দলে অন্তর্ভুক্তিতে রাশ টানল বিজেপি, ভাবমূর্তি স্বচ্ছ রাখার নির্দেশ
তৃণমূল থেকে ক্রমান্বয়ে বিজেপিতে সামিল করানোর বিষয়ে নীতি স্পষ্ট করল বিজেপি নেতৃত্ব
ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়
বিজেপিতে যদি তৃণমূলের নেতাদের লাগামছাড়া ভাবে শামিল করা হয়, তা হলে দলের ভাবমূর্তি কতটা স্বচ্ছ থাকবে? এ নিয়ে রাজ্য বিজেপির একাংশ প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছিল আগেই।
সায়ন্তন বসু বা রাজু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো যে নেতারা ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন পর্যন্তও রাজ্য বিজেপির (bjp) একেবারে সামনের সারির মুখ ছিলেন, তাঁরা এ নিয়ে কয়েক বার প্রকাশ্যে মুখ খুলতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ভাল চোখে দেখেনি সেই মুখ খোলাকে। আরও নির্দিষ্ট ভাবে বললে, অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন স্বয়ং অমিত শাহ, যিনি নিজে বাংলার নির্বাচনের প্রস্তুতি ও রণকৌশল দেখভাল করছেন। কাকে দলে নেওয়া হবে, কাকে নেওয়া হবে না, সে বিষয়ে রাজ্য নেতৃত্বের কেউ যেন মন্তব্য না করেন, এই বার্তাও দেওয়া হয়েছিল শাহের অফিস থেকে। তাতেও যখন পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ হাতে রাখা যাচ্ছিল না, তখন সরাসরি 'শোকজে'র রাস্তা নেয় দল। অমিত শাহের নির্দেশে 'শোকজে'র মুখে পড়েন সায়ন্তন বসু, অগ্নিমিত্রা পল-সহ পাঁচ নেতা।
সর্বোচ্চ নেতৃত্বের এই কঠোর অবস্থান বুঝে নেওয়ার পরে রাজ্য বিজেপির সব অংশই নিজেদের সামলে নিয়েছে। দলে তৃণমূলের লোকজন নেওয়ার বিষয়ে তাই প্রকাশ্যে কেউ আর কোনও মন্তব্য করছেন না। কিন্তু ঘনিষ্ঠ মহলে অনেকেই এখনও ক্ষোভ ব্যক্ত করছেন। এই বিজেপি নেতাদের প্রশ্ন, রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় যে সব তৃণমূল নেতাদের উপরে ক্ষোভ থাকায় মানুষ বিজেপির দিকে ঝুঁকেছিলেন, সেই নেতাদেরই দলে নিলে বিজেপি ভোট ধরে রাখবে কী ভাবে?
শুধু বিজেপি নেতাদের একাংশ নয়, এ বার অসন্তোষ জানিয়েছে সঙ্ঘও। রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবেই সঙ্ঘ নিজের পরিচয় দেয়। তাই সঙ্ঘের কাছে আদৰ্শ আগে, ভোটের হিসাব পরে। পশ্চিমবঙ্গে ভোটে জেতার জন্য সবার জন্য দরজা হাট করে খুলে দিক বিজেপি, এটা চাইছে না সঙ্ঘ। তাতে ভোটে জয় না এলে না আসুক, কিন্তু আদৰ্শগত ভিত্তি দুর্বল করা উচিত হবে না-- সঙ্ঘের তরফে বিজেপি-কে এই বার্তা দেওয়া হয়েছে বলে খবর।
সঙ্ঘের এই বার্তার পরে অমিত শাহের (amit sah) টিমও একটু নতুন করে ভাবছে বলে বিজেপি সূত্রে জানা যাচ্ছে। টিম অমিত শাহ প্রায় ১৮ মাস ধরে নীরবে এবং বেশ কিছুটা গোপনে বাংলা জুড়ে সমীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে। দলের দরজা সবার জন্য খুলে রাখার নীতিও সেই সব সমীক্ষার ভিত্তিতেই প্রথমে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গণযোগদানের বিষয়ে এখন সেই সব সমীক্ষাতেও কিছুটা নেতিবাচক ফিডব্যাক শাহি দরবারে পৌঁছেছে বলে বিজেপি সূত্রে জানা যাচ্ছে। অর্থাৎ, প্রথমে দলের একাংশের ক্ষোভ, তার পরে সঙ্ঘের সতর্কবার্তা এবং সব শেষে সমীক্ষার আভাস-- এই তিন বিষয়ের কথা মাথায় রেখে দলের দরজায় এ বার কিছু ছাঁকনি বসাচ্ছে বিজেপি।
এ রাজ্যের এক সঙ্ঘঘনিষ্ঠ বিজেপি নেতার কথায়, 'দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব পুরো পরিস্থিতিই জানেন। লাগামহীন ভাবে কোনও কিছুই হবে না। অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে যাঁকে-তাঁকে দলে ঢুকতে দেওয়া হবে, এমন ভাববেন না। যাঁরা যোগ দিচ্ছেন, তাঁরা সকলে টিকিট পাবেন, এমনও নয়। রাশ টানা হচ্ছে। সেটা কী ভাবে টানা হচ্ছে, অল্প কিছু দিনেই বুঝতে পারবেন।'
সঙ্ঘঘনিষ্ঠ ওই বিজেপি নেতা যে কথা বলেছেন, দিল্লি থেকেও কিন্তু ঠিক সেই খবরই এসেছে। গতকাল দিল্লিতে বঙ্গ বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বকে নিয়ে অমিত শাহ, জে পি নাড্ডা, বি এল সন্তোষরা যে বৈঠক করেছেন, সেখানেই নতুন 'মেকানিজম' স্থির হয়েছে। দলে কাউকে স্বাগত জানানোর প্রশ্নে তিনটি 'ক্যাটেগরি' নির্দিষ্ট করা হয়েছে।
১. যাঁদের ভাবমূর্তি খুব খারাপ, তাঁদের কিছুতেই দলে নেওয়া হবে না। যেমন দক্ষিণ দিনাজপুরের তপনের বিধায়ক বাচ্চু হাঁসদা। তিনি চাইলেও এখন বিজেপির দরজা তাঁর জন্য খোলা হবে না।
২. যাঁদের ভাবমূর্তি চূড়ান্ত কালিমালিপ্ত না হলেও বিতর্কিত, তাঁরা যোগ দিতে চাইলে নেওয়া হবে, কিন্তু টিকিট দেওয়া হবে না। যেমন কালনার বিধায়ক বিশ্বজিৎ কুণ্ডু। তাঁকে বিজেপিতে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি টিকিট পাবেন কি না, নিশ্চয়তা নেই।
৩. যাঁদের ভাবমূর্তি ভাল বা জনভিত্তি দৃঢ়, তাঁদের যত দ্রুত সম্ভব বিজেপিতে সামিল করানো হবে। যেমন রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মতো স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নেতাদের বিজেপির দিকে টেনে নেওয়ার বিষয়ে দলের কোনও অংশ থেকে কোনও বাধা যাতে তৈরি করা না হয়, সে বার্তা স্পষ্ট ভাবে দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ঠিক এই কারণেই সদ্য তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যোগ দেওয়া শুভেন্দু অধিকারীর গুরুত্ব হুহু করে বাড়ছে বিজেপিতে। শুক্রবার রাতে দিল্লিতে যে বৈঠক হয়েছে, তাতে শুভেন্দু অধিকারীর না থাকা নিয়ে অমিত শাহ অসন্তোষ প্রকাশ করেন বলেও খবর। শুভেন্দুকে ওই বৈঠকে থাকতে বলা হয়নি জেনে শাহ ক্ষুব্ধ হন। তাঁর দফতর শুভেন্দুর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁকে দিল্লি পৌঁছতে অনুরোধ করে। কিন্তু তখন বৈঠক শুরু হতে আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা বাকি। পূর্ব মেদিনীপুর থেকে কলকাতা হয়ে দিল্লি পৌঁছনোর মতো সময় তখন আর শুভেন্দুর হাতে নেই। তাই শুভেন্দুকে কোর গ্ৰুপে সামিল করে নেওয়ার নির্দেশ অমিত শাহই দিয়েছেন বলে বিজেপি সূত্রে জানা যাচ্ছে। এই ধরনের জরুরি বৈঠকগুলিতে শুভেন্দু যাতে অবশ্যই থাকেন, তা নিশ্চিত করতেই এমন বন্দোবস্ত বলে খবর।
শুভেন্দুকে নিয়ে কিছু বিতর্ক রয়েছে ঠিকই। কিন্তু তা শুভেন্দুর ভাবমূর্তিকে চূড়ান্ত কালিমালিপ্ত করতে পেরেছে, এমন নয় বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মত। আর শুভেন্দুর জনভিত্তি কতটা, তার প্রমাণ তিনি প্রায় প্রতিটি কর্মসূচিতে দিচ্ছেন। তাই শুভেন্দু বা রাজীবের মতো নেতাদের বিজেপিতে সামিল করার ব্যাপারে কোনও দ্বিমত থাকবে না-- এমন সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছে শুক্রবার রাতের বৈঠকে।
Also Read: 'ঘরোয়া মিটিং করেছিলাম, বিষয়টা এত বড় হবে বুঝিনি', সুব্রত বক্সির ফোনে সুর নরম গৌতমের