবেই স্বীকৃতি দিয়েছে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত। তবে আইনি স্বীকৃতি সত্ত্বেও এখনও অনেক মহিলাকেই সন্তান পালনের ক্ষেত্রে নানা বাধার সম্মুখীন হতে হয়। তার কারণ, আমাদের সমাজ এখনও একক মাতৃত্বের বিষয়টির সঙ্গে ধাতস্থ বা অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেনি। হয়ত আরও কিছুটা সম লাগবে! কিন্তু তিব্বত সীমান্তের কাছে, চীনের ইয়ুনান ও সিচুয়ান প্রদেশে এমন এক প্রাচীন জাতিগোষ্ঠী বসবাস করে যারা শত শত বছর ধরে এই ‘সিঙ্গল মাদার’ বা একক মাতৃত্বের অধিকারকেই প্রাধান্য দিয়ে আসছে। বলা ভাল, একক মাতৃত্বই এই জাতিগোষ্ঠীর অন্যতম সামাজিক রীতি বা বৈশিষ্ট্য। এটাই বাস্তব এই মোসুও (Musuo) উপজাতিদের।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২৭০০ কিলোমিটার উচ্চতায় লুগুর হ্রদের পাড়েই বসবাস করেন এই উপজাতি গোষ্ঠী। এই মোসুওরা নিজেদের ‘না’ নামেও পরিচয় দিয়ে থাকেন। লুগুর হ্রদের পাড়ে প্রায় ৪০ হাজার মোসুও উপজাতি মানুষ বসবাস করেন।
মোসুওরা সম্ভবত মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অন্যতম সেরা দৃষ্টান্ত। চিনের সরকার সরকারিভাবে এই জাতিটিকে ‘নাক্সি’ বা ‘নাখি’ সংখ্যালঘু সম্প্রোদায় হিসাবে ঘোষণা করে। তবে এই ‘নাক্সি’ বা ‘নাখি’দের থেকে মোসুওরা সংস্কৃতি এবং ভাষাগত দিক থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। প্রতিটি পরিবার এখানে নিজস্ব পৃথক পৃথক বাড়িতে বসবাস করে এবং প্রত্যেকটি পরিবারের প্রধান এখানে একজন মহিলা। বংশানুক্রমিকভাবে এই মহিলারাই পরিবারের প্রধান হওয়ার দাবিদার হন এবং সম্পত্তির অধিকারী হয়ে থাকেন। মোসুয়া মহিলারা পরিবার, ব্যবসা এবং গোষ্ঠীর প্রশাসনিক দায়-দায়িত্ব, সব সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। এই সম্প্রোদায়ের শিশুরা মায়ের কাছেই বড় হয় এবং মায়ের পরিচয়েই বেড়ে ওঠে।
মোসুও উপজাতির পুরুষরা মূলত, মাছ বা অন্যান্য পশু-পাখি শিকার করে পরিবারকে সাহায্য করেন। আর ঘরের যাবতীয় কাজকর্ম, চাষাবাদ, পশুপালন, কাপড় বোনা ইত্যাদি প্রায় সব কাজেই হাত লাগান মোসুও মেয়েরা। মোসুও প্রবীণ-প্রবীণারা ফসল, খাদ্যদ্রব্য, কুটীর শিল্প সামগ্রী, হাতে বোনা কাপড়ের পসরায় পাড়ি দেন নিকটবর্তী গ্রাম বা শহরগুলিতে।
মোসুও উপজাতির আরও একটি মজার বৈশিষ্ট্য হল, এদের বিবাহ রীতি। মোসুও মেয়েরা যখন তেরো বছর বয়স পার করে ফেলে, তখন তারা তাদের সঙ্গী নির্বাচনের যোগ্যতা অর্জন করে। মোসুও মেয়েরা নিজেরাই নিজেদের পছন্দের পুরুষ সঙ্গী নির্বাচন করেন। পুরুষ সঙ্গীটি মেয়ের ইচ্ছা অনুযায়ী, মেয়ের বাড়িতেই এক বা একাধিকবার রাত্রিযাপন করেন। আর সকাল হলেই যে যার নিজের বাড়িতে ফিরে যান। যে ঘরে পাত্র-পাত্রী রাত্রিযাপন করেন, মিলিত হন একে অপরের সঙ্গে, তাকে ‘ফ্লাওয়ার রুম’ বলা হয়। মোসুও উপজাতিদের মধ্যে এমন ভাবেই চলে দু’জনের সম্পর্ক, যত দিন পর্যন্ত ওই নির্বাচিত পুরুষ সঙ্গীটিকে পছন্দ। কেউই কারও উপর কোনও প্রভাব বা জোর খাটান না। একজন মোসুও মহিলা তাঁর সম্পূর্ণ জীবলকালে এ ভাবে একাধিক পুরুষ সঙ্গী নির্বাচন করে থাকেন বা করতে পারেন। কোনও মোসুও মহিলা অন্তঃসত্তা হলে, তার সন্তানের পিতৃ পরিচয়ের কোনও প্রয়োজন হয় না। শিশুটি বেড়ে ওঠে তার মায়ের কাছেই, তার ‘মামার বাড়ি’তে। যেখানে যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় মেয়েরা লাঞ্ছিত, নিপীড়িত, সেখানে মাত্র ৪০ হাজার মানুষের মোসুও উপজাতি সমাজ নিঃসন্দেহেই একটি ব্যতিক্রমী সমাজ ব্যবস্থার উদাহরণ।