অব্যক্ত রিভিউ : বৃষ্টিধোয়া কবিতা যেন
শর্মিষ্ঠা গোস্বামী চট্টোপাধ্যায়
শর্মিষ্ঠা গোস্বামী চট্টোপাধ্যায়
পরিচালনা : অর্জুন দত্ত
অভিনয় : অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়, অনুভব কাঞ্জিলাল, কৌশিক ঘোষ, আদিল হোসেন, লিলি চক্রবর্তী, দেবযানী চট্টোপাধ্যায়, খেয়া চট্টোপাধ্যায়
সিনেমাটোগ্রাফি : সুপ্রতিম ভোল
সম্পাদনা : সুজয় দত্তরায়
সঙ্গীত পরিচালনা : সৌম্য ঋত
বছরের প্রথম প্রতিশ্রুতিমান ডেবিউ। পরিচালক অর্জুন দত্ত-র ছবি ‘অব্যক্ত’ মুক্তি পেল।মা- ছেলের সম্পর্কের টানাপোড়েন, কত না-বলা কথা আর অভিমানের জন্ম দেয়, তারই ছবি এঁকেছেন অর্জুন।
ছোটবেলা থেকেই মায়ের সঙ্গে দূরত্ব ইন্দ্র-র(অনুভব কাঞ্জিলাল)। দিল্লিতে কর্মসূত্রে থাকা ইন্দ্র পৈতৃক সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনি জটিলতা দূর করতে কলকাতা আসে। বাড়ি ঢুকেই সে খুঁজে পায় একটা ছোট্ট বাক্স। ঐ বাক্সেই আটকে আছে তার ছেলেবেলার স্মৃতি। সেই সব স্মৃতি যা থেকে সে সরে যেতে চেয়েছে, কিন্তু পারেনি। সেই স্মৃতিরা বারাবার ফিরে ফিরে এসেছে স্বপ্নে। তার হতে চাওয়া আর হয়ে ওঠার পিছনে সবথেকে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন মা, সাথী (অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়)। ছোটবেলার খেলনা-বাটি খেলতে চাওয়া, জন্মদিনে ডলস হাউস উপহার পাওয়া বা লুকিয়ে মায়ের শাড়ি পরে মেয়ে সাজার সব ইচ্ছেকে গলা টিপে মেরে দিয়েছেন মা। কারণ, তার লিঙ্গ পুরুষ। এমন কী বাবার বন্ধু রুদ্রকাকু (আদিল হোসেন), যাকে ইন্দ্র সবথেকে ভালবাসত, তাঁর সঙ্গেও যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় মায়ের জন্যই। তাই মায়ের উপর পুঞ্জীভূত অভিমান নিয়ে শহর ছাড়ে ইন্দ্র। ফিরতেও চায় না সে। অসুস্থ মার চিকিত্সা ও সম্পত্তি সংক্রান্ত সমস্যা মেটাতে বান্ধবী অদিতির (খেয়া চট্টোপাধ্যায়) চাপেই খানিকটা নিমরাজি হয়ে কলকাতা ফেরে ইন্দ্র। মা-ছেলের এমন এক টানাপোড়েনের গল্পই পরিচালক কবিতার মত এঁকেছেন পর্দায়।না-বলা কথার মাঝে বারবারই নেমেছে বৃষ্টি, বেজেছে মি়ঞা কি মল্লার, পুরনো দেরাজের খোপে আটকে থাকা বোবা শব্দেরা আঝোরধারায় ঝরেছে। সে বৃষ্টিতে ছাদে শুয়ে আকাশ দেখে ইন্দ্র, সাথী তানপুরা ছাড়েন, আর ফ্ল্যাশব্যাকে বাবা কৌশিক (অনির্বাণ ঘোষ) আর রুদ্রকাকুর-র
নিজেদের স্বীকার-অস্বীকারের দোলাচল চোখের জলে ভিজতে থাকে। পরিচালকের মুন্সিয়ানা সেখানেই।
প্রথমবারের পরিচালক অর্জুন দত্ত একটা কমপ্লেক্স গল্পকে খুব সহজে বলেছেন। তার একটা ভাল দিক হল, দর্শক একটা নিটোল গল্প দেখতে পাবেন। আবার উল্টোদিক হল, গল্পের ফর্ম নিয়ে খেলার প্রচুর সুয়োগ থাকলেও, সে পথে হাঁটেননি অর্জুন।তাই পরের ছবি থেকে অর্জুনের কাছে ফর্ম ও কন্টেন্টের যুগলবন্দি দেখার প্রত্যাশা রইল।
বৃষ্টির দৃশ্যগুলো খুব ভাল শুট করা হলেও এই ছবির সিনেমাটোগ্রাফি আরও ভাল হতে পারত। পরিচালক বেশ কিছু দৃশ্যে তাঁর পূর্বসূরীদের দেখানো পথে হেঁটেছেন। ‘কাঁদালে তুমি মোরে’ গানের দৃশ্যায়ন অপর্ণা সেনের ‘পারমিতার একদিন’ ছবির গানকে মনে করাবেই। তাকে অতিক্রম করতে পারলেন না সিনেমাটোগ্রাফার সুপ্রতিম ভোল। আরও একটা কথা, অর্পিতা চট্টোপাধ্যায় নিজেই খুব ভাল গান গাইতে পারেন, সেখানে তাঁর প্লেব্যাকে জয়তী চক্রবর্তীকে কেন ব্যবহার করা হল, তা বোঝা গেল না। যদিও ছবির স্বপ্নের সিকোয়েন্স, স্লো-মোশন ব্যবহার বিচ্ছিন্নভাবে ভাল লাগা তৈরি করে। বরং সম্পাদনায় সুজয় দত্ত রায় ছবির নির্মাণকে মেদহীন করেছেন অনেকটাই।
অভিনয়ে অর্পিতা চট্টোপাধ্যায় সাথীর প্রত্যেকটা আবেগ-অনুষঙ্গকে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিরিশের কোঠার অর্পিতাকে দেখে ছবি থেকে চোখ সরানো যায় না। বয়সের সঙ্গে সঙ্গেই আরও তীক্ষ্ণ হয়েছে তাঁর অভিনয়। অর্পিতার ছেলে ইন্দ্র-র চরিত্রে অনুভব কাঞ্জিলাল নতুন অভিনেতা। ছবিটি মুক্তি পেতেও দু বছর লাগল। এরমধ্যে অনুভবের পরের ছবি ‘সহবাসে’ ফেস্টিভাল সার্কিটে ঘুরছে। অভিনেতা হিসাবে ধীরে ধীরে পোক্ত হচ্ছেন অনুভব। এই ছবিতেও অর্পিতার পাশে তাঁকে কিছু দৃশ্যে একটু দুর্বল লেগেছে টিকই, কিন্তু তাঁর স্ক্রিন প্রেজেন্স, আয়ত চোখের ব্যবহার বাংলা ছবিতে নতুন এক নায়কের উপস্থিতি টের পাওয়ায়।মা-ছেলে ছাড়া আর যিনি চোখ টানেন, তিনি রুদ্রকাকুর চরিত্রে আদিল হোসেন। ছবির শেষে তাঁর একটি মনোলগে তিনি দর্শকের হৃদয় জয় করবেনই। বিশেষত, ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যে এমন টুইস্ট রেখেছেন পরিচালক, যা আদিলের চরিত্রকে আরও জোরদার করেছে।
সবমিলিয়ে অব্যক্ত মনের কোণের সেই পর্দা দূর করবে, যা আমরা জানি বটে, মানতে পারি না। তেমন গল্প নিয়ে হাজির পরিচালককে দুহাত মেলে স্বাগত। আশা জাগালেন, তাকিয়ে রইলাম আপনার পরের ছবি ‘গুলদস্তা’র দিকে। অল দ্য বেস্ট, অর্জুন।