বলিউডি ছবির কোষ্ঠ-সাফ, মুক্তির আশ্বাস 'পিকু'-র

Updated By: May 20, 2015, 04:19 PM IST
বলিউডি ছবির কোষ্ঠ-সাফ, মুক্তির আশ্বাস 'পিকু'-র

শর্মিলা মাইতি

ছবির নাম: পিকু

রেটিং: ****1/2

প্রথমবার মৃত্যু সামনে থেকে দেখা আমার বুড়োমায়ের। দাদু যাঁকে মা বলে ডাকতেন। শেষ জীবনে সন্ধ্যে ঘনালে দাওয়ায় বসে একদৃষ্টে চেয়ে থাকতেন বহুদূরে। মানুষটা ছিলেন অথচ কেমন যেন অদৃশ্য হয়ে। তাঁর থাকাটুকুও কেমন যেন বাড়তি, তবু ভাষার বাহুল্যে বর্ণনা করা যায় না। যেদিন তিনি চলে গেলেন। সুখের ঘুম। ঠোঁটে শান্তির আলো।

সুখমৃত্যু। বড় প্রাচীন শব্দ। ভোগবাদী দুনিয়ায় বড় ব্রাত্য এক শব্দ। সুখ বিঘ্নিত করবার এত শত কারণ যেখানে থরে থরে সাজানো আছে, সেখানে এই প্রার্থনাও কেমন যেন প্রলাপ। ভোগসুখে বাঁচতে পারাটাই নির্মম প্রতিযোগিতার ট্র্যাকখ বেঁচে থাকার জন্যেই এত চাহিদার স্তুপ, যে একসময়ে তা কোষ্ঠকাঠিন্যের মতোই নিদারুণ হয়ে দাঁড়ায়। জমতে থাকে পাহাড়প্রমাণ হয়ে, বেরোবার পথ পায় না। সুজিত সরকারের পিকু-র ভাস্কর ব্যানার্জি সেই মূর্তিমান বাস্তব। সংসারের সেই ব্রাত্য মানুষেরই একজন। প্রৌঢত্বের শেষ ধাপ পেরিয়ে যাওয়া একটি মানুষ, যিনি শিশুর মতোই পরনির্ভর। মেয়ে পিকু তাঁর কাছে মায়েরই সমান।

ভাবা যায়নি, এমন কোনও ছবি হতে পারে, যার মুখ্য বিষয়, কনস্টিপেশন। চিত্রায়ণ ও চরিত্রায়ণও হবে একেবারেই বিষয়কেন্দ্রিক। চিত্রনাট্য কোথাও সরবে না মুখ্য বিষয় থেকে। সুজিত সরকার কোনও এক ইন্টারভিউতে বলেছিলেন, সত্যজিত্‍ রায় তাঁর প্রেরণা। এ ছবির বিটুইন দ্য লাইনস-এ সত্যজিতকেই খুঁজে পাওয়া যাবে, এমনই দাবি ছিল তাঁর। কিন্তু ভাস্কর ব্যানার্জি নামটা উঠে এল হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের আনন্দ ছবি থেকে। ভেতরে ভেতরে বইতে লাগল এক দলা অভিমান আর একটুখানি সহানুভূতি। সাদা বাংলায়, একটা খিটখিটে সত্তরোর্ধ বুড়োর জন্য, যার জীবনের একমাত্র ভাবনার বিষয় কোষ্ঠসাফ হওয়া। সবেতেই সন্দেহ, সবেতেই মর্জি। ভাবাই যায়নি এতকাল, দি গ্রেট অমিতাভ বচ্চনকে একদিন দেখতে পাব এই চরিত্রে। এই চেহারায়। এই বাচনভঙ্গিমায়। ভাবা যেত কি এই লোলচর্ম বৃদ্ধ অমিতাভ একদিন ওয়েস্টার্ন স্টাইলের কমোডে ইন্ডিয়ান স্টাইনে বসার চেষ্টা করবেন? যেটা ভাবা যায়নি, সেটাই ভাবলেন সুজিত। এবং জুহি চতুর্বেদী।

যাই হোক, ছবির নাম যখন পিকু, তখন নামভূমিকায় যিনি, সেই সুন্দরী দীপিকা পাডুকোনের কথায় আসি। টুইটারে বিগ বি যাঁকে সেরা কন্যার তকমা দিয়েছেন। রাগ, স্ট্রেস ও নির্ভেজাল ঝগড়া এই তিনটে অনুভূতি এমন সুন্দর ব্যবহারিক প্রয়োগ হাল আমলে কোনও নায়িকাকেই করতে দেখিনি। যেসব নিন্দুকেরা বাঙালি নায়িকার খোঁজ করছিলেন দীপিকার মধ্যে, তাঁরাও নরম হবেন। সাজে-পোষাকে, হাঁটায়চলায় আধুনিক বঙ্গনারীর চেয়ে কোনও অংশে পিছিয়ে নেই তিনি। লম্বা বেতস দেহপল্লব, সপ্তমে চড়ে থাকা মেজাজ দীপিকাকে বড় বাস্তব, বড় আপন করে তুলেছে। পিতা-কন্যের এমন চূড়ান্ত, উত্তুঙ্গ ভালবাসা, শুধুই অনুভব করবার। বাবার জন্যে পিকু-র ছোট-বড় সব ধরনের আত্মত্যাগ হঠাত্ হঠাত্ ভাবনার খোরাক যোগায়।

ছবি যত এগিয়েছে, দর্শকমহলে উঠেছে হাসির হররা। সোডার মতো ভসভসিয়ে। কোষ্ঠকাঠিন্যের মধ্যেও যে এমন সূক্ষ্মরস লুকিয়ে ছিল, কে জানত! ইরফান খান যখন সাদা কাগজে ছবি আঁকছেন মলদ্বারের, তখনও কোথাও যেন স্খলিত হয় না এই সূক্ষমতা। দুর্ভাগ্য নায়কের। কোষ্ঠকাঠিন্যের অপরাধেই অফ-ট্র্যাক হয়ে গেলেন যিশু সেনগুপ্ত। পিকুর বিজনেস পার্টনার এবং নিঃশব্দ অনুরাগী। কীভাবে, সেটা ছবি দেখেই আবিষ্কার করবেন।

ইরফান খান। ইন্টারেস্টিং চরিত্রের সঠিক, অভিধান-সম্মত রূপায়ন। আটকে যাওয়া স্তুপের বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তা খুঁজে দেওয়ার জন্যেই তাঁর আবির্ভাব। আসল সমস্যার সমাধানের রাস্তা বের করে দেওয়ার জন্য। টুলু  পাম্প সারিয়ে জলের সমস্যা সমাধানের জন্য। গল্পের গতি যখন হাইওয়ে দিয়ে এগোয়, তখনও এঁর একটি অনবদ্য ভূমিকা আছে, সেটা না হয় উহ্যই রইল। আর আছেন ছবিমাসি মৌসুমী। মনে কী পড়ে অমিতাভ মৌসুমী জুটিই একদিন হাত-ধরাধরি করে বৃষ্টিতে ধুয়ে যাওয়া শহরেই হেঁটে হেঁটে গাইছিলেন- রিমিঝিমি গিয়ে সাওন... কে জানে কত যুগ পেরিয়ে এলে এই কথোপকথন শুনতে পাওয়া যায় অমিতাভ ও মৌসুমীর মধ্যে।

তেমনি অনেক যুগ না পেরিয়েও, সমস্যার খুব সহজ সমাধান খুঁজে পান বৃদ্ধ ভাস্কর। সাইকেল চালিয়ে কলকাতার রাস্তায় পাড়ি দেন। বদ্ধ জীবনে লাগে হালকা হাওয়ার আন্দোলন। আপনিই হয়ে যায় সমস্যার নিরসন। ইজিচেয়ারে বসে, শেষ কথাটি বলেন তিনি। জীবন সবারই শেষ হবে। তবু সব জীবনের শেষে যেন থাকে সুখমৃত্যু। শান্তির ঘুম। জীবনের স্তুপাকার বোঝা বয়ে বয়ে নয়, মুক্তির স্বাদ নিয়েই যেন আসে নেমে আসে চিরঘুম।

আরও যেটা জানেন না দর্শক, তা হল সুজিতের বন্ধুবাত্সল্য। এই ছবিতেই পার্শ্বচরিত্রে দেখতে পাবেন ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডজয়ী শব্দগ্রাহক, এডিটর ও আরেক পরিচালককেও। নাম বলছি না। নিজেরাই দেখে নেবেন। সঙ্গীতেরও কী মাহাত্ম্য! সব বাধা পেরিয়ে অনুপম রায়ের অভিষেক ঘটে গেল মুম্বইয়ে। আরও এক বাঙালির সূর্যোদয়।

.