দোষ কার?

ছবির নাম- অ্যাক্সিডেন্টপরিচালক-নন্দিতা রায়, শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়অভিনয়ে- শিবপ্রসাদ, দেবশঙ্কর, রুদ্রনীল, সম্পূর্ণা, কাঞ্চনা, খরাজ, সব্যসাচীরেটিং- ***1/2

Updated By: Oct 3, 2012, 02:55 PM IST

শর্মিলা মাইতি

ছবির নাম- অ্যাক্সিডেন্ট
পরিচালক-নন্দিতা রায়, শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়
অভিনয়ে- শিবপ্রসাদ, দেবশঙ্কর, রুদ্রনীল, সম্পূর্ণা, কাঞ্চনা, খরাজ, সব্যসাচী
রেটিং- ***1/2

আপনার বাড়ির ছাদ থেকে, হাইরাইজের উপরতলা থেকে এই কলকাতাকে দেখে মনে হয়েছে, এই পড়ি-কী-মরি করে দৌড়নো শহর, পিঁপড়ের সারির মতো বাস-ট্যাক্সি-অটো, গিজগিজে মানুষ কখনও কখনও নিজের প্রাণ, অন্যের প্রাণেরও পরোয়া করে না! মৃত্যু এসে দলা পাকিয়ে যায় সংখ্যায়। অ্যাক্সিডেন্ট শব্দটা প্রতিদিন কাগজের পাতায় অবহেলায় এড়িয়ে যাই, সামনে দেখলে শিউরে উঠি, প্রাণপণ চেষ্টা করি সুখস্মৃতির প্রলেপে ভুলিয়ে দিতে। চায়ের কাপে তুফান তোলে, কফির কাপে ডুবে যায় আমাদের বল্গাহীন বাগযুদ্ধ। সত্যি বলুন তো, কজন জ্বলে উঠি, সংঘবদ্ধ হই, গর্জে উঠি? যে উদগ্র প্রতিবাদ নিয়ে মানুষ মিছিলে সামিল হয়ে বলে, ‘চলছে না চলবে না’, সেই একইরকম তীব্রতায় আমরা কজন বলতে পারি যে, ‘শাস্তি চাই, বাঁচতে চাই’?
মোটামুটি শহুরে দর্শক বেশ কবছর ধরে যে-সব মশলা হুসহাস করে গিলছেন, সে মশলা এখানে নেই। এই পরিচালক জুটির সবচেয়ে প্রথমে সাবাসি প্রাপ্য এখানেই যে, দর্শক খাবে কি না, সেই বুঝে রান্নার মশলাপাতি কেনেননি। খাওয়া-না-খাওয়ার বিষয়টা যে দর্শকের একান্ত ব্যক্তিগত, ফর্মুলার ছকবদ্ধ নয়, সেটা বেশ জোর দিয়েই বিশ্বাস করেন তাঁরা। এই বিশ্বাস নিয়েই তাঁরা ইচ্ছে বানিয়েছিলেন। মুক্তধারা বানিয়েছিলেন। এবং একই নিঃশ্বাসে তাঁরা এটাও মানেন, দর্শকই ভাল ছবির নির্মাতা ও নির্বাচক। এঁদের তিন নম্বর ছবি দেখে মনে হল, সিনেমাকে আসলে এঁরা যে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছেন, সেটা দর্শকের একটা না-বলতে পারা, গুমরে থাকা আবেগের অভিব্যক্তি। সোজা ভাষায়, এঁরা মনে করেন, সিনেমা পরিচালকের নিজস্ব ভাবনার কারিকুরি আর উত্কর্ষ প্রকাশের জায়গা নয়। সেখানে দর্শকও অংশগ্রাহক হতে পারেন, নায়কও হয়ে যেতে পারেন। সামাজিক সমস্যা নিয়ে ইদানিং ছবি আর বিশেষ তৈরি-টৈরি হয় না। হলেও তা শিক্ষামূলক ক্যাটাগরির। কারণ, বহু আধুনিক পরিচালকই আমি-আমার-মতো। মনে করেন ছবির মধ্যে মেসেজ দিতেই হবে এমন দাসখত লিখে আসেননি তাঁরা। মতপার্থক্য হলে অন্য নন্দ ঘোষ (মানে প্রোডিউসার) খোজেন, কিন্তু নিজের ছবি বানানো থেকে পিছু
হটেন না। এই দুই পরিচালক উদারমনস্ক। ছবি যে নিজের থেকে অনেক বেশি তাদেরই, যারা সমস্যাজর্জর, যারা পালাবার পথ খুঁজছেন, কিন্তু যে পথটি নিশ্চিতভাবে উদ্দেশ্যসফল করতে পারে সেইটি চেনেন না। অ্যাক্সিডেন্ট-এর পরিচালকেরা সেই উপায়টাই বাতলেছেন। সরল বোধগম্য ভাষায়। অল্পবয়স্ক দম্পতির একরত্তি ছেলের হঠাত্ বাস অ্যাক্সিডেন্ট ওলটপালট করে দেয় স্বপ্নের দুনিয়াকে। দায়ী কে? ট্রাফিক-না-মানা পথচারী না বেপরোয়া ড্রাইভার? বাসমালিকের না বাসের? আইনের না বাস-কোম্পানির? ঠিক এটাকেই টেক-অফ পয়েন্ট ধরে সমাজের দূষণের বিভিন্ন স্তরে প্রবেশ করেছেন গল্পকার-পরিচালক। একটা দুর্ঘটনাকে ‘নিছক’ হয়ে বিস্মৃতির গভীরে হারিয়ে যেতে না দিয়ে, সেই পেছনের গল্পটাকে সামনে এনে মেলে ধরলেন দুঃসাহসী দুই পরিচালক। অ্যাক্সিডেন্টের মতো মারণসমস্যার ‘সমাধান’কে টুঁটি টিপে রেখেই যে খাদ্য-খাদক সমাজের প্রতিটি স্তরের নির্বিঘ্ন বসবাস, একটু বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিবাদ আর কয়েকটি মেলানো হাত নিয়েই এই সব দূষিত মানুষদের মাথা নুইয়ে দেওয়া যায়, সেটাই দেখালেন এঁরা। এই প্রতিবাদের ছোট্ট দুনিয়ায় অনায়াসে কাঁধ মেলাতে পারে অসহায় ড্রাইভার (রুদ্রনীল ঘোষ)যে জানত বাসটার ব্রেক খারাপ ছিল, সন্তানহারা বাবা (শিবপ্রসাদ)
যার ছোট্ট ছেলে ট্রাফিক নিয়ম মেনেও বাসের নিচে চাপা পড়েছে আর লিগ্যাল ইনভেস্টিগেটর (দেবপ্রসাদ), অ্যাক্সিডেন্টের প্রত্যক্ষদর্শী। সংখ্যাটা তিন থেকে বাড়তে থাকে এক্সপোনেনশিয়াল সিরিজের মতো, বহু বাধাবিঘ্ন, লজ্জা, অপমান, শাসানি আর মারধর উপেক্ষা করে।

ছোটবেলা থেকে জানি, অন্যকে বোঝাতে গেলে আগে নিজে বুঝতে হয়। কাজেই, রিসার্চের ব্যাপারে ফাঁকিবাজি করেননি। গোটা গল্পে কোনও জোড়তাপ্পি নেই। ফ্ল্যাশব্যাক নামমাত্র এবং নিতান্ত প্রয়োজনে ব্যবহৃত। কী-হয়-কী-হয় উত্তেজনা টেনে রাখতে পেরেছেন। বারফাট্টাই করেননি। সত্যি বলতে কী, অনেক কিছুই আমরা জানি না। আমাদের আপনজনের দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে কী কী করা উচিত, কোথায় যাওয়া উচিত। ছেলের অস্থি ভাসিয়ে আসার পর নিজের বাড়ি ঢুকতেই বাবা শিবপ্রসাদের ওপর হামলে পড়ে ইনশিওরেন্স এজেন্টরা। বড় বড় অঙ্কের লোভনীয় অফার দিতে থাকে। কিংবা জানতাম না, দোষটা যদি যান্ত্রিক হয়, তাহলে কীভাবে ফল্টি বাসের হিসেব বের করে আনা যায় যন্ত্রের সাহায্য নিয়েই। অনেক কিছুই শিখিয়ে চোখ খুলে দিলেন এঁরা।
প্রত্যেকের অভিনয় অসামান্য। চিত্রনাট্যে চলতি ভাষার ব্যবহার তাকলাগানো। ড্রাইভারের নিজস্ব ভোক্যাবুলারি বেশ সাহসের সঙ্গে ব্যবহৃত। ফিল্ম যখন লক্ষ্যপূরণের রাস্তায় হাঁটে, তখন আবেগের ফুয়েল অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু কোনও এক অদৃশ্য লাগামে সেটা কখনও মাত্রা ছাড়ায়নি। তবে মিডিয়ায় প্রচারের টিভি-দৃশ্য অনাবশ্যক বড়। হাস্যকর প্যারডি মনে হয়। কিংবা বাস-কোম্পানির মালিক ড. গুরজারির সঙ্গে গল্ফ ক্লাবে কথোপকথনের দৃশ্যও একটু স্মার্ট করা যেত। কাটছাঁট করা যেতে পারত শেষের দিকের পেপার কাটিং-এর এডিট টেবল শটগুলো। গল্পটা যখন বলা হয়েই গিয়েছে।
সমাজের বিরুদ্ধে একা লড়াই করে জেতা। ব্যক্তির কাছে সমষ্টির পরাজয়। একা যেটা পারা যায় না, সেটাই একা একা করে দেখানো। এটাই অ্যাক্সিডেন্ট। তেমন অ্যাক্সিডেন্ট না ঘটলে নন্দিতা-শিবপ্রসাদের তৃতীয় ছবির সাকসেস মন্ত্র একটাই। কথায় নয়, টেকনিক-মিউজিকে নয়, ‘কাজে’ করে দেখানো।

.