না-নারীর কাহিনি
ফি-হপ্তা এত এত ফিল্ম রিলিজ! কোনটা দেখবেন, কেন দেখবেন, কী দেখবেন? বক্স অফিসে টিকিট কাটার আগে এক্সক্লুসিভ অ্যান্ড সুপারফাস্ট রিভিউ পড়ে নিজেই জেনেবুঝে নিন। হলি-বলি-টলি ছবির চুলচেরা বিচার করছেন ২৪ ঘণ্টার প্রতিনিধি শর্মিলা মাইতি
ফি-হপ্তা এত এত ফিল্ম রিলিজ! কোনটা দেখবেন, কেন দেখবেন, কী দেখবেন? বক্স
অফিসে টিকিট কাটার আগে এক্সক্লুসিভ অ্যান্ড সুপারফাস্ট রিভিউ পড়ে নিজেই
জেনেবুঝে নিন। হলি-বলি-টলি ছবির চুলচেরা বিচার করছেন ২৪ ঘণ্টার প্রতিনিধি
শর্মিলা মাইতি
ছবির নাম: চিত্রাঙ্গদা- দ্য ক্রাউনিং উইশ
পরিচালক/লেখক: ঋতুপর্ণ ঘোষ
অভিনয়ে: ঋতুপর্ণ ঘোষ, যিশু সেনগুপ্ত, রাইমা সেন, সঞ্জয় নাগ, দীপঙ্কর দে, অনসূয়া মজুমদার
রেটিং: 8/10
মনে পড়ল, স্কুল কলেজে রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপনের সময়ে এই বিশেষ নৃত্যনাট্যটি সচরাচর এড়িয়েই যাওয়া হত। মণিপুররাজের কন্যা চিত্রাঙ্গদা-র কুরূপা সত্তার চরিত্র কোনও মেয়েই ঠিক স্বেচ্ছায় রাজি হতো না। ফলত, কালিঝুলি মাখিয়ে যথাসম্ভব লাবণ্যহীন করা হত চিত্রাঙ্গদাকে। সেই ধূসরবর্ণের চিত্রাঙ্গদা নাচতেন-গুরু গুরু গুরু গুরু ঘন মেঘ গরজে... সেকেন্ড হাফ-এ তাড়াতাড়ি গ্রিনরুমে মেক-আপ তুলে, চোখমুখ এঁকে সুরূপার সাজে চিত্রাঙ্গদা স্টেজে হাজির।
অর্জুন যখন সুরূপা চিত্রাঙ্গদাকে ‘হেরিয়া’ প্রেমে পড়লেন, তখনও বুঝিনি, পুরুষালি থেকে মেয়েলি হওয়ার পেছনে রাষ্ট্র, সমাজ এবং লিঙ্গ-সম্পর্কিত ‘সংস্কারের’ মিলিত রাজনীতি কতটা ক্রিয়াশীল। বাবার ইচ্ছেয় একটি মেয়ের পুরুষ হয়ে বেড়ে ওঠা, আবার পুরুষদর্শনে প্রেমে পড়ার পর নারী হওয়ার ইচ্ছে, নারীত্বে পরিপূর্ণ হয়ে পুরুষের বক্ষলগ্না হওয়া, এর আগে কখনও এত বড় ‘কেন’-র জায়গা তৈরি করেনি। পরিচালকের ভাষায়, ক্রাউনিং উইশ। ‘আমি’র ভিতর থেকে গোপন এক ‘তুমি’-কে আবিষ্কার। সেই আমি-তুমির প্রেম ও সংঘাতের গুরুভার প্রাণপণ চেপে রেখে বেড়ে রুদ্র এমনই এক মানুষ, যাকে দেখে আড়ালে হাসাহাসি করা হয় প্রায়শঃ। যার সামাজিক নাম এফেমিনেট। গোঁফ-দাড়িরহিত মুখ তবু শরীর আদ্যন্ত পুরুষের, হাবেভাবে মেয়েলিপনা, কণ্ঠস্বরে নারীসুলভ আহ্লাদেপনার ছোঁয়া। অসম্ভব প্রতিভাবান, সৃষ্টিশীল। নাট্যদলের চরিত্রচিত্রণের মহড়ার সময়ে একেবারে ঢুকে যান চিত্রাঙ্গদার চরিত্রে। বাস্তব ও কাহিনি একই সমতলে একাকার হয়ে যায়। ‘অন্যরকম’ হওয়ার দুর্ভাগ্যে ও বিড়ম্বনায়, সন্তানের "স্বভাব` না-বুঝতে-চাওয়া বাবার (দীপঙ্কর দে) সঙ্গেও এক পৃথিবী দূরত্ব। জন্মদাত্রী মায়ের কাছেও তাঁর খোকন মাঝেমাঝেই এক বিস্ময়। কোল আলো করে আসা, জন্ম থেকে বড় করা সেই ছোট্ট ছেলেটি, নিজের লিঙ্গকে অস্বীকার করতে চাইছে! মা হিসেবে এ তো বিরাট পরাজয়! অনসূয়া মজুমদারের সংযত অভিব্যক্তি চমকে দেয়। রুদ্রর একাকী জীবনের সঙ্গী হতে চায় পার্থ। ঝড়ের মতো উদয় যার। হেরোইনের নেশাচ্ছন্ন, পারকাশনিস্ট। ভিনজগতে ভাসমান, প্রায় বায়বীয় এক চরিত্র। বিরক্তি, হতাশা, আবেগের টানাপোড়েনের পর এই ‘পুরুষ’ পার্থর প্রেমে পড়েন রুদ্র। প্রেম সার্থক করার জন্যই তিনি ‘আরোপিত’ পুরুষ পরিচয় থেকে স্তন-জরায়ু-যোনি-সমন্বিত সম্পূর্ণ নারী হতে চান। নারীর মতো ধারণ করতে চান পার্থর সন্তান।
পরিচালকের নিজস্ব বক্তব্য অনুসারে, আরেকটি প্রেমের গল্প, মেমরিজ ইন মার্চ এবং চিত্রাঙ্গদা বিষয়-ভাবনায় ট্রিলজি। চিত্রাঙ্গদায় এসে বিষয়টি সত্যিই এত তুঙ্গস্পর্শী যে, আগের দুটি ছবির প্রসঙ্গ আর টানছি না। বিরল ক্যামেরার কাজ, প্রখর এডিটিং-এর মেলবন্ধন আসলে স্ক্রিন জুড়ে তৈরি করে এক আশ্চর্য জগত। প্রপস এর যথাযথ ব্যবহার, মাঝেমাঝে স্থিরদৃশ্যকেও প্রাণদান করে। নার্সিংহোমের বেডে রুদ্রর পাশে, বিশ্বখ্যাত চিত্রকর মাতিজের আত্মজীবনী, কিংবা পার্থর উপহার সূর্যমূর্তি, আপাতভাবে ইনার্ট অবজেক্ট হয়েও চরিত্র হয়ে ওঠে কখনও কখনও।
সেক্স চেঞ্জ বিষয়টি এখনও এ দেশের দর্শকের কাছে কষ্টকল্পনা। তিস্তা দাসের মতো গুটিকয় বাস্তব উদাহরণ হয়ত আছে। কিন্তু সমাজ এ বিষয়ে অতখানি অনুসন্ধিত্সু নয়। নাক-সিঁটকানিটাই বেশি। কিন্তু ঋতুপর্ণ বিষয়টি উপস্থাপন করলেন অবিশ্বাস্য দক্ষতায়। অস্ত্রোপচারের জটিল তথ্য এবং দুর্বোধ্য সব মেডিক্যাল টার্মসের উল্লেখ করলেন, কিন্তু শর্মিলা বিশ্বাসের তত্ত্বাবধানে অসাধারণ কোরিয়োগ্রাফির নান্দনিকতায় ভাসিয়ে দিলেন কাগজের নৌকোর মতো অনায়াসে। জন্মাবধি চাপিয়ে-দেওয়া পুরুষসত্তাকে ফুঁড়ে উঠতে চাইছে নারীসত্তার আকাঙ্ক্ষা। ভ্রূণ থেকে শরীর হওয়ার সম্ভাবনায় ছটফট করছে। সূর্য ভেবে ত্রসরেণুর আলোক-অণুকণার দিকেই দৌড়ে যেতে চাইছে। ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্টের পোস্ট-অপারেশন যন্ত্রণার ভাষা ততক্ষণে বুঝেছেন দর্শক। চোখে জল আসতে শুরু করেছে পর্দার চরিত্র রুদ্রর জন্য।
অঞ্জন দত্তের স্বভাবসুলভ স্মার্ট অভিনয়। পরিচালক-অভিনেতা হওয়ার ম্যাচিয়োরিটি তাঁর অভিনয়ে খুব স্পষ্ট। নার্সিং হোমে কাউন্সেলর হিসেবে আসেন তিনি। আসলে আসেন না। ইনি শয্যাশায়ী রুদ্রর মানসসঙ্গী। যার প্রতীক্ষায় ছিল রুদ্রর অন্তরের নারী, শুধু অবয়বের সন্ধানে ছিল। এই ‘তুমি’-কে যে খুঁজে পেতে চেয়েছিল নেশাগ্রস্ত পার্থর মধ্যে। কিছুটা হয়ত রোহিতের বন্ধুত্বে (সঞ্জয় নাগ)। কিন্তু পার্থ আকৃষ্ট ছিল রুদ্রর অন্য সব গুণে। তাচ্ছিল্যভরে প্রত্যাখ্যান করেছিল তার অপূর্ণ, অস্ত্রোপচারিত নারী শরীরকে। যৌন-সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল স্বাভাবিক নারীশরীর কস্তুরীর সঙ্গে। কস্তুরী রুদ্রর নাটকের গ্রুপের চিত্রাঙ্গদা(রাইমা সেন)। বাস্তবে কেরিয়ারমনস্ক আধুনিকা। আনওয়ান্টেড প্রেগনেন্সির দায়ভার নিতে চায় না। অতি অল্প স্ক্রিন-প্রেজেন্স-এও চরিত্রটি আশ্চর্যভাবে পূর্ণবৃত্ত। একই সঙ্গে উল্লেখ্য মালার চরিত্রটিও (অপরাজিতা আঢ্য)। নারী হয়ে সামাজিক ও সাংসারিক দায়িত্ব পালনেই মগ্ন থেকেছে সে। রুদ্রর অন্তরের নারীসত্তাকে যে অন্তর দিয়ে অনুভব করতে পারে। জিজ্ঞাসা করে, "ও (পার্থ) তোমাকে সংসার দিতে পারবে? তোমাকে বুঝবে?"
প্রতিটি চরিত্রই অতলস্পর্শী এবং সম্পূর্ণ। ঋতুপর্ণর মতো পরিণতমনস্ক পরিচালকের দক্ষতায় জীবন্ত। শেষ দিকে রুদ্রর অন্তর্দ্বন্দ্ব আত্ম উন্মোচনের পথে চলতে শুরু করে। অপারেশন থিয়েটারে‘ক্রাউনিং উইশ’ নিয়েই চোখ বোজে আনাস্থেসিয়াচ্ছন্ন রুদ্র। জন্মদাতা ও জন্মদাত্রীর নিবিড় আশ্রয়ে ফিরে আসার বাসনা নিয়ে। নতুন পরিচয়ে। দর্শকের কাছে এ এক অধরা প্রশ্নের সমাধান। যে-প্রশ্ন করতে আমাদের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়। জন্মাবধি জেনে আসা পরিচয় নিয়েই বেঁচে থাকতে হয়।
ছবি শেষ হওয়ার সঙ্গেসঙ্গে একটা কথা মনে হল। আপাতভাবে অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। বাজারচলতি বিজ্ঞাপনের হোর্ডিংগুলো ভেসে উঠল চোখে। ভগবানদত্ত চেহারায় সুখী না হলে শল্যচিকিত্সকের ছুরিকাঁচির কারিকুরিতে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠার যে এত এত হাতছানি...এমনও দিন কি আসবে যেদিন ইচ্ছানুসারে অপারেশনের নিজের যৌন-পরিচয় পরিবর্তন করবেন বহু বহু নরনারী? সেদিন কী কাল্ট ফিল্মের মর্যাদা পাবে এই ছবি?
জানা নেই। তবে সম্ভাবনা উজ্জ্বল। কারণ চিত্রাঙ্গদার দিকনির্দেশক তীরচিহ্ন যে আরও এক প্রজন্ম পরের দর্শকের দিকেই।