‘পরীক্ষা’-য় ডিসটিংশন কোয়েলের, পরিচালকের মার শেষ রাতে
শর্মিলা মাইতি ছবির নাম: চার রেটিং: ***
শর্মিলা মাইতি
ছবির নাম: চার
রেটিং: ***
এক দুই তিন চার পা এগিয়ে ফিনিশিং লাইনে পৌঁছে যাওয়ার ছবি। শেষ হওয়ার পরেও, চারটে ছবির মধ্যে কোনও একটা সুতো খুঁজে পাবেন না হয়ত। তবু একটা টিকিট কেটে চারটে ছবি দেখার আনন্দ কম কিছু নয়। বাংলা সাহিত্য ভাণ্ডার ছেঁকে নিয়ে যে চারটি দুর্লভ মণি সংগ্রহ করা হয়েছে, তাতেও বইয়ের পাতার ঘ্রাণ আরও একবার প্রাণভরে নেওয়ার বাসনা জাগে। ইচ্ছে হয়, পাড়ার লাইব্রেরিতে গিয়ে আরও একবার খুঁজে দেখি। খুঁড়ে দেখি কৈশোরের সত্যজিত্, যৌবনের শরদিন্দুকে..
এক
ভাগ্যিস পরশুরাম বলে এক স্বনামধন্য লেখক জন্মেছিলেন এ বাংলায়। মুচকি হাসি ও অট্টহাসির এমন রসভাণ্ডার না হলে পাওয়া যেতই বা কোথায়? কোনখানে? লেখকের কলমে এমন ভবিতব্য কে-ই বা দেখাতে পারে। একটা সময় ছিল দ্বিপ্রাহরিক নভেল পড়ার যুগ। রন্ধন ও ভোজন-পরিবেশন পর্ব সেরে, পড়ন্ত বেলায় পালঙ্কে গা এলিয়ে কত রমণীর দুপুর গড়িয়েছে বিখ্যাত সাহিত্যিকের ছোটগল্প-নভেলে চোখ ডুবিয়ে। বাস্তবতা পেরিয়ে কল্পনার আশ্চর্য রাজ্যের নায়িকা হওয়ার অনুশীলন। বিখ্যাত লেখকেরা কখন মনের অন্দরে ফাগুনমাস হয়ে ওঠেন। বটেশ্বর তেমনই এক বরেণ্য লেখক। তাঁর কল্পরাজ্যে অনায়াসে ঢুকে পড়েন পাঠক। তাতেই বি়ড়ম্বনার একশেষ। পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এই চরিত্রে তাঁর অভিজ্ঞতার সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে নিয়েছেন অভিনয়কে। ভাল লাগবে শাশ্বত, শ্রীলেখা ও শুভ্রজিতের অভিনয়ও। কিন্তু ক্লাইম্যাক্স যে চমক দাবি করে, সেই সিনেমাটিক লাইসেন্স জোগাড় করে উঠতে পারেননি পরিচালক। ভয়েই হোক, বা নির্ভয়ে।
দুই
বটেশ্বরের অবদান কাহিনিটি নাকি পরিচালকের বাবা সত্যজিত্ রায়ের প্রিয় গল্পের অন্যতম ছিল। দুই বন্ধু গল্পটিতে একটু ঝকঝকে আধুনিক চেহারা দিয়েছেন পুত্র সন্দীপ। পীযূষ ও রজতাভ, দুজনেই অভিজ্ঞ অভিনেতা। তাই দুই বন্ধু হিসেবে তাদের রসায়ন কোথাও কমতি হয়নি। সুদীপ্তার চরিত্রটিতে সামান্য সংলাপ অতিরিক্ত যোগ হয়েছে, ছবির প্রয়োজনেই। তবে স্কুল লাইফে যে দুই বন্ধুকে দেখি, তাদের অভিনয়ে আরও বেশি অনুশীলন প্রয়োজন ছিল। প্রয়োজন ছিল আরও ভাল সংলাপের। অনেকটাই প্রাণহীন মনে হয়েছে এদের কথোপকথনের জায়গাটা। তবুও গল্প এগিয়েছে আপন গতিতে। কিছুটা পাঠক-দর্শকের চেনা কাহিনির ওপর ভর করে। আর তাই, বেশ সটান ঘুড়ির মতোই উড়েছে দ্বিধাহীনভাবে।
তিন
কাগতাড়ুয়া গল্পটি সত্যজিত্ রায়ের অনন্য সৃষ্টি, এমনটা বলা যায় না। কিন্তু গল্পের মধ্যে একটি ক্ষুদ্র বিবেক হঠাত্ই জেগে ওঠে হাতুড়ির ঘা দেয়। সন্দীপ রায় এখানে বাবার পদাঙ্কই অনুসরণ করেছেন। সাহিত্য থেকে খুব বেশি ব্যতিক্রমী হয়ে ওঠার চেষ্টা করেননি। মোবাইল বাদে আধুনিকীকরণের কোনও ছাপ নেই। অথচ একটি নিস্তব্ধতার দৃশ্যে বহু সুযোগ ছিল এক্সপেরিমেন্টেশনের। সেটুকু আসলে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের অনবদ্য অভিনয়ের গুণে উত্রে গিয়েছে। দর্শকের বিচারের জন্য দ্বার খোলা রইল। কাগতাড়ুয়ার মাধ্যমে যে পরাবাস্তবতার জাল মেলেছেন পরিচালক, সেটা তাঁদের কতখানি মনোগ্রাহী হয়, জানার আগ্রহ রইল।
চার
শেষ গল্পটি যদি দারুণ হয়, তবে সেটিই মুছে দেয় সব খুঁত। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরীক্ষা গল্পটি তাই অভিনেতা, পরিচালক ও ক্যামেরাম্যান, সকলের কাছেই ছিল চরম পরীক্ষা। অপূর্ব ক্যামেরাওয়ার্ক এ গল্পকে বইয়ের পাতা থেকে বহু দূর উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন। কিন্তু সব্বাইকে ছেড়ে, এবং সব সমালোচককে অবাক করে যিনি সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে আগে পৌঁছে গেলেন, তিনি কোয়েল মল্লিক। চেহারায়, চলনে-বলনে শরদিন্দুর সেই নায়িকা যেন বাস্তবের আঙিনায় পা রেখেছেন। প্রতিটি সংলাপে কী আশ্চর্য ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তুললেন, সে ভোলার নয়। আবিরের অ্যাপিয়ারেন্স যথাযথ। ছবির এই পর্বে এসে কস্টিউমে অনেক বেশি বৈচিত্র এসেছে। ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট এনেছে নস্ট্যালজিয়ার সৌরভ। সৌন্দর্য মিলেমিশে গিয়েছে বইয়ের পাতায়। শরদিন্দু নিজে স্ক্রিপ্ট লিখতেন। কাজেই এ কাহিনি যাঁরা পড়েছেন তাঁরা মানসচক্ষে ফিল্মটিও প্রত্যক্ষ করে নিতে পারতেন। এই পর্বে অবশ্য এক্কেবারে শেষ শটে নিজের সই দিয়েছেন পরিচালক। জীবন্ত, প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে এই কাহিনি। ঠিক কীভাবে সই করলেন, সেটা সমালোচক হিসেবে প্রকাশ করা অনুচিত। তবে এটুকুই বলতে পারি, ওস্তাদের মার শেষ রাতে-র প্রবাদটির সার্থক রূপায়ন করেছেন পরিচালক। তাঁর
আশ্চর্য আবিষ্কার কোয়েল মল্লিকের মাধ্যমে।