চিরস্মরণীয় মধ্যরাত, ভবিষ্যতের ক্লাসিক
কলকাতা বইমেলায় সাহিত্যসভায় আসতে পারেননি মিডনাইটস চিলড্রেন বইয়ের স্রষ্টা। ফায়ার, ওয়াটার বা আর্থ- কোনও একটি ছবিও সহজ স্বাভাবিক মুক্তির স্বাদ চেখে দেখেনি এ ছবির পরিচালক। স্বাধীনতার মধ্যরাতে ভূমিষ্ঠ হওয়া সন্তানদের মতোই কি অসম্ভবের সম্ভাবনায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেল এঁদের ভাগ্যও? ঠিক কোথা থেকে এ ছবির সমালোচনা শুরু করব ঠিক করে উঠিনি এখনও। কারণ, এ ছবি দেখার জন্য ষষ্ঠতম ইন্দ্রিয়টিও সজাগ রাখতে হয়।
শর্মিলা মাইতি
ছবির নাম: মিডনাইট`স চিলড্রেন
রেটিং: *****
কলকাতা বইমেলায় সাহিত্যসভায় আসতে পারেননি মিডনাইটস চিলড্রেন বইয়ের স্রষ্টা। ফায়ার, ওয়াটার বা আর্থ- কোনও একটি ছবিও সহজ স্বাভাবিক মুক্তির স্বাদ চেখে দেখেনি এ ছবির পরিচালক। স্বাধীনতার মধ্যরাতে ভূমিষ্ঠ হওয়া সন্তানদের মতোই কি অসম্ভবের সম্ভাবনায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেল এঁদের ভাগ্যও? ঠিক কোথা থেকে এ ছবির সমালোচনা শুরু করব ঠিক করে উঠিনি এখনও। কারণ, এ ছবি দেখার জন্য ষষ্ঠতম ইন্দ্রিয়টিও সজাগ রাখতে হয়। সলমন রুশদির বইয়ের অক্ষর ভেঙেচুরে ওমন সাবলীল, চূড়ান্ত গতিশীল রাজনীতি-আবেগ-ভালবাসা-অত্যাচার-আশ্রিত প্রশ্নময়তাকে চৌকোণা পর্দায় মেলে ধরার অতিমানবীয় প্রচেষ্টা দীপা মেহতার। শুধু ক্যামেরার চোখ দিয়ে তিনি দেখেননি সলমন রুশদির বহুচর্চিত বইটিকে। রিডিং বিটউইন দ্য লাইনস বলে ইংরেজিতে যে শব্দবন্ধ আছে, সেই ভাষাকেই তিনি শব্দ ফুঁড়ে বের করে আনলেন চিত্রনাট্যে। ফল? কোনও ক্রিটিক্যাল আলেখ্য নয়, নয় কোনও তীক্ষ্ণ ভাষণ, ভারতবর্ষের স্বাধীনতার মধ্যরাতের মাহেন্দ্রক্ষণে জন্মানো সেই শিশুগুলির উড়তে পুড়তে থাকা জীবন স্ফুলিঙ্গ আমাদের সম্মোহিত করে রাখল দু-ঘণ্টা পনের মিনিটের জন্য...
১৯৪৭ সালের ১৪ই অগস্ট মধ্যরাত। অবিভক্ত ভারত জুড়ে দুশো বছরের ইংরেজ শাসনের পর, বহু বিপ্লব-গুলি-বন্দুক-হিংস্রতার বিনিময়ে আসা স্বাধীনতা। যাদের লড়াইয়ের মূল্যে এল স্বাধীনতা, তারা তো উলুখাগড়া হয়েই রয়ে গেল। স্বাধীন হল ধনীজনেরা। এই ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতেই একটা পরিহাসপর্ব হয়ে গেল হাসপাতালের লেবার ওয়ার্ডে। খ্রীষ্টান নার্সের হাত দিয়ে বদল হয়ে গেল ইংরেজের জারজ সদ্যোজাত সন্তানের সঙ্গে সম্ভ্রান্ত মুসলিম ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান। বিধাতা যার কপালে লিখেছিলেন নির্বিঘ্ন সুখ ও বিলাস-ব্যসনের আখ্যান, ধর্মের নিষ্ঠুর হস্তক্ষেপ তাকে ঠেলে দিল অনিশ্চয়তাপূর্ণ, দুঃখভারাক্রান্ত এক জীবনের অভিমুখে। ঘটনাটিকে কি আরও বৃহত্তর রূপকার্থে দেখা যেতে পারে? একটা নিশ্চয়তায় ভরা পিরামিড সেই জারজ সন্তানের নামাঙ্কন হয়, সেলিম সিনাই (সত্য ভাবা)। ভিখিরি গায়কের সন্তানের নাম হয় শিবা (সিদ্ধার্থ)।
জাতীয় পতাকা উত্তোলনের পর ভারতের সবচেয়ে বিশালাকার প্রশ্নচিহ্ন ছিল, "এ স্বাধীনতা লইয়া কী করিব`? লেখক রুশদির লেখনী থেকে এখানেই টেক অফ করে পরিচালক দীপা মেহতার ক্যামেরা আই। ম্যাজিক রিয়্যালিজমের কী অসামান্য উপস্থাপনা! বাইরে যখন হিন্দু মুসলিম প্রবল দ্বন্দ্ব, হিংসার বিষ ছড়িয়ে পড়ছে দেশের আনাচে-কানাচে, ঠিক তখনই স্বাধীনতার মধ্যরাতের সন্তানেরা একত্র হয়, সেলিমের অতীন্দ্রিয় ঘ্রাণশক্তির আবাহনে, তারই বন্ধ ঘরে। এই সন্তানেরা, যাদের শরীর রয়েছে দূরদূরান্তে, শুধু জন্মক্ষণ দিয়ে অদৃশ্য অথচ প্রবলভাবে বিদ্যমান কোনও স্মৃতিসূত্রে আবদ্ধ। যে স্মৃতি আমাদের চোখের সামনে শুধুই ম্যাজিক রিয়্যালিজমের দুয়ার খোলে না।খুলে দেয় মিডনাইটস চিলড্রেনদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দরজাগুলোও। রাষ্ট্রযন্ত্র যাদের বার বার চাপা দিতে চেয়েছে। নায়ক সেলিম শুধু কেন্দ্রীয় চরিত্র নয়, কেন্দ্রীয় জীবন। যে জীবনটা আসলে এক পৃথিবী বিপন্নতাকে আশ্রয় দিয়েছে নিজের আত্মায়।
To understand just one life, you need to swallow the whole world. বলেছেন সলমন রুশদি, তাঁর বইতে। দীপার ক্যামেরা সেই শিশুগুলির জীবনের পিছনে হাঁটতে ইতিহাসের প্রতিটি মোড় বাঁক পেরিয়ে আসে। জাতি ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য সমান স্বাধীনতা বন্টন প্রক্রিয়া হয়নি কোনও চুক্তিতে। কোনও স্থায়ী সমাধান হয়নি দেশকালসীমানার। ধর্মের গোঁড়ামির কুচক্রী হস্তক্ষেপ আরও, আরও ভেদ-বিভেদের লড়াইয়ের জন্ম দেয়। সেলিম ততই হতে থাকে ইতিহাসের পুতুল.. নিজের অস্তিত্বের সংগ্রামের পাশাপাশিই সে লড়তে থাকে মুক্তিযুদ্ধ। যে মুক্তির সমার্থ, অজস্র বিপ্লবীর রক্ত, অজস্র নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে পাওয়া কাঁটাতার সীমানামাত্র। যে মুক্তি সে কামনা করে সে মুক্তি সত্য, কিন্তু বাস্তব নয়। এমনই এক চরম সময়, যেখানে সত্য আর বাস্তব পরস্পরবিরোধী। প্রায় ভাগ্য বদল হওয়া দুটি স্বাধীনতার মধ্যরাতে জন্মানো শিশুর মতো। এই অনুসন্ধানই সর্বশেষে পৌঁছে দেয় তার ধাই-মায়ের কাছে। যে মা তাঁকে গর্ভধারণ করেছিলেন, তিনি নন। যে মা তাঁকে লালন করেছিলেন, তিনিও নন। যিনি তাঁর ভাগ্যের লিখন বদলে দিয়েছিলেন তিনি। আরও দূর তার্কিক বিশ্লেষণে, এই নির্বাচন কোথাও যেন সংযুক্ত করে এই মধ্যরাতের মহারথীদের। দেশমাতৃকার সঙ্গে। এই আত্মপরিচয় তাকে এগিয়ে দেয় বাবা হতে। তাঁর প্রেমিকা পার্বতী (শ্রিয়া শরণ) ও শিবা, দুই মিডনাইট`স চিলড্রেন-এর বাবা হতে।
ইতিহাস বার বার ছুঁয়ে যাচ্ছে বাস্তব, বাস্তব বার বার কড়া নাড়ছে ম্যাজিক রিয়্যালিজমের স্তরে। কোথাও যেন সুদূরপ্রসারী হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করতে চাইছে হিন্দু পৌরাণিক আখ্যানকেও। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আনন্দ শোভাযাত্রায় সেলিম চাক্ষুষ দেখে নৃত্যরতা পার্বতীকে। পার্বতী হিন্দুদেবী দুর্গার অপর নাম। আঘাতে রক্তাক্ত হাত বাড়িয়ে দেয় পার্বতীর দিকে। জন্ম থেকেই যার সঙ্গে মানস-আলাপন। তার মিলন লাগি আসছে কবে থেকে... যেসব মানুষ অর্থনৈতিক স্তরের সবচেয়ে প্রান্তিক, তারা বিশ্বাসকেই সুরক্ষাকবচের মতো আঁকড়ে থাকে। ক্যামেরার যে কারিকুরি আমরা দেখলাম, তাকেও উপযুক্ত বিশেষণে বর্ণনা করা অসম্ভব। দীপা ক্যামেরা ব্যবহার করেন চরিত্রেই অভিব্যক্তি ও আবেগকে অন্য মাত্রা যোগ করার জন্য। বিশেষ উল্লেখ্য, ইন্দিরা গাঁধীর এমার্জেন্সি ঘোষণার দৃশ্য এবং তাঁর অভিব্যক্তির ক্লোজ আপ। রুশদির উপন্যাসের সবচেয়ে বিতর্কিত অংশটির একেবারে সঠিক চিত্রায়ন বলা যায়। আলো, ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর, মিউজিক, এডিটিং ইত্যাদি প্রভৃতি যে সব আবশ্যিক বিষয়গুলো ছেড়ে গেলাম, বিশ্বাস করুন, তার সঠিক আলোচনার জন্য রিভিউ নয়। একটি ক্রিটিক্যাল অ্যানালিসিস-এর রেফারেন্স বই হওয়া উচিত।
চেনা মুখ সারি সারি। ধীমান চট্টোপাধ্যায়, সাহানা গোস্বামী, রণিত রায়, রাহুল বসু, শাবানা আজমি, রজত কপূর, সিদ্ধার্থ, শ্রিয়া শরণ, সোহা আলি খান, রণবীর শোরে, বিনয় পাঠক, কুলভূষণ খরবন্দা... এঁরা কে কেমন অভিনয় করেছেন তা সবিস্তারে বলতে যাওয়াটা বাতুলতা মাত্র। কার কতটা স্পেস পাওয়া উচিত ছিল, সে আলোচনাও নিষ্প্রয়োজন। অভিনয়ের লক্ষণরেখা ছাড়িয়ে এঁরা একটি চলমান ইতিহাসের অঙ্গ হয়ে গিয়েছেন। তারে জমিন পর-এর ছোট্ট দর্শিল সফরী এখন কিশোর। অসামান্য অভিনয়প্রতিভা নজর কাড়বে, প্রত্যাশাও বাড়াবে। বিশ্বসিনেমার ইতিহাস যত দিন বেঁচে থাকবে, বিশ্বের সিনেমাপ্রেমীরা মনে রাখবেন দীপা মেহতার মিডনাইটস চিলড্রেন। বছর বছর ধরে কাটাছেঁড়া করবেন বিশ্বের নানা ইউনিভার্সিটির ফিল্ম ছাত্রেরা...আর ঠিক এই কারণেই, পাঁচটি স্টার আমার অতিশয়োক্তির সমর্থনে নয়, একটি ভবিষ্যত্ ক্লাসিক ছবিকে আগাম সেলাম জানানোর চেষ্টা হিসেবে প্রদত্ত।