"কেউ কথা রাখে না!" নাদের আলির তিন প্রহরের বিলে "সবুজ দ্বীপের রাজা" সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
"কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি" এ যেন ধ্রুব সত্য।
সুমন মহাপাত্র: "কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি" এ যেন ধ্রুব সত্য। তেত্রিশ কেন তিনশো বছর পরেও রাখা-না রাখার এই শব্দবন্ধে যেন নিজেকেই প্রতিফলিত করতে পারবে পাঠক। আসমুদ্র হিমাচল জুড়ে সর্বত্র আঁকিবুকি কেটে বেড়াচ্ছে ইতিহাস। কিন্তু বাঙালি বড্ড ইতিহাস বিমুখ। স্মৃতির কোনও এক নির্জন কোণে কিংবা বিস্মৃতির জীর্ণ এক পাতায় বাঙালি স্থান দেয় ইতিহাসকে। ইতিহাস ধরে রাখা তো দূরের কথা ইতিহাসটা খুলেও কেউ পড়ে না। এই আক্ষেপ বাঘা বাঘা ব্যক্তিত্বের। অভিযোগ জমা পড়েছে তাঁর কাছেও। তাই তিনি ইতিহাস আর বর্তমানের মেলবন্ধনে গড়ে তুলেছেন একের পর এক সৃষ্টি। তিনি নীললোহিত।
কাশ ফুল দেখলেই বাঙালির মন কেমন করে। সে যেন আচমকাই শুনতে পায় ঢাকের বাদ্যি। সেবারেও হয়তো কাশফুল ফুটেছিল। স্বাধীনতার তেরো বছর আগে কাঁটাতারের ওপারের আমগাঁয় পুজোর তোড়ঝোড় তুঙ্গে। বাড়িটা মাটির, উপরে টিনের ছাদ, বৃষ্টি পড়লে দারুণ সুর হয়। সেই বাড়ির সামনেই অস্থায়ী আঁতুড়ঘরে মীরার কোল আলো করে এসেছিলেন সুনীল।
দিন কয়েক আগেই ফাঁসি হয়েছে মাস্টারদার। সশস্ত্র অভ্যুথ্থানে তখন ভাটা এসেছে। দেশের নেতা তখন গান্ধীজি। বিশ্বে অবশ্য হিটলারি চলছে। এমনই প্লটে বেড়ে ওঠেন বাঙালির নয়নের মণি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। আজকাল বোস্টনে কিংবা বার্মিংহামে যাকে নিয়ে লড়তে পারে আধুনিক বাংলা কাব্যজগত। তবে সুনীল বাবু কিন্তু নিজেকে খুব ধন্য মনে করতেন, কারণ তাঁর শৈশব জুড়ে গ্রাম-শহর দুইয়েরই মেলবন্ধন। ঠিক যেমন আজ খেয়েছি তো কাল খাইসি। আজ পাকা রাস্তায় মাথা ফাটছে, তো কাল কাঁটায় পা কাটছে।
বয়স তখন মেরে কেটে ৭, সেদিন স্কুল বন্ধ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মারা গিয়েছেন। ছেলের দল প্রস্তুত বিবেকানন্দ রোডে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মরদেহ দেখতে যাবে। কিন্তু ছোট্ট সুনীলের মনে প্রশ্ন, বিশ্বকবি কে? সুভাষচন্দ্র বসু সাহেবকে বোকা বানিয়ে লড়তে গিয়েছেন এটা জানা থাকলেও রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তখন খুব একটা বুঝে উঠতে পারেননি তিনি। কে জানত, ভবিষ্যতে এনার লেখায়ই বারবার ফিরে ফিরে আসবেন রবীন্দ্রনাথ। যাই হোক তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে গিয়েছে জাপান কলকাতায় দুটো বোমও ফেলে দিয়েছে। বাবার চাকরি অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ। অগত্যা ফিরতে হলো গ্রামে।
"একটাও রয়্যাল গুলি কিনতে পারিনি কখনও! লাঠি লজেন্স দেখিয়ে দেখিয়ে চুষেছে লস্কর বাড়ির ছেলেরা।" সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জীবনই তাঁর সৃষ্টির রশদ। তখন টাউন স্কুলে পড়ছেন তিনি, লস্করবাবু হেডমাস্টার। কোনও ক্রমে আলু সেদ্ধ খেয়ে দিন কাটছে। তখন একথালা ভাতা অমৃত। আর হেডমাস্টারের ছেলে গল্প করে বলত ভোগবিলাসের কথা, আর লাঠি লজেন্স চুষতো। তাই হয়তো বন্দি জেগে আছো কাব্যগ্রন্থের ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতায় এই লাইন।
স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় হলেও সুনীলের প্রথম প্রেম কিন্তু "কৃত্তিবাস।" শক্তি চট্টোপাধ্যায়, আনন্দ-সহ একাধিক তরুণ লেখকদের পত্রিকা। তবে সে প্রেমিকার সঙ্গে বিচ্ছেদও হয়েছে বিদেশযাত্রায়। তব শক্তি-সুনিলে একাত্মতা আজও তরুণ। শক্তিকে বকা দেওয়ার অধিকার একমাত্র ছিল সুনীলের। কখনও একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ মেনে নিতে পারেননি তিনি। দাদা গোছের লোকের মুখে এক মনে এক প্রবৃত্তিই তাঁকে রাজনীতিবিমুখ করেছিল। নকশাল নিয়েও ভিন্ন সুর ছিল তাঁর গলায়।
ঋত্বিকের মতো তাঁরও মনটা কেঁদে উঠত ভিটেমাটির জন্য। দেশভাগ তাঁকেও নাড়া দিয়েছিল। ‘সে তো অন্য দেশ। মানুষের জন্মভূমি আর স্বদেশ সবসময় এক থাকে না। আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমার জন্মভূমি বিদেশ হয়ে গেছে।’ একথাও এক জায়গায় লিখেছেন নীললোহিত। উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধে ঘেরা তাঁর জীবন। ভাগ্যিস তিনি একবেলা লিখতেন, দুবেলা লিখলে কী যে হতো তা হয়তো অজানা। তবে তাঁর সৃষ্টি বইর পাতা ছাপিয়ে বড় পর্দাতেও সফল। সত্যজিত রায়ের "অরণ্যের দিনরাত্রি" কিংবা "প্রতিদ্বন্দ্বী"-র মূলেও সুনীল। আজকের কাকাবাবুও তাঁরই চরিত্র। তিনি বাংলা সাহিত্যে "সবুজ দ্বীপের রাজা।" "আত্মপ্রকাশ" দিয়ে শুরু করলেও সারাজীবন " প্রথম আলোর" মতোই তিনি সুনীল। ট্রাজেডি! পুজোর আবহে তাঁর ধরায় আগমন, পুজোতেই সুনীল হারা বিশ্ব। আজ যখন ফের কাশফুল ফুটছে, তখন শরদের মেঘ বলেছে আজ তাঁর ৮৬-তম জন্মদিন।
আরও পড়ুন: জিডিপির বিশাল এই পতন উদ্বেগের; আরও নামতে পারে আর্থিক বৃদ্ধির হার, আশঙ্কা রঘুরাম রাজনের