মোমো-চিত্তে

এ বিষয়ে মনে রাখা ভাল যে, মোমো বলতে এই অধম স্টিমড মোমোই বোঝে। আর তার মধ্যেও ভেজিটেবল মোমো দেখলে বলে ‘সাইডে বোসো’। মৌলবাদের অভিযোগ উঠতে বাধ্য। সে টুকু রিস্ক নিয়েও বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, মাংসের পুর ছাড়া মোমো হল মিছিল বাদ দিয়ে কলকাতা বা হ্যামলেটকে বাদ দিয়ে ডেনমার্কের রাজপুত্র; আর তেলেভাজা-রোল-প্রিয় বাঙালির হাতে পড়ে সেদ্ধ মোমোর ডালডা-লাঞ্ছিত চেহারা মেনে নেওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।

Updated By: Nov 7, 2011, 03:11 PM IST

ভোরের দার্জিলিং তখনো অর্ধেক ডুবে ঘুমজলে।
গুমগুম শব্দ করে টয় ট্রেনটা বাতাসিয়া লুপ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর কুয়াশাঘেরা ছোট্ট চত্বরটায় হঠাত্‍ দেখলাম এক নেপালি বুড়ি সামনে গোল স্টিলের মুখ বন্ধ একটা বড় পাত্র নিয়ে বসে আছেন। তাঁকে ঘিরে কিছু হাটুরে মানুষ। স্বাভাবিক কৌতূহলে বাবা, এবং তাঁর সঙ্গে পুঁচকি আমি এগিয়ে গেলাম কী ঘটছে দেখার জন্য। বুড়ি পাত্রের ঢাকনা তুলতে দেখা গেল ধোঁয়ার আস্তরণের মধ্যে সাদা সাদা পুলি পিঠে জাতীয় কিছু একটা জিনিস। শালপাতায় মুড়ে সে রকম কয়েকটা পুলি আর লালচে লঙ্কার দানাওয়ালা একটা সস, সঙ্গে ধোঁয়া ওঠা স্যুপের বাটি। জিনিসটা একবার চেখে দেখার জন্য বাবাও নিলেন এক প্লেট। ভাগ বসাতে গিয়ে কামড় দিয়েই বুঝলাম, এ সব জিনিস স্বর্গের দেবতাদের জন্যই তৈরি হয়ে থাকে মাঝে মাঝে। সালটা ১৯৯৩, আমার বয়স তখন দশ। আর আমার মোমো-প্রেমের সূত্রপাতও তখন থেকেই।

মোমো ইতিহাস সূত্রে চৈনিক খাবার। চিনা নাম জিয়াওজি। স্টার্টার হিসেবে 'ডিমসাম' বা এক কামড়ে কপ করে খেয়ে ফেলার জন্যই এর প্রসিদ্ধি। মোমো শব্দটা চিন থেকে ধার নিয়েছে নেপালিরা। এখন সারা বিশ্বে তিব্বতি ও নেপালি ডেলিকেসি হিসেবেই এর খ্যাতি। কলকাতায় মোমো প্রচার পেয়েছে বহু পরে। এখন অবশ্য পাড়ার মোড়ে রোলের সঙ্গে মোমোর হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। কলকাতার এলগিন রোডে পাশাপাশি তিনখানা দোকান: 'হামরো মোমো', 'মোমো প্লাজা' আর 'অর্কিড'। এদের মধ্যে হামরো মোমোই সম্ভবত সবথেকে পুরোনো। নব্বইয়ের গোড়ায় এর পত্তন। এদের পাশে রেখে এলগিন রোড পেরিয়ে চৌরঙ্গী রোড থেকে স্যাঁতস্যাঁতে গলি দিয়ে ভেতরে ঢুকে ‘টিবেটান ডিলাইটস’-এর কথা না বললে বড়সড় গুনাহ্ হয়ে যাবে! তিব্বতিরাই এই মোমো বিপণির কর্ণধার। এঁরা মোমোর সঙ্গে দেয় একটা উৎকট ঝাল সস। মোমোর বিশেষ সস শুনেছি চিনে টমেটো আর তিমুর নামে সেজওয়ান প্রদেশের এক কুখ্যাত ঝাল লঙ্কা জ্বাল দিয়ে তৈরি করা হত। ‘টিবেটিয়ান ডিলাইটস’-এর এই সসে যে ধানি লঙ্কার একটা বিশেষ ভূমিকা আছে সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। একটা নাম-না-জানা দোকান ছিল পূর্ণদাস রোডের দোতলা বাড়ির সিঁড়ির তলায়। প্রথম বার যাই ক্লাস ইলেভেনে, স্কুল পালিয়ে। এমন পকেটোপযোগী অথচ স্বাদ-সমুদ্রে ডুব মারার ঘটনা আমার জীবনে খুব একটা ঘটেনি। গতবার কলকাতা ফিরে দেখলাম সে দোকানের ঝাঁপ নেমে গিয়েছে, চিরতরে। আমার ইস্কুল জীবনে এটা একটা হারানো সুর হয়ে থাকবে।
এ সব ছাড়া রবীন্দ্র সদন স্টেশনের চারপাশে চারখানা স্টল আছে রাস্তার ওপরেই। আরেকটা আছে অ্যাকাডেমির সামনে, যাদের মোমো অতি উত্তম। তবে টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনে ঢোকার মুখে এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক আজকাল ডেকচি নিয়ে বসছেন। ওনার চিকেন মোমোয় কামড় বসিয়ে পুরটাকে জিভের ভেতর নিয়ে আলতো খেলালে মাঝে মাঝে মাথার ভেতর বাতাসিয়ার পাইন গাছগুলোর ঝাপটা এখনও পাওয়া যায়। তাঁর কাছ থেকেই জেনেছি, ওই অদ্ভুত স্যুপ তৈরির কলাকৌশল। কে বলবে চিকেনটাকে সেদ্ধ করার পর সেই জলেই বাঁধাকপি গাজর কাঁচালঙ্কা এবং কদাচিত্‍ ধনেপাতার টুকরো মিশিয়ে ফেলেই তৈরি করে ফেলা যায় ও জিনিস! শূন্য থেকে ব্রহ্মের উত্পত্তি বিষয়ে ভারতীয় দর্শনের যাবতীয় কুটকচালি হার মেনে যেতে বাধ্য চিকেনসেদ্ধ জল থেকে এমন ব্রহ্মভোগ্য স্যুপ তৈরির প্রক্রিয়ার কাছে।

এ বিষয়ে মনে রাখা ভাল যে, মোমো বলতে এই অধম স্টিমড মোমোই বোঝে। আর তার মধ্যেও ভেজিটেবল মোমো দেখলে বলে ‘সাইডে বোসো’। মৌলবাদের অভিযোগ উঠতে বাধ্য। সে টুকু রিস্ক নিয়েও বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, মাংসের পুর ছাড়া মোমো হল মিছিল বাদ দিয়ে কলকাতা বা হ্যামলেটকে বাদ দিয়ে ডেনমার্কের রাজপুত্র; আর তেলেভাজা-রোল-প্রিয় বাঙালির হাতে পড়ে সেদ্ধ মোমোর ডালডা-লাঞ্ছিত চেহারা মেনে নেওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আর সেদ্ধ মোমোকে স্বাদু করবার জন্যই তো স্যুপ! এক একবার কামড়ের সাথে সাথে চিকেন বা পর্কের পুরটাকে ভিজিয়ে দিতে হয় স্যুপের অতলে। দামও অন্যান্য খাবারের তুলনায় যথেষ্ট কম। পেট ভরানোর পক্ষে যথেষ্ট। সেই সঙ্গে কাঁচুমাচু মুখে আরেক বাটি স্যুপ চাইলে ভুরু না কুঁচকেই বিনা বাক্যব্যয়ে ভরে যায় বাটি। আর কী চাই?

এরপরেও কোনও না-লায়েক, বেরসিক মোমো নিয়ে অভিযোগ তুললে খোদাতালার দরবারে রোজ কেয়ামতের দিন তার যে ফুটন্ত তেলের কড়াইতে ভাজা হওয়া বাঁধা, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।

শময়িতা চক্রবর্তী

Tags:
.