রং কারও বাপের নয়, শব্দ কারও বাপের নয়, তা পৃথিবীর : শিলাজিৎ
তোমার সাক্ষাত্কার নেওয়ার জন্য তো প্রায় চাতক পাখির মত অপেক্ষা করতে হয়। দক্ষিণ কলকাতায় থাকলেও শহরের কোলাহল থেকে দূরে যেতে তো মাঝেমধ্যেই গড়গড়িয়ায় গিয়ে বেশ কয়েকদিন থেকে আসো
অনসূয়া বন্দ্যোপাধ্যায়:
তোমার সাক্ষাত্কার নেওয়ার জন্য তো প্রায় চাতক পাখির মত অপেক্ষা করতে হয়। দক্ষিণ কলকাতায় থাকলেও শহরের কোলাহল থেকে দূরে যেতে তো মাঝেমধ্যেই গড়গড়িয়ায় গিয়ে বেশ কয়েকদিন থেকে আসো
শিলাজিত্- হ্যাঁ, আমার জন্ম ওখানে। ওই ভিটে আমায় টানে। লকডাউনে কলকাতায় ছিলাম, কিন্তু গড়গড়িয়ার জন্য বড্ড মন কেমন করছিল। তাই লকডাউন উঠতেই ছুটে গিয়েছি। আসলে গ্রামে থাকলেই গ্রামের ছেলে হওয়া যায় না। আমার ছেলেবেলায় যে আওয়াজ শুনে বেড়ে ওঠা, যে আদর পেয়ে বড় হওয়া সেগুলো বড্ড কাছের। আমি বনক্ষতিপুরেও যাই, পুজোতে ওদের জামাকাপড় দিই। সত্তর আশি জন শিশু আছে, ওদের কাছে যাই। শেষ বয়সটা ওখানেই কাটাতে চাই।
দূরে থাকলেও তো শহরের কোালাহল শুনতে পাও। বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতি যা তাতে দলবদলের হিড়িক চলছে। রাজনীতিতে আসবে নাকি, সেলিব্রিটিরাও তো নতুন দলে যোগ দিচ্ছেন। তোমার গায়েও তো কমলা রঙের শার্ট। এটা কীসের ইঙ্গিত?
শিলাজিত্-হেসে, সেটা তো সময় বলবে। হে হে। রঙ কারও বাপের নাকি, কখন কমলা পরব, কখন সবুজ পরব। আমায় যদি কেউ বলে এই শব্দটা কেন বলছেন। শব্দ কারও বাপের নাকি! আমায় যদি কেউ বলেন এই শব্দ বলতে পারব না। শব্দ কারও বাপের নাকি? রঙ পৃথিবীর, শব্দ পৃথিবীর। জনসাধারণও তো বদলাচ্ছে। আর সেইজন্যই বুদ্ধিমান যাঁরা, তাঁরা বদলটাকে বেছে নিচ্ছেন। আর কী ইঙ্গিত বলছ?
আরও একটা ইঙ্গিত পেয়েছি, সেটা হল সম্প্রতি ইন্দ্রনীল সেনের উপর কাটমানির অভিযোগ তোলেন শুভেন্দু অধিকারী। তার প্রতিবাদে রাস্তায় নামেন সঙ্গীতশিল্পীরা। তোমায় সেখানে দেখা গেল না।
শিলাজিত্- গত তিন বছর ধরে আমি সঙ্গীত মেলায় নিমন্ত্রণ পাইও না। আগে গানমেলার জন্য এক দুবার ডেকেছে। পরবর্তীকালে ডাকে নি। কাটমানি কী আমি জানব কী করে? ইন্দ্রনীল সেনের সঙ্গেও কথাবার্তা কমই হয়। তবে খারাপ লাগল শুনে। এখন যে যাকে পারছে খারাপ কথা বলছে।
শিলাজিত্ গান মেলায় গাইছেন না, এটা তো ইন্ডাস্ট্রির জন্য়ও খারাপ খবর, তোমার আক্ষেপ নেই?
শিলাজিত্- খারাপ লাগার কী আছে, কীসের আক্ষেপ। আমি তো আরও বড় মেলাতে কাজ করি। আমি বনক্ষতিপুরে আমার আশিটা ছেলেমেয়ে থাকে, তাদের সামনে গাই, সেটা আমার কাছে অনেক বড় মেলা। এই গানের মেলা কোন চত্বরে করবে?ডাকল কী না ডাকল, আমার যতটুকু করার ততটুকু করব। আগে গান করতে এসে গানের রাজনীতি যা বুঝেছিলাম বাংলা গানের শ্রোতারা অপ্রাপ্তবয়স্ক, তাঁদের অপ্রাপ্তমনস্কতা আছে। আজ যেটা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে হয়। তরজা চলত, আমি কত ভাল, তুমি কত খারাপ। তাচ্ছিল্য চলত। আমি পাখির ডাককেও গান ভাবতাম, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে তা থ্রেট হয়ে যেত। আজ যদি 'টুম্পা সোনা' হিট করে, তাহলে আর কী করলাম! আমার সময়কার গানবাজনা যাঁরা করেছিলেন, যা দেখতাম তাতে আমরা অনেক দূর যেতে পারতাম। কিন্তু সকলেই বড্ড আগে সেটলমেন্ট করলেন।আমি ভেবেছিলাম আমি লিবারাল মিউজিক্যাল জায়গায় আছি, কিন্তু দেখলাম জনগণ তুলনা চায়।
তুমি তো মানুষের জন্য কাজ করছ, এবং প্রচুর পালাবদল দেখেছ...
শিলাজিত্- আবার হেসে, প্রচুর বদল দেখলাম। ছেলেবেলায় কাঁদানে গ্যাস এসে চোখে লেগেছ, পাড়ার আলোগুলো লাল সেলোফেনে মুড়ে যেতে দেখেছি, নীল সাদা শহর হতেও দেখলাম। কিন্তু আমার ভিটেতে দেখেছি কী বদল এসেছে। একজন ডাক্তারবাবু যাতে রোজ বসে,তার জন্য কত প্রসেস সামলাতে হয়েছে ভাবতে পারা যায় না। যতবার কাজ করতে গেছি, ততবার নিজের চেষ্টায় করেছি। একটা টিনের চাল, বা পাঁচিল করতে চেষ্টা করেছি। তখন মাঝে মাঝে মনে হত তাহলে কি রাজনীতিই করতে হবে? সংশোধনের রাজনীতি!স্কুল বা হাসপাতলে নজর দেওয়া যাবে তাতে। কত বন্ধুদের অনুরোধ করেছি, তোরা রাজনীতি করিস। একটু আয় না আমার স্কুলে। রাজা গেলে তো রাস্তা পরিস্কার থাকে!কিন্তু সেটুকু করতেও কেউ দলীয় কর্মসূচীতে সময় পায় নি।
যেহেতু সময় পান নি কেউ, তাই কী তোমার এখন মনে হচ্ছে এবার মাঠে নামার সময় এসেছে!
শিলাজিত্-ফের হেসে, আবার এই প্রশ্ন। আমি এটার উত্তর দিতে পারব না।এটা বললেই এবার কোন দল,কী ব্যাপার, এত কথা বলতে হবে, কেন বলত এরকম কি কোনও খবর আছে!প্লেন তো এসে চলে গেল।
কী বলছ, এ তো সবে শুরু হল। তোমার কাছে কী অফার আছে স্পষ্ট করে বলো তো?
শিলাজিত্- আমি গানটা করতে পারি, রাজনীতি কত বড় শিক্ষা এবং চর্চার ব্যাপার বল তো। রাজনীতির বাইরে আমি নই যদিও, আমি চাই বা না চাই। এই কথা নিয়েও রাজনীতি হবে দেখো না। তবে রাজনীতি বোঝার একটা জ্ঞান থাকে, ইচ্ছে থাকে। আমিও করি, কিন্তু একজন গাইড চাই। যাঁরা যাঁরা যাচ্ছেন তাঁরা শিক্ষা তো নিয়েছেন নিশ্চই।
না সকলে তো রাজনীতির নিয়ম-আদর্শ জেনে আসছেন না। মানুষের জন্য কাজ করতেও আসছেন। তুমি এমনিতেই কাজ করছ। রাজনীতিতে এসে করলে তা তো সহজ হয়ে যাবে
শিলাজিত্- হ্যাঁ ইউ আর রাইট। সহজ হবে। যদি আমাকে কেউ বলে বীরভূমের কোনও সিটে দাঁড়াই, আমি জিতব। আমাকে বীরভূমের মানুষ যেভাবে চেনে, কতটা আমি কলকাতার, কতটা বীরভূমের তা তাঁরা জানেন। আমি থাকি, বাস করি, যাপন করি। বীরভূমে আমি দাঁড়ালে জিতবই। কিন্তু সেটাই কি রাজনীতি! জিতে ফেললেই রাজনীতি। অপর দলকে ভাবতে হবে আমি দাঁড়ালে, আমি যে দলেই যাই সেটা আমার কাছে প্রথম দল হবে, বদল তো নয়। তবে এখনও কিছু প্রশ্নের উত্তর পাচ্ছিনা। সূচ ও চালুনির লড়াই চলছে। অপরাধীদের নিচ্ছে, কুকথা বলছে শুধু একে অপরের বিরুদ্ধে কথা বলা। আমি জানি না জীবনে রাজনীতি করতে যাওয়ার সময় সবচেয়ে বাধা হয়ে দাঁড়াবেন আমার মা, পরিবার। সেটাকে ওভারকাম করা আরও বড় উদ্দ্যেশ্যে, সেটা রয়ে গেছে।
অফারটা কি এসেছে?
শিলাজিত্- বামপন্থার আমলে আমাকে এক নেতা মিছিলে হাঁটার অনুরোধ করেছিলেন, আমি সবিনয়ে প্রত্যাখ্য়ান করেছিলাম। পরবর্তীকালে অনুষ্ঠানের জন্য কর্মসূচীতে যোগ দেওয়ার জন্য প্রচুর অফার আসে। আমায় বলা হয়েছিল কাজ করতে দেব না। জবরদস্তি কেউ কোনও দিন করার সুযোগ পায় নি। কিন্তু আমি বলেছিলাম ঘুম পেয়েছে বাড়ি যা। আমার সঙ্গে বহু মানুষের কথা হয়েছে। আমার কাছে অফার না আসার কারণ নেই। কিন্তু কী অফার, কে অফার দিচ্ছে সেটা আসল। যদি রাজনীতি করতেই হয় আমি যা বুঝছি, আমি যেটা ভাল করতে চাই তার জন্য আমি যাঁর সঙ্গে চাইব কাজ করব। অন্য দলের কেউ যদি আমার ফ্যান হন তাঁকে দিয়ে কাজ করাব। কিন্তু একজনেরটা ছিনিয়ে দিয়ে নয়। একজনের দরকার তাকে সরিয়ে নিজের কাছের মানুষকে পাইয়ে দেব না। এদিকে 'জয় শ্রী রাম' আর ওদিকে 'চড়াম চড়াম' চলছে, আমরা শুধু দেখে যাচ্ছি।
জল্পনা তুমি ওড়াচ্ছো না, তাই তো!অফার আছে কিনা, বা অফার আসলে জয়েন করবে কি না, তা নিয়ে ধোঁয়াশা থাকলেও একদম না কিন্তু একবারও বললে না!
শিলাজিত্- আমার কাছে অফার থাকলেও সুনির্দিষ্ট কথা হয় নি। আমি জানি না করতে চাই কিনা, আমি ঠিক জানি না, আমি অঞ্জন দত্ত।.... (হাসি)
এই মুহূর্তের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে একটা গান গাইতে বললে কী গাইবে?
শিলাজিত্-এটা খুব বিপদে ফেললি তুই। বর্তমান অবস্থা দেখে গান আসছেই না। কী বলব, কি গাইতে কি গেয়ে ফেলব। ইচ্ছেও করছে না। রতন কাহারের একটা গান গাই, বক্রেশ্বরের গরম জল হল গরম জল, আমার সাথে তু মারি ঠান্ডা হয়ে চল........আমি বক্রেশ্বরের গরম জল হয়ে থাকতে চাই, যা করবি কর ভাই একটু ঠান্ডা হয়ে চল....