প্রেসিডেন্সিতে হামলা রুখব কীভাবে

বর্তমান রাজ্য সরকার প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি বিশ্বমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করার প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছে। বিশ্বমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই রকম বর্বর হামলা এখন হয় না, সাত আট শো বছর আগে হত। বিশ্বমানের শিক্ষাবিদরা গবেষণাগারে বর্শা এবং লোহার রডের আস্ফালন দেখতে অভ্যস্ত নন। বিশ্বমানের ছাত্রীরা ক্যাম্পাসের মধ্যে বাইরের গুন্ডাদের থেকে ধর্ষণের হুমকি শোনেন না এবং ছাত্ররা ক্লাসের মধ্যে গুন্ডাদের মারে রক্তাক্ত হন না। ১০ এপ্রিলের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে প্রেসিডেন্সির পুনরুজ্জীবন উদ্যোগে বাধা পড়তে বাধ্য।

Updated By: Apr 11, 2013, 04:50 PM IST

প্রেসিডেন্সি কলেজের যে বেকার ল্যাবরেটরিতে তৃণমূল কংগ্রেসের পতাকা নিয়ে গুন্ডারা হামলা চালাল, সেটির ইতিহাসের সঙ্গে ভারতে বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাস সমার্থক। আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এবং প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিশের মতো মহাবিজ্ঞানীরা এই ল্যাবরেটরি থেকে পরাধীন ভারতে যথাক্রমে পদার্থবিজ্ঞান (পরে উদ্ভিদবিজ্ঞানও), রসায়ন এবং রাশিবিজ্ঞান চর্চার সূত্রপাত করেছিলেন। রাজনৈতিক পতাকাধারী গুন্ডাদের বিশেষ শিক্ষা দীক্ষা থাকার কথা নয়। তাই যিশুখ্রিষ্টকে যারা ক্রুশবিদ্ধ করেছিল, তাদের মতোই এদেরও জানার কথা নয় এরা কী করছে। জ্ঞানের যে মন্দিরে জুতো খুলে মাথা নিচু করে ঢোকা উচিত, সেখানে এরা ঢুকেছিল অস্ত্র হাতে রক্ত দর্শনের জিঘাংসা নিয়ে।

বর্তমান রাজ্য সরকার প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি বিশ্বমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করার প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছে। বিশ্বমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই রকম বর্বর হামলা এখন হয় না, সাত-আটশ বছর আগে হত। বিশ্বমানের শিক্ষাবিদরা গবেষণাগারে বর্শা এবং লোহার রডের আস্ফালন দেখতে অভ্যস্ত নন। বিশ্বমানের ছাত্রীরা ক্যাম্পাসের মধ্যে বাইরের গুন্ডাদের থেকে ধর্ষণের হুমকি শোনেন না এবং ছাত্ররা ক্লাসের মধ্যে গুন্ডাদের মারে রক্তাক্ত হন না। ১০ এপ্রিলের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে প্রেসিডেন্সির পুনরুজ্জীবন উদ্যোগে বাধা পড়তে বাধ্য।

এই হামলার পুনরাবৃত্তি বন্ধ হবে কীভাবে?

আমরা বলছি, একমাত্র উন্নত ছাত্র রাজনীতি, (ইংরেজিতে বলব enlightened student politics) পারে শিক্ষার উপর অশিক্ষিতর এই বর্বর যুক্তিহীন অর্থহীন হামলা বন্ধ করতে।

রাজনীতি-মুক্ত ক্যাম্পাসের কথা ইদানীং পশ্চিমবঙ্গে খুবই আলোচিত হচ্ছে। কিন্তু প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্য বেশ কয়েকটি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি কালে অশান্তির যে কয়টি ঘটনা ঘটেছে (হরিমোহন ঘোষ কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নকে কেন্দ্র করে এক পুলিশ কর্মীর হত্যা সহ) তার একটির জন্যও ভিন্ন রাজনৈতিক মনে বিশ্বাস করা দু দল ছাত্রর বিরোধ দায়ী নয়। দায়ী হল দুরভিসন্ধিপরায়ণ, বুদ্ধিহীন কিছু বৃদ্ধ জরদ্গবের ক্ষমতা দখলের কদাচারী লড়াই। তার জন্য ছাত্ররা তাঁদের ন্যায্য অধিকার - রাজনীতি করার অধিকার ছেড়ে দেবেন কেন?

আমরা বলছি:

(১) ভোটাধিকার অধিকার হয় ১৮ বছর বয়সে। ওটাই কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে ঢোকার বয়সও বটে। দেশের সরকার নির্বাচনে কারও রাজনৈতিক মতামত গণ্য করার যোগ্য হলে কলেজেও তা হওয়া উচিত।
(২) রাজনীতি মানেই দলীয় রাজনীতি হতে হবে কেন? ছাত্র সংগঠনগুলি ক্যাম্পাসের বাইরে রাজনৈতিক দলের শাখা মাত্র। এই সংগঠনগুলির নাম, পতাকা, প্রতীক যদি বাড়তি উত্তেজনা ও হিংসার কারণ হয় তবে তা বর্জন করার কথা ভাবা যেতেই পারে। এটা বর্তমান বাস্তবতায় আপত্কালীন সমাধান মাত্র, নির্মোহ যুক্তির বিচারে এ প্রস্তাব টিকবে না জেনেও বলা।
(৩) সান্ত্রীরা সকলে না বুঝলেও অন্তত মন্ত্রীদের ব্যাপক অর্থে রাজনীতির সঙ্গে সিপিআইএম-তৃণমূলের চুলোচুলির তফাত্ বুঝতে হবে। দ্বিতীয়টার কোনও জায়গা শিক্ষাঙ্গনে নেই। কিন্তু ব্যাপক অর্থে রাজনীতির ভাবনা বাদ দিয়ে জ্ঞানব্রহ্মাণ্ডের একটা সুবিশাল অংশে বিচরণ সম্ভবই নয়। একটা বৃহত্তর রাজনৈতিক ভাবনার প্রেক্ষাপট ছাড়া ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি এ সব বিষয়ের উচ্চতর চর্চা সম্ভব নয়। ছাত্ররা সেই রাজনীতির ভাবনায় দীক্ষিত হয়েও নিজেদের রোজকার জীবনে তার প্রয়োগ নিয়ে ভাববেন না, এটা অসম্ভব।
(৪) ভারতের রাজনীতিতে এবং প্রশাসনে কলঙ্কের শেষ নেই। কিন্তু তাত্ত্বিক বিচারে আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থাটি (polity) অতীব উত্কৃষ্ট। বহুত্ববাদী সমাজে নানা বিচারে সংখ্যালঘুদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা, অন্য মত পোষণ করেও অধিকাংশের মত মেনে নেওয়া, বিতর্ক এবং আলোচনার মাধ্যমেই কর্তব্য নির্ধারণ করা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভারসাম্য এবং নিরীক্ষার (check and balance) ব্যবহার - এ সবই শেখায় আমাদের সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থা। ছাত্রসমাজে, ক্যাম্পাসের এ সবের প্রয়োগ সকলেরও কাম্য হবে নিশ্চয়।
(৫) ছাত্রদের রাজনীতিতে আসা মানে শিক্ষায়, মেধায়, কর্মশক্তিতে সমাজের সেরা অংশটার রাজনীতিতে আসা। বর্তমান রাজনীতির হাল দেখে কেউই অস্বীকার করতে পারবেন না যে কিঞ্চিত্ বিদ্যা-বুদ্ধি, শিক্ষা-মেধা রাজনীতিতে এলে মন্দ হয় না!

এই রাজনীতিই পারে প্রেসিডেন্সিতে হামলার মতো ঘটনা বন্ধ করতে। এই রাজনীতিতে দীক্ষিত হলে লেখাপড়ার সংস্পর্শে আসা কেউই কখনও বেকার ল্যাবলেটরিতে অস্ত্র নিয়ে ঢুকবেনই না। বেঁচে যাবেন জগদীশ চন্দ্র বসু, পি সি রায়, প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিশ, সত্যেন বোস, মেঘনাদ সাহা। লাঠির বাড়ি মাথায় পড়ার ভয়ে না ভুগে লেখাপড়া করতে পারবেন আগামী দিনে যাঁরা জগদীশ চন্দ্র বসু, পি সি রায়, প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিশ, সত্যেন বোস, মেঘনাদ সাহা হবেন তাঁরাও।

সুদীপ্ত সেনগুপ্ত
(এডিটোরিয়াল কনসালট্যান্ট)

Tags:
.