বোল্ট, শেলি, আর ট্রেনের ভূমি যুদ্ধ

Updated By: Aug 24, 2015, 10:45 PM IST

পার্থ প্রতিম চন্দ্র

আজই বেজিংয়ে বার্ড নেস্ট স্টেডিয়ামে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ১০০ মিটার সোনা জিতলেন জামাইকার মেয়ে শেলি-অ্যান ফ্রেজার-প্রাইস। গতকাল ১০০ মিটার পুরুষদের দৌড়ে জিতেছিলেন উসেইন বোল্ট। এদিকে, আজই আবার শিয়ালদা-বনগাঁ ট্রেন লাইনে 'মাতৃভূমি'-র পাল্টা 'পিতৃভূমি'-র দাবিতে চলল জোর বিক্ষোভ-অবরোধ। দুটো ঘটনাকে মিলিয়ে দিলেন একজন। সেটাই লিখলাম এই ব্লগে---

 -------------------------------------
মোবাইলটা পকেট থেকে বের করে একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্লাবে ঢুকলেন অমিত দা। যে অমিত দা অন্য দিনগুলোতে টিভি চ্যানেলে শুধু খবর চালাতে বলেন, তিনিই আজ বলবেন খেলাটা দিতে। তাও আবার যেমন তেমন নয় ক্রিকেট, ফুটবল ছেড়ে একেবারে সোজা অ্যাথালেটিক্স। অমিত দা নিজেই বললেন, কী সব আজেবাজে দেখছিস দে দে খেলাটা ঘোরা। আমরা বললাম, ক্রিকেট! সে তো কখন শেষ হয়ে গেছে। আর ফুটবলে তো বৃষ্টি। অমিত দা তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন, আরে না রে না, একটু দৌড়টা ঘোরা। বুঝে গেলাম আমাদের পাড়ার 'টেনিদা'(নিজেকে অবশ্য বলেন ফেলুদা) বেজিংয়ে বিশ্ব অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপের কথা বলছেন। যেমন আদেশ তেমন কাজ, চলছিল খবরের চ্যানেলে মাতৃভূমি ট্রেন নিয়ে মিনি যুদ্ধ দেখানো খবর, আর এখন চলে গেলাম সোজা বেজিংয়ের পাখির বাসায় দৌড়-ঝাঁপ-ছোঁড়া দেখতে।

টিভিতে তখন মহিলাদের ১০০ মিটার দৌড়ের ফাইনাল। মানে কিছুক্ষণ পরেই আমরা জানতে পারব বিশ্বের দ্রুততমা মহিলার নাম। দেখলাম অমিত দা একেবারে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। উত্তেজনায় অমিত দা বললেন, এবার দেখ আমাদের খেল। কথাটার আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারলাম না। তবে এটা বুঝলাম অমিত দা ভিতর ভিতর যাকে বলে একেবারে ফুটছে। একটু পরেই শুরু হবে দৌড়। অমিত দা বললেন, এই দেখ এই মেয়েটাই সোনা পাবে।  

আড়চোখে দেখলাম অমিত দা একবার মোবাইলের স্টপ ওয়াচের দিকে তাকাচ্ছে, আর একবার দেখছে টিভির দিকে। শুরু হল দৌড়। প্রায় চোখের নিমেষে দৌড় শেষ। অমিত দেখলাম হাততালি দিয়ে বলে উঠল, আরে ভাল করে সময়টা দেখ। কত সময় নিল মেয়েটা দৌড় শেষ করতে। আমি বললাম, প্রথম হওয়া জামাইকার শেলি-অ্যান ফ্রেজার-প্রাইস ১০০ মিটার দৌড় শেষ করল ১০.৭৬ সেকেন্ডে। সঙ্গে যোগ করে দিলাম সোনার হিসেবে দেখলে বোল্টকে ছুঁয়ে ফেলল শেলি। মানে ১০০ মিটারে অলিম্পিকে যেমন বোল্টের দুটো সোনা, দুটো বিশ্বসেরার পদক, ওর দেশের শেলিরও ঠিক তাই। কথাটা শুনেই রাগে একেবারে তেড়ে এল অমিত দা। বলল, এখানেই তোর সমস্যা। দু একটা ওয়েবসাইট ঘেঁটে কী সব লিখিস বলে সব কথাতেই তুই পদবি যোগ করে দিস। আমি বললাম, মেয়েটা ১০০ মিটার দৌড়তে কত সময় নিল? আর তুই তুলনা টেনে দিলি!

যাক তুলনাটা টানলিই যখন তখন বলি এই যে তোরা আমায় এত খুশি দেখছিস তার কারণটা ওখানেই। কবে থেকে চেঁচিয়ে আসছি, বলছি ওসব মেয়েদের সঙ্গে পুরুষদের তুলনা টানাই অপ্রাসঙ্গিক। জানিস তো আজও তো একেবারে দাঁতে দাঁত চেপে ফাইট দিয়ে এলাম। আমি শিয়ালদা-বনগাঁ লাইনের রোজ ডেলি প্যাসেঞ্জারি করি, আজও সেই মাতৃভূমি ঝামেলা। সুযোগ পেয়ে নেমে গেলাম লাইনে। কয়েকজনের সঙ্গে পেশি ফুলিয়ে বন্‌ধ করে দিলাম ট্রেন চলা। দু একটা ইঁটও ছুড়লাম পুলিসগুলোকে তাক করে।

অবরোধ-বিক্ষোভ-ভাঙচুর সব কিছুতে একেবারে সামনে থেকে লড়ে এলাম। আমাদের দাবি একটাই আরে বাবা, মাতৃভূমি হলে পিতৃভূমি হবে না কেন? মেয়েদের জন্য ট্রেন হবে, আর ছেলেরা বাদ যাবে কেন?  

আমরা তখনও বুঝিনি বেজিংয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের সঙ্গে শিয়ালদা-বনগাঁ লাইনের মাতৃভূমি যুদ্ধের কী সম্পর্ক। এবার খোলসা করল অমিত দা। অমিত দা বলল, জানিস আজ কী ঘটল। নিজের কানে শুনলাম গোবরডাঙা স্টেশনে আমার তিনটে ট্রেনের বন্ধুকে মাতৃভূমি লোকাল থেকে নামিয়ে দিয়েছে। কত বড় সাহস। আরে বাবা অফিস টাইমে সব ট্রেনে এত ভিড়, যদি মাতৃভূমিতে উঠেই পড়ল তাতে কী ওই মেয়েগুলোর গায়ে ফোসকা পড়ল!

এবার শোন তাহলে ব্যাপারটা। সপ্তাহখানেক আগে মাতৃভূমি নিয়ে একটা জাঁদরেল মহিলার সঙ্গে জোর ঝগড়া শুরু করলাম হাবরা স্টেশনে দাঁড়িয়ে। আমার একদম চোখাচোখা যুক্তি শুনে ভদ্রমহিলা তো একেবারে ক্লিন বোল্ড। তবে কী জানিস একটা জিনিসে বারবার হেরে যাচ্ছিলাম। আমি যত বলছিলাম ছেলেরা সবেতে মেয়েদের থেকে এগিয়ে, তেমনই মহিলা একেবারে গলা উঁচিয়ে প্রতিবাদ করে বলল, এগিয়ে তো আমরা, তোমরা শুধু আমাদের ফলো করো। আমি মুখের গোড়ায় কোনও হাতে গরম যুক্তি দিতে পারলাম না। এদিকে, তখন এলাকাটা ছেলে বনাম মেয়ে যুদ্ধে পুরো কুরুক্ষেত্র হয়ে আছে। সেদিনের ঘটনা তো জানিসই। ছেলে বনাম মেয়ে যুদ্ধ একেবারে সব পেপার, চ্যানেলে হেডলাইন হয়ে গেল।

জলের বোতল থেকে দু ঢোক গলায় দিয়ে আবার শুরু করল অমিত দা। মাঝেখানে ভুল ধরিয়ে বললাম, তুমি একবার বললে রোজ ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করো, কথাটা একেবারে ভুল, হয় ট্রেন সফর হয় তুমি রোজ করো না হয় ডেলি কর। হেসে অমিত দা বলল, সে ভাবেই বল, আজ কিন্তু আবার দেখিয়ে দিলাম। আমি রবিবার ভাল করে দেখেছি ১০০ মিটার দৌড় শেষ করতে বোল্ট নিয়েছিল ৯.৭৯ সেকেন্ড, আর আজ এই মেয়েটা নিল ১০.৭৬ সেকেন্ড। মানে প্রায় এক সেকেন্ড পিছিয়ে মেয়েরা। মানে ১০০ মিটার এক সেকেন্ড হলে, ১০ হাজার মিটারে ১০০ সেকেন্ড, মানে প্রায় ১ মিনিট ৪০ সেকেন্ড পিছিয়ে। তাগলে বুঝে দেখে যারা দেরীতে যায় তাদের সঙ্গে কী আর ফাইট দেবো।

বুঝলি তবু ফাইটটা ছাড়ব না। মাতৃভূমি হলে পিতৃভূমিও চাই। মেয়েরা ছেলেদের কলা দেখিয়ে ফাঁকা ট্রেনে চড়ে যাবে, আর আমরা আঙুল চষে দেখবো এটা হতে দেবো না।  

.