বাঁকুড়ার গোকুল চাঁদ মন্দিরে যেন ইতিহাস কথা বলে!
অনেক ইতিহাসবিদদের ধারণা, গোকুলনগর এবং সলদা অঞ্চল যদি ভালভাবে খনন করা হয় তাহলে ইতিহাসের অনেক অজানা তথ্য সামনে উঠে আসবে।
কাকলী কর্মকার বিশ্বাস
(অতিথি অধ্যাপিকা রামানন্দ কলেজ, বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া)
ল্যাটেরাইট বা মাকড়া পাথরে নির্মিত গোকুল চাঁদ মন্দির হল বাঁকুড়া জেলার বৃহত্তম পঞ্চরত্ন মন্দির। বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর মহকুমার জয়পুর থানার আন্তরগত গ্রাম গোকুল নগর। এই গোকুল নগরের মধ্যমণি হলেন গোকুল চাঁদ। বিষ্ণুপুরকে বলা হয় গুপ্ত বৃন্দাবন। কৃষ্ণ প্রেমে মাতোয়ারা মল্ল রাজারা বনবিষ্ণুপুরের ১২ মাইল পূর্বে তৈরি করেন গোকুল। অর্থাৎ, শ্রী কৃষ্ণের জন্মস্থান। যমুনা বাঁধের (জয়পুর এর সমুদ্র বাঁধ এর থেকে আগাত ঝরনা) তীরে গোকুল চাঁদের অবস্থান। মন্দিরের দুই পাসে দুটি বাঁধ, একদিকে যেমন দৃষ্টি সুখের রসদ যোগায়, অন্যদিকে তেমনই গোকুল চাঁদের প্রহরীরও কাজ করে।
এই মন্দিরের তিন দিকে আছে বিষ্ণুর তিন অবতার নৃসিংহ অবতার, বামন অবতার এবং বরাহ অবতারের পাথরের খচিত বিগ্রহ ও তাদের পৃথক মন্দির। বরাহ অবতারের মূর্তিটির সাজসজ্জা বা অস্ত্রশস্ত্রর কারুকার্য অদ্ভুত সুন্দর ও জীবন্ত। যদিও গোকুল চাঁদ এবং অন্যান্য মন্দিরের বেশির ভাগ মূর্তিই চুরি হয়ে গিয়েছে। ঐতিহাসিকদের মতে, ১৪৬০ খ্রিস্টাব্দে রাজা চন্দ্র মল্ল এই মন্দির স্থাপন করেন (এ বিষয়ে মতান্তর রয়েছে)। গকুলনগর ছিল তখনকার অন্যতম প্রধান জনপদ। এই গকুল নগর ধরেই তৎকালীন রাজধানী তাম্রলিপ্ত যাতায়াত করতেন বহু সওদাগর, রাজা-মহারাজারা। যাওয়ার পথে যাত্রীদের জিরিয়ে নেওয়ার জায়গা ছিল এই মন্দিরটি।
এ বার আসি মন্দিরের প্রসঙ্গে। মন্দির চত্বরটি বেশ বড়। পূর্ব, পশ্চিমে প্রায় ১৮০ ফুট আর উত্তর, দক্ষিণে প্রায় ১৪০ ফুট উঁচু মাকড়া পাথরে তৈরি প্রাচীর ঘেরা এই মন্দির। মন্দির চত্বরের একদিকে মাকড়া পাথরের তৈরি মূল পঞ্চরত্ন মন্দির। মন্দিরের সামনে রয়েছে বড় একটি নাটমন্দির। মন্দিরের একপাশে প্রবেশদ্বার। এই প্রবেশদ্বারটি মাকড়া পাথরের উপর নিখুঁত হাতের অপরূপ সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কারুকার্যে সাজানো। প্রবেশ দ্বারের দেয়ালের কুলুঙ্গিতেই পাওয়া গিয়েছিল বিষ্ণু মূর্তি যা এখন সংগ্রহ শালায় সযত্নে রাখা আছে। কুলুঙ্গির উত্তর দিকে একটি উপমন্দির রয়েছে। যেখানে বৌদ্ধ এবং জৈন তীর্থঙ্করের ভগ্ন মূর্তি আছে। এর থেকেই অনুমান করা যায়, কালে কালে অনেক ধর্মেরই স্থান হয়েছে এই মন্দিরে। চিনা পরিব্রাজক হিউ এন সাং-এর বর্ণনা অনুযায়ী, এই অঞ্চলে সে সময় জৈন ধর্মের খুব প্রভাব ছিল।
চোখ জুড়ানো কারুকার্য-খচিত বিশাল এই মন্দিরটি প্রায় ৬০ ফুট উঁচু মোটা মোটা পাথরের দেওয়াল, থাম আর খিলান যুক্ত। মন্দিরের গর্ভগৃহটি এক কথায় অপূর্ব। দেখলে চোখ, মন যেন জুড়িয়ে যায়! এর চারদিকে অনেকগুলি খিলান, খিলানে ছোট ছোট নকসা। মন্দিরের গায়ে দশাবতারের মূর্তি খোদাই করা রয়েছে। এরই সঙ্গে দেওয়ার বিভিন্ন অংশে খোদাই করে রাসলীলা আর মহাভারতের বিভিন্ন ঘটনা চিত্রায়িত রয়েছে। মন্দিরের উপরে পাঁচটি চুড়ার মাঝেরটি সবচেয়ে বড় আর উঁচু। চুড়ার উপরের অংশ ক্রমশ ছুঁচালো হয়ে উপরে উঠে গিয়েছে। চুড়ার একেবারে উপরে একটি করে কলস বসানো রয়েছে।
মন্দিরের গর্ভগৃহে সিংহাসনের ওপর গোকুল চাঁদ অর্থাৎ, কষ্টিপাথর নির্মিত শ্রীকৃষ্ণের মূর্তি রয়েছে আর তাঁর বাঁ পাশে রয়েছে অষ্টধাতুর তৈরি শ্রীরাধিকা। মন্দিরের সামনে রয়েছে বিরাট নাটমন্দির। এই নাটমন্দিরেই এক কালে ভজন, কীর্তন, ভগবত পাঠ ইত্যাদি হতো মনে করা হয়।
নাট মন্দিরের ভিতরে দুটি পল এবং নকসা আঁকা স্তম্ভ আর সামনের দিকে আরও তিনটি স্তম্ভ রয়েছে। কীর্তন মণ্ডপের মূল দেওয়ালে তিনটি ছোট ছোট কুঠুরি রয়েছে আর এক দিকের দেওয়াল ঘঁসে ছাদে ওঠার সিঁড়ি। নাট মন্দিরের ছাদে বসে সামগ্র গোকুল চাঁদ মন্দির ভালভাবে দেখা যায়। মণ্ডপের ভিতরে, দক্ষিণ দিকের দেওয়ালে একটি বড় কুলুঙ্গি বা দেবতা স্থাপনের জায়গা রয়েছে। মনে করা হয়, এই সব কুলুঙ্গিতে এক সময় অনেক দেব-দেবির মূর্তি রাখা ছিল।
এই মন্দিরের চারদিকে বেশ কয়েকটি প্রচীন শিব মন্দিরও রয়েছে। যেমন, গোকুলনগর মৌজার উত্তর পূর্ব দিকে রয়েছে গন্ধেশ্বর শিবের মন্দির, যেখানে বাঁকুড়া জেলার বৃহত্তম শিব লিঙ্গটি রয়েছে। কালা পাহাড়ের আক্রমণে ক্ষত-বিক্ষত গন্ধেশ্বর-এর ভাস্কর্য আজও পর্যটকদের অবাক করে।
অনেক ইতিহাসবিদদের ধারণা, গোকুলনগর এবং সলদা অঞ্চল যদি ভালভাবে খনন করা হয় তাহলে ইতিহাসের অনেক অজানা তথ্য সামনে উঠে আসবে। শোনা যায়, গৌড় রাজ শশাঙ্কর আমলে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ জনপদ ছিল এই অঞ্চল। শোনা যায়, প্রদুম্নপুরের সামন্ত রাজারা এখানে বসবাস করতেন। বার বার তুর্কি আক্রমণে ক্রমশ ধ্বংস হয়ে যায় এই মন্দির। তবু পশুপতি শিব দিগম্বরের মূর্তি এবং বিষ্ণু মূর্তির ভগ্নাবশেষে এখনও ধিকি ধিকি করে বেঁচে আছে অনেক ইতিহাস।
প্রত্নতাত্ত্বিক রাখালদাস বান্দপাধ্যায়ের মতে, প্রাচীনতম লাকুরিশ মূর্তি এখানে ছাড়া গোটা বাংলাদেশের আর কোথাও দেখা যায় না। এই গোকুল নগরে জৈন, বৌদ্ধ, শাক্ত, শৈব, ভাগবত, প্রাক-চৈতন্য, বৈষ্ণবীও, বাউল, রামায়ণ-- সব মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। বর্তমানে গোকুল চাঁদ মন্দিরে নিত্তপুজা ছাড়াও দোল পূর্ণিমায় ভক্ত সমাগম হয়। দোল পূর্ণিমায় এখানে নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন কয়েকশো মানুষ। মেলা, কীর্তন, ভগবত পাঠে সারা গোকুল এক অন্য চেহারা নেয়।
গোকুল চাঁদের দর্শন করতে চাইলে বিষ্ণুপুর থেকে বিষ্ণুপুর-কতুলপুরগামী যে কোনও বাসে চড়ে জয়পুর বাসস্টপে নেমে সেখান থেকে টোটো বা গাড়িতে করে যাওয়া যায় পৌঁছে যাওয়া যায় গন্তব্যে। এই শীতের মরসুমে বাঁকুড়া-বিষ্ণুপুরে টেরাকোটায় মোড়া ইতিহাসের অলি-গলিতে ঘুরে দেখতে এলে গোকুল চাঁদ মন্দিরে আসতে ভুলবেন না! কারণ এখানে না এলে হয়তো বাংলার মল্ল রাজাদের সম্পর্কে অনেক কিছুই অদেখা-অজানা থেকে যাবে।
অনুলিখন: সুদীপ দে।
ছবি: কাকলী কর্মকার বিশ্বাস।