সেদিন কি ‘হাজার চুরাশির মা’-এর কাছে এক হয়ে গিয়েছিল ব্রতী আর নবারুণ, নাম দুটো?
অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী
দূর থেকেই তিনি 'বাপ্পা'র কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলেন। খুব কাছে গিয়েও শেষ বারের জন্য ছেলের মুখটা দেখেননি তিনি। কিন্তু কেনও? আক্ষেপ ছিল শেষদিন পর্যন্ত। তবে, উত্তর ছিল না কোনও। শুধুই একটা বক্তব্য, বাধ্য হয়েই ছেড়ে আসতে হয়েছিল স্বামী ও ছেলেকে।
আজ, ২৮ জুলাই, চলে গেলেন মহাশ্বেতা দেবী। পড়ে রইল শুধু 'হাজার চুরাশির মা'-এর স্মৃতি। যেমন পড়ে রয়েছে 'ফ্যাতারু'-র 'মৃত্যু উপত্যকা'। অনেকেই এই লেখাটি পড়ে ভাবতে পারেন নবারুণ ভট্টাচার্য (ডাকনাম বাপ্পা) তো অনেক দিন আগেই মারা গেছেন। তাহলে আজ মহাশ্বেতা দেবীর মৃত্যুতে আবার তাঁকে নিয়ে টানাটানি কেনও? কারণ আছে। আর তাই লিখছি!
'হাজার চুরাশির মা'। কাহিনীর প্রেক্ষাপট গত শতাব্দীর ৭০-এর দশক। বিপ্লবের আগুনে জ্বলছে বাংলা। আর সেই আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে ময়দানে নামে ব্রতী। আন্দোলনের ময়দানে অনেকেই প্রাণ দিয়েছিলেন। যেমন দিয়েছিলেন ব্রতী। কিন্তু, কে এই ব্রতী? নাম ব্রতী চ্যাটার্জি। হাসপাতালের মর্গে পড়ে থাকা সেদিনের ১০৮৪ নম্বর ‘লাশ’টিই ছিল ব্রতীর। আর পুলিসের কথায় তাঁকে সেদিন শনাক্ত করেছিলেন তাঁর মা সুজাতা।
সেদিনের সেই নকশাল আন্দোলনে ছেলে হারা এক মায়ের আর্তনাদের কাহিনী নিয়েই মহাশ্বেতা দেবী লিখেছিলেন ‘হাজার চুরাশির মা’। সেই গল্প অবলম্বনে ১৯৯৮ সালে তৈরি হয় ‘হাজার চৌরাসি কা মা’ সিনেমাটি।
স্বামী বিখ্যাত নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে মতবিরোধের জেরে যৌবনেই তাঁকে ছেড়ে চলে এসেছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। সেই সময় ছেলে নবারুণের বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর। আর সেই যে মায়ের কাছ থেকে তাঁর দূরে সরে যাওয়া, আর কোনও দিন দেখা হয়নি তাঁদের। এমনকী হাসপাতালেও গিয়েও.... ছেলেকে শেষ দেখা দেখেননি তিনি। কিছুটা জেদ, কিছুটা অভিমান আবার কিছুটা জেনে বুঝেই নিজেকে সরিয়ে রাখার ইচ্ছে.... আচ্ছা, সেদিন কি ‘হাজার চুরাশির মা’-এর কাছে এক হয়ে গিয়েছিল ব্রতী আর নবারুণ, নাম দুটো?
ব্রতীর মতো নবারুণ ভট্টাচার্যও একদিন বিপ্লবের ডাকে সাড়া দিয়ে নেমেছিলেন আন্দোলনে। লিখেছিলেন ‘ফ্যাতারু’, ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’-এর মতো উপন্যাস। তাঁর কলম থেকে বেরিয়ে আসে ‘হার্বাট’-এর মতো জ্বালাময়ী উপন্যাসও।
লেখা পড়তেন ছেলের৷ ভালোওবাসতেন তাঁর জ্বলন্ত লেখনীকে৷ মা হয়ে নিজেকে ছেলের কাছ থেকে সরিয়ে রেখেছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। আর তার জন্য মনের গভীরে লুকিয়ে ছিল যন্ত্রণাও। আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন, "আই ওয়াজ ফোর্সড টু লিভ মাই সন৷"
আজ 'ফ্যাতাড়ু' নেই, নেই 'হাজার চুরাশির মা'-ও। এবার হয়তো সব মান-অভিমান হাসি-কান্নায় মুছে যাবে সেই স্বর্গের উদ্যানে। যেখানে 'ছেলে লিখবে... মা শুনবে... আবার মা লিখবে... ছেলে শুনবে...তৈরি হবে আবার কোনও এক অমরকথা।'