কাঁটাতার ও যন্ত্রণা
সৌরভ পাল
সীমান্ত থেকে বলছি। হ্যাঁ। বাংলাকে ভাগ করেছে যে কাঁটাতার সেই কাঁটাতারের পাশে দাঁড়িয়েই বলছি। এখনও কাঁটাতারের কাঁটা গুলি চুইয়ে কান্না ঝড়ছে। আর সেই বেদনায় হৃদ মাঝার কাঁটা বিদ্ধ। ক্ষতবিক্ষত ফুসফুসটা টিম টিম আলোর মতই, কখন হয়ত নিভে যাবে জীবনের মতই। কাঁটাতার পেরোতে গিয়ে ফ্যাল ফ্যালে সাদা ফতুয়াটাকে কোনও ভাবে বাঁচিয়েছি, বাঁচাতে পারিনি খোঁচাটা। চোখের মনির সামনে একটি সরু আলপিন ধেয়ে আসলে চোখের সামনেটা যেমন ঝাপসা হয়ে যায়, তেমনি সবটা ঝাপসা করে আসতে হল। বুঝে উঠতে উঠতেই দেখলাম কখন একটা অলিখিত বর্ডার পেরিয়ে চলে এসেছি। সীমান্ত দেখলাম। দেখলাম ঘর বাড়ি। দেখলাম মানুষ। আরও দেখলাম আকাশ। সবটাই তো এক মনে হল। ওপারে যখন হাওয়া দিলে গাছের পাতা নড়ে এপারেও তাই। ওখানে যেমন রাস্তা বেঁকে রাস্তা ছিল এখানেও ঠিক তাই। মনে হল যেন কিছুটা হেঁটে কোনও বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি। যত এগোচ্ছি ততই পথভ্রষ্ট হয়েছি। ভয় হয়নি। জানতাম, 'পথভ্রষ্ট হলেই মার্গ দর্শন হয়'। স্বপ্ন কল্পগুলি মুখে মুখে শুনে শব্দ বন্ধনীতে আবদ্ধ করলে সুন্দর বাক্য তৈরি হয় বটে কিন্তু বেদনার উপশম হয় না। এক্ষেত্রেও তাই।
বাবা আর ছেলে। সকালটা একসঙ্গেই কাটল। বাবা রেলিংটা ধরে দাঁড়িয়ে। ছেলে ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে। অনেকটা সময় আছে। আরও একবার ট্রেন থেকে নেমে গিয়ে বাবার কাছে ছুটল ছোট্ট ছেলেটি। কথা হল। হাতে হাতটাও রইল। সবটাই যেন জেল খানা বন্দি। বন্দি দশায়। স্বাধীনতাটা পেয়েছিল ওরা। মুক্তি হয়নি বন্দি দশার। জেলখানার ভিতরেই বন্দিরা স্বাধীন। মাছেরা স্বাধীন জলে, পাখিরা স্বাধীন আকাশে। একটা পাখি যদি উড়তে উড়তে সীমানা লঙ্ঘন করে কেও কৈফিয়ত চেয়েছে কখনও?
একটা মাছ যখন সাঁতর কাটতে কাটতে সাগরের সীমানা উলঙ্ঘন করে কেও প্রশ্ন করেছে? বিগত ১০০ বছরে কেও করেনি আগামী ১০০ বছরেও কেও করবে না। প্রশ্নের সম্মুখীন কেবল মানুষই। ট্রেনটা ছাড়ল। মৈত্রী এক্সপ্রেস নামে কতটা মৈত্রীর বার্তা ছিল, ছেলেটা বুঝতে পারল। আরও বুঝতে পারল যখন 'রিফিউজি' হওয়ার জন্য তাঁরই বন্ধু তাঁকে বলে 'জালি মাল'। সত্যিই তো। জাল কেটে মাছ এক দেশ থেকে অন্য দেশে এসেছে। জালি তো বটেই। বাজারিও বটে। আসলে এটাই মানুষের ধর্ম। যেটার সঙ্গে মাছের কোনও মিল নেই। মানুষ বলেও যন্ত্রণা থেকে, শোনেও যন্ত্রণা থেকেই।