ক্ষত-বিক্ষত সুন্দরবনের ফুসফুস, চিকিত্সা না হলে মানচিত্র থেকে মুছে যেতে পারে ম্যানগ্রোভ

সুন্দরবনের ফুসফুস ম্যানগ্রোভ। আমফানে ক্ষতবিক্ষত সেই ফুসফুস। এখন শ্বাস নিতে কষ্ট হয় গরান, গেওয়া, হেঁতাল, পরশ, সুন্দরীদের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন সুন্দরবনের ভীত নড়ে গিয়েছে

Edited By: সোমনাথ মিত্র | Updated By: Jun 2, 2020, 10:12 AM IST
ক্ষত-বিক্ষত সুন্দরবনের ফুসফুস, চিকিত্সা না হলে মানচিত্র থেকে মুছে যেতে পারে ম্যানগ্রোভ
নিজস্ব চিত্র

অধীর রায় ও প্রসেনজিত্ সর্দার

জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ। এমন যুগলবন্দি এই উপমহাদেশে  একমাত্র আছে সুন্দরবনেই। দেশ-বিদেশের বহু পর্যটক সুন্দরবনে ছুটে আসেন গভীর জঙ্গলের রস আস্বাদনের পাশাপাশি কুমির আর বাঘের সহাবস্থান দেখতে। গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকার উপর তৈরি  পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ সুন্দরবন। বেশিরভাগটাই বাংলাদেশের দিকে। ভারতের দিকে রয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার তেরোটি আর উত্তর ২৪ পরগনার ছটি ব্লক। সেই সুন্দরবন উষ্ণায়নের পাশাপাশি একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ে ভারতের মানচিত্র থেকে মুছে যাওয়ার সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে! আর এই আশঙ্কা আরও প্রবল করেছে সদ্য সুপার সাইক্লোন আমফান বয়ে যাওয়ার পর।

সুন্দরবনের ফুসফুস ম্যানগ্রোভ। আমফানে ক্ষতবিক্ষত সেই ফুসফুস। এখন শ্বাস নিতে কষ্ট হয় গরান, গেওয়া, হেঁতাল, পরশ, সুন্দরীদের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন সুন্দরবনের ভীত নড়ে গিয়েছে।

** আমফানে কীভাবে ক্ষতি করল?  

আমফানে সুন্দরবনের ক্ষতিকে দুটি ভাগে ভাগ করছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রথম: বাতাসের দ্বারা ক্ষতি -  যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ওসনোগ্রাফি বিভাগের ডিরেক্টর প্রফেসর  তুহিন ঘোষ জানান,  সুন্দরবনের পশ্চিমাঞ্চল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই অঞ্চলের সাগর, নামখানা, বাসন্তী  তছনছ হয়ে গিয়েছে ঝড়ের দাপটে।

দ্বিতীয় জলের দ্বারা ক্ষতি:

পূর্বাঞ্চলের পাথরপ্রতিমা, গোসাবা, হিঙ্গলগঞ্জ, হাড়োয়া, মিনাখা এবং সন্দেশখালি-২   ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাঁধ ভেঙে নোনাজলে প্লাবিত হয়ে। এইসব প্লাবিত হয়ে যাওয়া অঞ্চলগুলিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে চার থেকে পাঁচ বছর সময় লাগবে। কারণ  কম করে চারটি বর্ষার জল পাওয়ার পর এই অঞ্চলগুলো স্বাভাবিক চেহারায়  ফিরে আসবে বলে মত তুহিন বাবুর।

** শেষ পেরেক পুঁতে দিল আমফান:

সুন্দরবন-সহ পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোকে ভাঙনের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। তবে, অনেক দিন আগের থেকেই শুরু হয়েছে ম্যানগ্রোভ ধ্বংস। আমফান সেই কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতে দিয়ে গেল। দিনের পর দিন সুন্দরবনে চোরা শিকারিদের তাণ্ডবে সাফ হয়ে গেছে ম্যানগ্রোভের জঙ্গল। জঙ্গল কেটে নদীর ধারে গড়ে উঠেছে অবৈধ ঘরবাড়ি। ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে জঙ্গলের ঘনত্ব। নদীর পাড় হারিয়ে ফেলছে  মাটি ধরে রাখার ক্ষমতা।

প্রফেসর তুহিন ঘোষ কথায়, ২০মে সুপার সাইক্লোনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নদীর পাড় জুড়ে ন্যাচারাল ম্যানগ্রোভের। আবার নতুন করে ন্যাচারাল ম্যানগ্রোভ তৈরি হতে বেশ কিছুদিন সময় লাগবে। কারণ নদীর পাড়ের সেডিমেন্ট বা পলি তৈরি না হলে ম্যানগ্রোভের জন্ম হবে না। এখন যা অবস্থা এই মূহুর্তে নদীতে পলি পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। ন্যাচারাল  ম্যানগ্রোভ নদীর পাড়ে নিজে থেকেই জন্মায়। আমফানের দাপটে নদীর পাড়ে থাকা ম্যানগ্রোভগুলো নদী ভাঙনে তলিয়ে গেছে। যার ফলে ম্যানগ্রোভের বীজ এখন আর জলে পড়বে না।

কীভাবে ন্যাচারাল ম্যানগ্রোভ তৈরি হয়?

সাধারণ সময়ের নদীর পাড়ের ম্যানগ্রোভের বীজ জলে পড়ে ভাসতে ভাসতে একটা জায়গায় এসে আটকে যায়। সেখানে পলির সঙ্গে ধানিঘাস পেয়ে ন্যাচারাল ম্যানগ্রোভের জন্ম হয়। আর এটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এখন নদীতে সেডিমেন্ট না থাকায় সেই সম্ভাবনা বর্তমানে নেই বলে দাবি তুষারবাবুর।

** মহিলাদের হাতে তৈরি ম্যানগ্রোভ:

সুন্দরবনে প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষের বাস। এঁরা প্রত্যেকেই জানেন, বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে ম্যানগ্রোভের প্রয়োজনীয়তা। এখানকার মহিলারা প্রাণের দায়ে ম্যানগ্রোভ রোপন করেন। একশো দিনের কাজে ম্যানগ্রোভ চাষ কিংবা নদীর ধারে গাছ লাগানোর কাজ চলছে। তবে তা খাতায় কলমে বলে অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের।

** স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্ষোভ:

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, একশো দিনের কাজে পরিকল্পনা করে ম্যানগ্রোভ লাগানো হয় না। অবৈধভাবে সুন্দরবনের গাছ কাটা বন্ধ করতে উদ্যোগী নয় বনদফতরের কর্মীরা। বরং চোরাশিকারিরা তাদের কাছ থেকে মদত পায় বলে অভিযোগ করছেন সুন্দরবনে বসবাসকারীদের এক বৃহৎ অংশ। কিছু অসাধু মানুষের প্রলোভন থেকে ম্যানগ্রোভকে রক্ষা করতে পারছে না স্থানীয় বাসিন্দারা।

** কিভাবে ঘুরে দাঁড়াবে সুন্দরবন?

আমফানে পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপের জমি আলগা হয়ে গেছে । এরপর অল্প ঝড়েই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। এই অবস্থায় দীর্ঘ মেয়াদির পাশাপাশি স্বল্প মেয়াদকালে কিছু পদক্ষেপ করতে হবে। এমনটাই দাবি বিশেষজ্ঞদের। তাঁদের পরামর্শ , 

১) সরকারি এবং স্থানীয় বসবাসকারীদের উদ্যোগে ম্যানগ্রোভ গাছ যেমন পুঁততে হবে। তেমনই কঠোর হাতে বন্ধ করতে হবে গাছ কাটা।

২) নদীর থেকে প্রায় ৫০০ মিটারের মধ্যে কোনও ঘরবাড়ি করতে দেওয়া চলবে না।

৩) ঝড়ে সতর্কতা থাকলে গুরুত্ব সহকারে আগাম সতর্কতা নিতে হবে। সেই সঙ্গে জেলা এবং ব্লকস্তরে ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট গ্রুপ তৈরি করে তাদের বিপর্যয় মোকাবিলা আরও প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

৪) অন্যান্য রাজ্যের মত EOC অর্থাৎ Emergency  Oparetion Center নামে একটি দফতর তৈরি করে তাদের সচল রাখতে হবে । তবেই সুন্দরবন বাঁচবে । নচেৎ  সুন্দরবন তো বটেই তার সঙ্গে কলকাতা সহ পার্শ্ববর্তী জেলাগুলো আগামী দিন মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে।

.