আঁতলা-আমি আর আমার গালাগাল-দেওয়া গার্লফ্রেন্ডস
কী সব সেন্সর-টেন্সর ভুলবকুনির জেরে হপ্তাদুই শখ করে বানানো প্রিপারেশনটা রেফ্রিজারেটরে রাখতে হয়েছিল পরিচালক মৈনাককে। সেসব ভুলভাল ফাঁড়া কেটেও গেল। মামুলি ডগাছাঁটা ছাড়া মামণিদের অ্যাকটিভিটিজে দাঁত বসাতে পারেনি সেন্সর বোর্ডের দাদুভাইরা। এই গরম বাজারে গরমাগরম পরিবেশন করতেই ঢাকনা খুলেছিলেন পরিচালক। খোলা রোদ্দুরে, ঠান্ডায়-গরমে দেড় দিনেই পচে টকগন্ধ বেরুচ্ছে।
শর্মিলা মাইতি
ছবির নাম- আমি আর আমার গার্লফ্রেন্ডস
রেটিং- *
কী সব সেন্সর-টেন্সর ভুলবকুনির জেরে হপ্তাদুই শখ করে বানানো প্রিপারেশনটা রেফ্রিজারেটরে রাখতে হয়েছিল পরিচালক মৈনাককে। সেসব ভুলভাল ফাঁড়া কেটেও গেল। মামুলি ডগাছাঁটা ছাড়া মামণিদের অ্যাকটিভিটিজে দাঁত বসাতে পারেনি সেন্সর বোর্ডের দাদুভাইরা। এই গরম বাজারে গরমাগরম পরিবেশন করতেই ঢাকনা খুলেছিলেন পরিচালক। খোলা রোদ্দুরে, ঠান্ডায়-গরমে দেড় দিনেই পচে টকগন্ধ বেরুচ্ছে। বিশ্বাস করুন, টিকিট-পাই-কি-না-পাই দোনোমনায় কাউন্টারে হাত গলাতেই মিলে গেল। ঢুকে দেখি মাত্র দেড়দিনের রিলিজে, রবিবারের বাজারে দর্শকসংখ্যা সাকুল্যে উনত্রিশ! রাশি রাশি প্রি-রিলিজ পাবলিসিটি চ্যাট, খবরকাগজের সাপ্লিমেন্টে তিন গার্লফ্রেন্ডের চোখ-ছানাবড়া-করা ছবি, শেষ পাতে সেন্সর-চাটনি-- অত করেও এই!
রিভিউ করতে এসে অত উন্নাসিক হলে চলে না। পথের পাঁচালীও প্রথমটা দর্শক দেখতেই চায়নি। ইন ফ্যাক্ট, আঁতলামির বাইবেলে তো লেখাই আছে, ভাল জিনিস লোকে দেখতে চায় না। সিনেমার মতো চলমান মিডিয়ামে সব সময়েই নূতনের আবাহন। মায় কিংবদন্তিকেও জীর্ণ-পুরাতনজ্ঞানে দূর-দূর করা হয় আকছার।
বাংলা ছবিতে গালাগাল এখন বেশ গর্বের ব্যাপার। গালিয়াঁ-র সঙ্গে তালিয়াঁ সমানুপাতিক। আবার সুন্দরীরা ঠোঁট ফাঁক করে গালি পাড়ছেন দেখলে তো হাততালির বন্যা বয়ে যাবে, হরির লুঠের মতো টিকিট বিক্রি হবে, এমনটাই নাকি ট্রেন্ড। রবিবারের বাস্তবচিত্রটা তাতে তালে তাল মেলালো না। ছুটির দিনের দামী টিকিট উশুল না হওয়ার বিরক্তিতে ইন্টারভ্যালেই দর্শকসংখ্যাটা উনত্রিশ থেকে পঁচিশ হয়ে গেল।
অথচ এমনটা কথা ছিল না। প্রথম দৃশ্যেই পরিচালক ঝটকা দিয়ে সিটবেল্ট বাঁধার ওয়ার্নিং দিয়েছিলেন। ক্যামেরা-চোখের সমনেই তিন গার্লফ্রেন্ডের একজন ভরন্ত পাছু দিয়ে জিন্স টেনে ঢোকাতে পারছেন না। এক্সট্রিম ক্লোজ-আপে বুটিদার প্যান্টি পরা সুবৃহত্ পশ্চাদ্দেশের ধাক্কাধাক্কি, মুখ দিয়ে অকারণ তেড়ে গালাগালি, যা নর্ম্যালি মেয়েরা নিজেদের মধ্যেও অন্য কনটেক্সটে ব্যবহার করে থাকেন। শরীর মেলে ধরার কী হাঁকপাঁক কসরত! তাতে অবশ্য দোষের কিছু নেই। রক্ত-মাংস-হাড়-মজ্জা-যকৃত-প্লীহা-মিউকাস সম্বলিত এবড়োখেবড়ো একটা স্ট্রাকচারে ভগবান এমন সুন্দর করে মসৃণ চামড়া দিয়ে ঢেকেছেন যখন... অনেকেই বলে গিয়েছেন, নারী তার কতটা দেখাবে তা একান্তই নিজের ব্যাপার। এর মধ্যে আর যাই কৃতিত্ব থাক, সাহসিকতা আছে বললে অপমান করা হবে। পরিচালকও বলছেন, ইটস আ গার্লস ওয়ার্ল্ড, সরি বয়েজ! কাজেই, ছবি দেখার আগে এটাই বিশ্বাস ছিল শরীর হোক বা মস্তিষ্ক, লড়াইয়ে আসলে জিতবে নারী!
তিনজন গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে তিনি যে স্টোরি লাইনটা বাছলেন, তাতে কিন্তু কেউই পুরুষের সাহায্য ছাড়া কোনও এফেকটিভ কাজই করতে পারেন না। একমাত্র নিজেদের মধ্যে গালাগাল, পটি করা, বমি করা, কফি শপে কারণহীন আড্ডা, স্বল্পবসনা হয়ে সমুদ্রের ধারে দৌড়নো, ছাদে বসে মদে চুর হয়ে থাকা ছাড়া। মানে যে সব কাজগুলো নেহাতই টাইম-কিলিং, আনপ্রোডাকটিভ সেগুলোই নিজেরা করে। যে-গার্লফ্রেন্ডটি স্কুলটিচার সে গালাগালিতে তুখড়। ঢুলুঢুলু, ঢিসঢিসে শরীর আর এক পেট অতৃপ্ত যৌন-খিদে নিয়ে সংসার করে চলে। স্কুলে পড়িয়েও অগাধ সময় পায় কফি-শপে বসে থাকার, কী উপায়ে সে প্রশ্ন করার সিনেমাটিক লাইসেন্স নেই। সে-ও প্রেগন্যান্ট হয়ে মাতৃত্বের স্বাদ নেয় তার ষোল বছরের স্কুলবয়-ফ্রেন্ডের কাছ থেকে।
এতে নারীর লিবারেশনের কী এল-গেল, তা নেহাত ফুটনোট না থাকলে বোঝা অসম্ভব। দ্বিতীয় গার্লফ্রেন্ডটি প্রথম নভেল লিখেছেন তাঁর প্রথম ব্রেক-আপের ওপরে। বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে যে তার জীবন থেকে পালিয়েছিল। এই চরিত্র মাথায় অনেকগুলো বিনুনি করে উইগ পরে। ইচ্ছে হলেই জার্নালিস্টদের অপমান করে, ডিপ্রেশনে ভুগতে থাকা মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যায়, সদ্যযৌবনার-প্রেমে-মজে-যাওয়া বাবার মতি ফেরানোর চেষ্টা করে। আপাতদৃষ্টিতে দায়িত্বশীল এই তরুণীও কিন্তু পুরুষের কাছে এলেই অবলা নারী হয়ে যায়! সাত বছর আগে ডিচ-করা বয়ফ্রেন্ডের কাছেও গলে আইসক্রিম! এবং সে ভুল ভাঙার পরেও ল্যাপটপে ইন্টারনেট মারফত যে অদেখা পুরুষের প্রেমে সে পড়ে, তাতেও কোনও যুদ্ধ জয়ের গন্ধ পাওয়া যায় না।
বাকি রইল তিন নম্বর গার্লফ্রেন্ড। স্বভাবকৌতূহলে এক পুরুষ থেকে অন্য পুরুষে ডেটিং করে বেড়ায়, ডিচ করলে কান্নায় ভেঙে পড়ে যে-কোনও কমনীয় কমন নারীর মতোই। অদ্ভুত পোশাক-আসাক পরে। নিরীহ মা বিয়ের কথা বললে বাড়ি থেকে চলে যাবে বলে শাসায়। আল্টিমেটলি এই মেয়েটিরও মাথার ঘিলু থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত মেকওভারের দায়িত্ব যে নিচ্ছে সে-ও আদতে তার পুরুষবন্ধু। তিনজনের কাহিনি খুব শর্টে বললাম এই কারণেই যে, কোনও খানেই নারী তার কোনওকিছু দিয়েই পুরুষের প্রতিপত্তিকে খর্ব করতে পারেনি। শরীর দিয়েও নয়। গল্পটা যেভাবেই বলতে চান না কেন পরিচালক, মোদ্দা দাবিটা পাখির হাড়ের মতো হাওয়া-ভরা ফাঁপা মনে হচ্ছে।
প্রশ্ন করবেন, আমিটা কে? একমাত্র এই নামকরণের ক্ষেত্রেই পরিচালক আঁতলা-আমি করেছেন। আমি আসলে তিনজনের প্রত্যেকেই, বাকি দুজন পারমুটেশন কম্বিনেশনে পরস্পরের গার্লফ্রেন্ড। তবে এই ওয়ার্ল্ডে বয়ফ্রেন্ড আর হাজব্যান্ডরা কিন্তু বেশ ইন্টারেস্টিং। ম্যাক্সিমাম হাততালি আর হাসির ফোয়ারা সেখানেই উঠছে। তিন ইয়ারি কথার পর নীলকে আবার অন্যরকম অভিনয়ে দেখে ভাল লাগল। স্কুলড্রেসে অনুব্রতর অভিনয়েও বেড়েপাকামিটা বেশ স্পষ্ট। মজা পাওয়া যাবে ডাক্তারের চরিত্র কিংবা পার্ণোর একাধিক ডেট-বয়ফ্রেন্ডের চরিত্রগুলোকেও। ফ্রেশ লেগেছে বিক্রমকেও। দারুণ অভিনয় করেছেন বিশ্বনাথ বসুও। পুরুষের পৃথিবীর এই ফান এলিমেন্টগুলো মিস করলে গোটা ছবিটাই বোরিং লাগবে।
আগেই যেকথাটা বলছিলাম, গালাগালি প্রদান আধুনিক সিনেমার নাকি একটা ওয়েলকাম ট্রেন্ড। কিন্তু এছবির কেন্দ্রীয় মহিলামহলের কেউই, গালাগালিটা আসলে কেউই ক্লিয়ার ডিকশনে দিতে পারছেন না। বড় বেপ্ল্যান, বেটাইম আর খাপছাড়া। কখনও উচ্চমার্গের ক্লাস-কনশাস স্ল্যাং কখনও বস্তির পাশের নর্দমা হয়ে গিয়েছে। স্কুল-কলেজ লাইফে আমরা মেয়েরাও নিজেদের মতো করে গালাগালি দিয়ে ভূত তাড়িয়েছি। ন্যাকামিকে জানালা দিয়ে ভাগিয়ে দিয়েও, কোথাও যেন নিজেদের লাগাম টেনে রাখতে পেরেছি। অন্তত শেষ দৃশ্যে ঘুমন্ত মাঝির উদ্দেশ্যে স্কুলটিচার গার্লফ্রেন্ডটি যে অশালীন, ক্লাসলেস ও কুরুচিকর মন্তব্য করেন, তাকে নেহাত গালাগালি বলে মাপ করে দেওয়া যায় না!
তিনজনের মধ্যে পার্নোকে বেশ প্রমিসিং মনে হয়েছে। কমিক টাইমিং রিহার্সাল ভালই। রাইমা তুলনায় একটু অভিব্যক্তিহীন। তবুও মানানসই। স্বস্তিকার চরিত্রটাই এদের মধ্যে সবচেয়ে গালি-প্রবণ ও সিনেমার পোশাকি ভাষায় ‘ইনহিবিশন ফ্রি’। অভিনয় আর অ্যাকসেন্ট, দুটোর ব্যাপারেই অনেক বেশি মনোযোগ দাবি করে এই চরিত্র। আদতে ইনি স্কিন-শো ছাড়া আর বিশেষ কোনও প্রস্তুতিই নেননি দেখে অবাক লাগে! বহু নায়িকার দৃষ্টান্ত মিলবে যাঁরা জীবনের শেষ অধ্যায়ে এসে চারপাশে জড়িয়ে রাখা হেঁয়ালির আবরণ উন্মোচন করতে থাকেন অনন্যোপায় হয়ে। মুশকিল হল, এত খোলামেলার পরেও যে-জন্যে অত কিছু সেই দর্শকই যদি মুখ ফিরিয়ে নেন, তাহলে লাভটা কী?
লাভ কার কী জানি না, ক্ষতিটা দর্শকের। আজকালের ছবির প্রোমোশনের সময়ে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে কিছু ভাল-রে-ভাল ক্লাব মেম্বারদের দেখা মেলে। এ ওর পিঠ চাপড়ে বলেন আহা কী ভাল। কাগজে সমালোচকের বদলে তাঁরাই অকুণ্ঠ প্রশংসা করে দেন যাতে তাঁর নিজের ছবিটার প্রশংসা করবার সময়ে লোকের অভাব না হয়। আদ্যন্ত সারগর্ভহীন ছবিও এঁদেরই মিউচুয়াল বদান্যতায় ক্ষণিকের জন্য কিংবদন্তি হয়ে ওঠে। দর্শকও সেসব পড়ে হলে এসে হতাশ হন। চিট ফান্ডে লগ্নির থেকে কিছু কম ক্ষতিকারক নয় এই ব্যবস্থাটা!
যিনি আমাদের মহিলাদের বেপরোয়া পৃথিবীটা দেখাতে চাইলেন আর পুরুষদের বললেন দুঃখিত, তাঁকেই বলি- পর্দার বাইরে আসুন, তাকিয়ে দেখুন। বাস্তবের আধুনিকারা আরও অনেক শক্তপোক্ত। ন্যাকামির ধার-না-ধেরে নিজেদের পৃথিবী সম্পর্কে অনেক বেশি সজাগ। আগেও ছিলেন এখনও আছেন। নতুন করে লিবারেশনের মন্ত্র জপতে হলে নতুন কিছু করার সাহস দেখান। মেয়েদের পৃথিবীতে অযথা খোঁচাখুঁচি করে হাস্যাস্পদ করে তুলবেন না।