Teachers Day: ক্ষিদ্দা-কোনি সম্পর্কের রসায়ন এবং আজকের খেল-দুনিয়া
আজ গুরু-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের ইতিবাচক রসায়নের দিকেই শুধু মনোনিবেশ করা যাক।
শুভ্রাংশু রায় সহকারী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, সোনারপুর মহাবিদ্যালয়
'ফাইট কোনি! ফাইট' স্রষ্টা মতি নন্দীর কলম এবং সরোজ দে পরিচালিত 'কোনি' সিনেমায় সাঁতার-প্রশিক্ষক ক্ষিদ্দার ভূমিকায় অভিনয় করা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত সংলাপটি সময়ের প্রেক্ষিতে আজ শুধু সাঁতার নয়, সমগ্র খেলার দুনিয়ায় জন্যই অনুপ্রেরণার একটি ব্র্যান্ডে পরিণত।
এমনকি শুধু সাহিত্য বা সিনেমার জগতেই নয়, বাস্তব রক্তমাংসের ময়দানি চরিত্র আলোচনা প্রসঙ্গেও তাই সহজেই ক্ষিদ্দা-কোনি উদাহরণ উঠে আসে। আসলে 'কোনি' উপন্যাসে অতি অভাবী অথচ প্রতিভাময়ী স্কুল ড্রপ-আউট কোনিকে কিছুটা খ্যাপাটে একগুঁয়ে আদর্শবান সাঁতার-শিক্ষক ক্ষিদ্দার খুঁজে বের করা এবং সমস্ত প্রতিকূলতা দূরে সরিয়ে সাঁতারের সর্বভারতীয় মঞ্চে তাঁকে প্রতিষ্ঠা করার যে প্রয়াস আমরা দেখি, যে জার্নি আমাদের চোখে ধরা পড়ে, তা বাস্তব দুনিয়ায় বিশেষত খেলার মাঠে এমন বেশ কিছু কোচ বা গুরু-শিষ্যের বেড়ে ওঠার সঙ্গে কেমন যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। কল্পনার চরিত্র আর রক্তমাংসের খেলদুনিয়া মাঝে মাঝেই সেখানে একবিন্দুতে মিলে যায়।
আরও পড়ুন: Teachers Day 2021: শিক্ষক দিবসে স্মরণ জাতির অন্যতম শিক্ষক সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণকে
ফুটবল দিয়েই শুরু করা যাক। দুঃখীরাম (উমেশচন্দ্র) মজুমদারকে ধরুন। সারাদিন একটি সাইকেলে এ মাঠ থেকে সে মাঠ করে বেড়াতেন। ময়দানের তিনি ছিলেন 'স্যার'। সারা জীবন পড়ে রইলেন এরিয়ানস ক্লাবে। তাঁর অসংখ্য তৈরি করা খেলোয়াড়ের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ভাইপো ছোনে (সন্তোষ) মজুমদার। ছোনে মজুমদারের বুট পরে খেলতে বেশ কষ্টই হত। কিন্তু কাকা থুড়ি স্যারের কড়া আদেশ ছিল বুট পরেই খেলতে হবে। গুরুর নিয়ম বা আদেশ অমান্য করার কথা ভাবতেই পারতেন না ছোনেরা।
যেমন কপিল দেব নিখাঞ্জ (Kapil Dev)। নেটে পরিশ্রমের পাশাপাশি ভীষণই খেতে ভালবাসতেন। ক্রিকেট কোচ দেশপ্রেম আজাদ নির্দেশ দিলেন, দুটোর বেশি পরোটা খাওয়া চলবে না! ব্যস! সারা ক্রিকেট-জীবনের জন্য কপিলের ওই দুটি পরোটাই বরাদ্দ হয়ে গেল। অলিম্পিয়ান দীপা কর্মকারকে টানা ছ'মাস মোবাইল ফোন আর আইসক্রিম ছুঁতে দেননি কোচ বিশ্বেশ্বর নন্দী। দীপা হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন। সচিনকে (Sachin Tendulkar) দাদা অজিত তেন্ডুলকার যখন শিবাজি পার্কে রমাকান্ত আচরেকরের কাছে নিয়ে যান তখন সচিনের ডিফেন্স বলে কিছুই ছিল না। আচরেকর সচিনের ব্যাটিং স্টান্স আমূল বদলে দেন। সঙ্গে পাঠ দেন মাঠ আর মাঠের বাইরে শৃঙ্খলার। আচরেকর স্যারের সেই পাঠ আজও অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন সচিন।
উলটো উদাহরণও আছে। অনেক সময় অবশ্য সাফল্য গুরু শিষ্যের মধ্যে সম্পর্কে চিড়ও ধরিয়েছে। আচরেকরের এক শিষ্যের নাম এক নিশ্বাসে চলে আসে-- বিনোদ কাম্বলি। মাঠের বাইরে আচরণ সম্পর্কে গুরুর আদেশ পালন করতে পারেননি কাম্বলি। অনেক ক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে মানসিক দূরত্বও তৈরি হয়ে যায়। ব্যাডমিন্টনে এক সময় সাইনা নেহওয়াল এবং বর্তমানে পিভি সিন্ধুর সঙ্গে কোচ গোপীচাঁদের টানাপড়েন মনে হয় সাম্প্রতিক সময়ে সব থেকে বড় উদাহরণ। অতীতেও এমন উদাহরণ ভারতীয় খেলায় আছে। সদ্যপ্রয়াত এম এন নাম্বিয়ার সঙ্গে দীর্ঘদিন বাক্যালাপ বন্ধ ছিল তাঁর অতি প্রিয় ছাত্রী লেজেন্ডারি দৌড়বীর পিটি ঊষার।
গুরু-শিষ্যের বাস্তবের খেলদুনিয়ায়, বিশেষত ভারতীয় সমাজে স্বদেশীয় ভাবধারায় গুরু বা কোচ একই সঙ্গে প্রশিক্ষক এবং অভিভাবক। কিন্তু আন্তর্জাতিক মিডিয়া এক্সপোজার এবং নতুন পেশাদারি মূল্যবোধ অনেক ক্ষেত্রেই এই সম্পর্কে চিড় ধরায়। অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত মানসিক দ্বন্দ্বও নানা সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ভারতীয় কুস্তির আখড়ায় এমন বেশ কয়েকটি উদাহরণ মেলে। আদতে কোচ বা গুরু এবং তাঁর শিক্ষার্থীর সম্পর্কের একটি নিজস্ব রসায়ন রয়েছে যা ঠিকঠাক থাকলে তবেই সাফল্য আসে। এবং তার চেয়েও বড় কথা, সাফল্যের পরেও সম্পর্ক বজায় থাকে। এই রসায়নে গড়বড় হলেই মুস্কিল। তবে আজ শিক্ষক দিবসে আমাদের শুধু ক্ষিদ্দা-কোনির গুরু -শিক্ষার্থীর সম্পর্কের ইতিবাচক রসায়নের দিকেই মনোনিবেশ করা যাক।
হয়তো বা আজও আমাদের অলক্ষ্যে এমন অনেক ক্ষিদ্দা খ্যাপার পরশপাথর খোঁজার মতো সুপ্ত প্রতিভার সন্ধান করে চলেছেন। যে প্রতিভা একদিন প্রতিভাত হয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে দেশের নাম উজ্জ্বল করবে। সেখানেই তো ক্ষিদ্দাদের সাফল্য। পরম প্রাপ্তি।
(Zee 24 Ghanta App : দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)
আরও পড়ুন: Accusations of plagiarism: ছাত্র-শিক্ষক দ্বন্দ্ব গড়াল কলকাতা হাইকোর্ট পর্যন্ত!