ব্লাইন্ড অপেরা মানে বেঁচে থাকা, ব্লাইন্ড অপেরা মানে জেগে থাকা
২৫শে বৈশাখে পাড়ার নাটকের মহড়ায় তাঁকে রাখা হত `এলেবেলে`। প্রতিবন্ধী হওয়াটাই একমাত্র প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায় অভিনয়ের ইচ্ছে পূরণের ক্ষেত্রে।
২৫শে বৈশাখে পাড়ার নাটকের মহড়ায় তাঁকে রাখা হত `এলেবেলে`। প্রতিবন্ধী হওয়াটাই একমাত্র প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায় অভিনয়ের ইচ্ছে পূরণের ক্ষেত্রে। কিন্তু হার না মানা জেদ কীভাবে যেন তাঁকে এনে দাঁড় করিয়ে দিল স্পটলাইটের আলোয়। কমল কাঞ্জিলাল। শ্যামবাজার ব্লাইন্ড অপেরায় দীর্ঘ ২০ বছর ধরে অভিনয় করে চলেছেন। ব্লাইন্ড অপেরার সাবাই হয়তো কেউ সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন কেউবা আবার আংশিক দৃষ্টিবান। কিন্তু মঞ্চে ওরা সবাই ততটাই সাবলীল। কোনও বাধাই যেন বাধ সাধে না ওদের কাছে। কমল কাঞ্জিলাল মানতে রাজি নন দৃষ্টি না থকাটা আদপেও কোনও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। তাঁর কথায়, "দেখতে না পারাটা বাস্তব ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা বটে। কিন্তু আমরা যখন বাস্তবের উর্ধে উঠে অভিনয় করি তখন নয়"।
সেট তৈরি থেকে প্রপস, মেকাআপ থেকে কসটিউম, নিজেরাই ভাগ করে নিয়েছন সব কাজটা। কমলের আশা একদিন ওরা আলোর কাজও করতে পারবেন। কমলের ব্যাখ্যা, "কাজগুলো করতে গিয়ে যেটা দেখার দরকার হয়, সেটা মনের চোখেই দেখেনি আমরা"। এভাবেই একের পর এক মঞ্চসফল অভিনয় করে চলেছে ব্লাইন্ড অপেরা। দৃষ্টি না থাকলেও অন্য ইন্দ্রিয়গুলো সচল রেখেই অভিনয় করেন অভিনেতারা। যখন একসঙ্গে একাধিক অভিনেতা মঞ্চে, তখন শব্দের উৎস খেয়াল করে অভিনয় করতে হয় তাদের। উষ্ণতা অনুভব করে আলোর সামনে দাঁড়াতে শেখা। নির্দেশ থাকে পা মেপে চলারও। ভয় থাকে হঠাত করে অন্ধকারে চলে যাওয়ার কিংবা মঞ্চের বাইরে চলে আসার। মঞ্চের চার ধারে ফেলে রাখা দড়ি কাজ করে সীমারেখা হিসাবে। সবার মনে একইসঙ্গে কাজ করে দাপিয়ে অভিনয় করার তাগিদ। আর পাঁচটা প্রসেনিয়াম থিয়েটেরের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জেদ। কমল বলেন, "এখন আমি প্রায় অন্ধ। সতর্ক থাকতে হয় যেন সেটে ধাক্কা না লেগে যায়। হঠাত যেন অন্ধকার জোনে চলে না যাই"।
১৯৯৬ সালে পথ চলা শুরু দলটার। অশোক প্রামাণিক, অধ্যাপক প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় ও দেবাশীষ চৌধুরী কলকাতা অন্ধ বিদ্যালয়ের শতবর্ষে কয়েক জন ছেলে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে নাটক করেন। মূলত স্বপ্ন দেখতে শেখান তাঁদের। গড়ে তোলেন ব্লাইন্ড অপেরা। ছিল অসফল হওয়ার ভয়। তারপর কেটে গিয়েছে এতগুলো বছর। হার মানা তো দূরস্থ, ২০০০ সালে দৃষ্টিহীন অভিনেতাদের অভিনীত `মনসা মঙ্গল` পশ্চিমবঙ্গের শ্রেষ্ঠ প্রযোজনার পুরস্কার পায়। দলের পরিচালক ও রূপকার আশোক প্রমাণিক বলেন, "ব্লাইন্ড অপেরার সকলেই দৃষ্টিহীন। এটা খুব অবাক করে। নাটকে দৃষ্টিহীনরা সেভাবে সুযোগ পায় না"। তাই সৃষ্টিশীল কাজে তাঁদের একজোট করার ভাবনা থেকেই ওদের অভিনয় করানো হয় বলে জনান তিনি।
কীভাবে রিহার্সাল করান ওদের? অশোক বাবু জানালেন, "ওরা যেহেতু দেখতে পায় না, তাই স্পর্শ আর শব্দের ওপর জোর দিয়ে কাজ করতে হয়"। রসদ একটাই, অক্লান্ত পরিশ্রম। নেই প্রযোজক। নেই টেলিভিশনের খ্যতনামা অভিনেতা। নেই পর্যাপ্ত রিহার্সাল রুম। এতগুলো না এর মাঝে রয়েছে শুধুই লড়াই করার ক্ষমতা। হালফিলের অভিনয়ে সৌন্দর্যের যতই ইঁদুর দৌড় চলুক না কেন, প্রতিবদ্ধী কতোগুলো ভাঙাচোরা শরীর হাসিখুশি মুখে অভিনয় করে চলেছে গ্রুপ থিয়েটারের সবকটা ব্যাকরণ মেনে।