Singer KK Dies: 'গত ১৬ বছর ধরে কেকে-র গান অসহনীয় আমার কাছে' ব্যক্তিগত ক্ষয়ের কথা লিখলেন শ্রীজাত
'সেই ২০০৬-এর ডিসেম্বর থেকে আজ অবধি কেকে-র গান আমি সহ্য করতে পারি না। ক্যাব-এর রেডিও-তে হঠাৎ বেজে উঠলে চালককে তৎক্ষণাৎ বলি চ্যানেল সরিয়ে দিতে, কোনও জমায়েতে হুট করে বেজে উঠলে সন্তর্পণে উঠে বাইরে চলে যাই।', শ্রীজাত
নিজস্ব প্রতিবেদন: মঙ্গলবার কেকের আকস্মিক ও অকালপ্রয়াণে শোকস্তব্ধ সঙ্গীতমহল। সারা ভারতের সঙ্গীতপ্রেমীরা মেনে নিতে পারছে না তাঁর মৃত্যু। কেউ লিখছেন কেকে-র গান ঘিরে তাঁদের নস্টালজিয়া। কেউ আবার শেয়ার করেছেন ব্যক্তি কেকে-র সঙ্গে তাঁদের সম্পর্কের কথা। কেকে-র মৃত্যুতে নিজের ব্যক্তিগত ক্ষয়ের স্মৃতি শেয়ার করলেন শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায়(Srijato)।
শ্রীজাত লিখেছেন, ''কেকে-র গান আমার অসহ্য লাগে। গত ১৬ বছর ধরে অসহ্য লাগে। সেই ২০০৬-এর ডিসেম্বর থেকে আজ অবধি কেকে-র গান আমি সহ্য করতে পারি না। ক্যাব-এর রেডিও-তে হঠাৎ বেজে উঠলে চালককে তৎক্ষণাৎ বলি চ্যানেল সরিয়ে দিতে, কোনও জমায়েতে হুট করে বেজে উঠলে সন্তর্পণে উঠে বাইরে চলে যাই। এতটাই অসহনীয় আমার কাছে, কেকে-র গান, গত ১৬ বছর ধরে। টানা ১৬ বছর, আমি কেকে-র গান শুনিনি। সত্যি বলতে কী, পালিয়েছি তাঁর কাছ থেকে।
আসলে তাঁর কাছ থেকে নয়, পালিয়েছি আমার অকালপ্রয়াত ভাইয়ের কাছ থেকে। ব্যক্তিগত ক্ষয়ের কথা, আন্তরিক ক্ষরণের কথা সমক্ষে তুলে ধরিনি কখনওই, জীবনের প্রতি সংকোচ আর স্মৃতির প্রতি সম্ভ্রম থেকেই। কিন্তু কিছু আকস্মিকতায় সেসব বাঁধ, সেসব আড়ালও হয়তো টুটে যায় সাময়িক ভাবে। ছোট ভাই, যার আদরের নাম পুশকিন, তার প্রিয় গায়ক ছিলেন কেকে। আর তার হাত ধরে আমারও। গিটারে তার হাত চলাফেরা করত চমৎকার, আর সুরে গলাও খেলত দিব্যি। তার পড়াশোনা আর পরীক্ষার চাপের ফাঁকে ফাঁকে আমি তাকে জোর করে বসাতাম, ‘গান শোনা দেখি দু’খানা’। এমন বললে সে দু;খানা গানই গেয়ে উঠত কেবল। ‘ইয়ারোঁ, দোস্তি বড়ি হি হসীন হ্যায়’, আর ‘হম রহেঁ ইয়া না রহেঁ কল, কল ইয়াদ আয়েঙ্গে ইয়ে পল’।
সেসব গান তখন দেশজোড়া প্রজন্মের বাঁচায় আগুন জোগাচ্ছে। আমাদের দু’কামরার ছোট্ট বিছানায়, আলসে মশারির ছোঁয়া লাগা সকালবেলায়, গিটারে সাবলীল আঙুল বুলিয়ে বছর একুশের পুশকিন চোখ বন্ধ করে গেয়ে উঠত এই দুই গান। আমাকে এটুকুও বুঝতে না-দিয়ে যে, আর দু’বছরের মধ্যে ভয়াবহ বাইক দুর্ঘটনায় সে চলে যাবে ন’দিনের দীর্ঘ ঘুমে। সাড়া দেবে না আমাদের কারও ডাকে, গিটারের তার থেকে আঙুলের মায়া ছাড়িয়ে নিয়ে দশ দিনের মাথায় হাজির হবে গনগনে আগুনের সামনে, শরীরের নির্জীব সাক্ষী দিতে।
সেই থেকে কেকে আমার শত্রু, সেই থেকে এই গানগুলো আমার দু’চোখের বিষ। সেই থেকে আমি কেকে-র অসামান্য সুরেলা আর টানটান দরাজ কণ্ঠ থেকে পালিয়ে বেড়াই, কোনো অনুষ্ঠানে তিনি মাইক হাতে নিলেই আমি উঠে চলে আসি, কখনও পিকনিকের দুপুরে তাঁর গান বাজানো হলে আমার বাড়ি যাবার তাড়া চলে আসে। কেউ জানে না, কিন্তু ১৬ বছর ধরে এই একজন মানুষের গানের কাছ থেকে পালাই আমি। পিঠ বাঁচিয়ে, মন বাঁচিয়ে, চোখ বাঁচিয়ে।
আজ তিনি চলে গেলেন, যাবার মুহূর্তের কিছু আগেও গানই তাঁর সঙ্গ দিলো। কী গেয়েছিলেন, জানি না। কেকে আসছেন শুনেই নজরুল মঞ্চের কাছাকাছি দিয়ে যাতায়াতের পথ বাছিনি আজ। কে বলতে পারে, যদি ‘ইয়ারোঁ, দোস্তি...’-র এক কলিও কানে ঢুকে আসে? পালিয়েছি আজও। কেবল বুঝিনি, তাঁরও পালানোর মতলব আছে, পুশকিনের মতোই। রাগ ছিল লোকটার উপর খুব। কখনও দেখা হলে কেঁদেকেটে ঝগড়া করার ছিল অনেকখানি। জড়িয়ে ধরবারও লোভ ছিল খুব, অভিমানে, অসহায়তায়। সেসব গানের সঙ্গেই ভেসে গেল।
‘হম রহেঁ ইয়া না রহেঁ কল, কল ইয়াদ আয়েঙ্গে ইয়ে পল’... গানের কথাকে একজীবনে এমন অসহ সত্যি করে দিয়ে চলে যাবার মতো মানুষ কমই আসেন পৃথিবীতে। কেকে তাঁদেরই একজন। ১৬ বছরের গভীর ক্ষতের উপর মলমের বদলে মশাল চেপে ধরলেন তিনি। এমনই মশাল, যার আগুনে দূরে কোথাও পুশকিনের গিটারটাও পুড়ে যাচ্ছে, একা একা...''
আরও পড়ুন: Singer KK Dies: '১২ বছরে এদৃশ্য দেখিনি', কেকে-র অকালপ্রয়াণে চাঞ্চল্যকর বয়ান নজরুল মঞ্চের কর্মীর