ঢং শিয়ে
কুণাল বোস
অনেক ছোটবেলায় মায়ের মুখে শোনা এই গল্প। আজও কেমন যেন শৈশবে শোনা এই গল্প মনে পড়লেই অতীত দিনে ফিরে যায় মনটা। মায়ের মুখে কতবার যে শুনেছি চিন দেশের এই গল্প ‘ঢং শিয়ে’। গল্পের শুরুতেই যে প্রশ্ন আপনাদের মাথায় ঘুরছে সে প্রশ্ন আমারও ছিল। তার কারন অদ্ভুত এই নাম। মাকে জিজ্ঞাসা করতে মা বলতেন শিয়ে অর্থাৎ চিনা ভাষায় জুতো। আর ঢং? একথা বললেই মা রেগে যেতেন, বলতেন সবই কি এক্ষুনি শুনে নিবি নাকি গল্পটাও শুনবি? হ্যাঁ ঠিকই, আপনাদেরও কৌতূহল না বাড়িয়ে গল্পটা শুরু করি।
কয়েক হাজার বছর আগে চিনের ইউনান প্রদেশের এক রাজ্যের এই কাহিনি। প্রজাহিতৈষী এক রাজার রাজত্ব ছিল সেই সময়। রাজার একদিন খুব শখ হল রাজ্যের মাঝের বিশাল প্রাঙ্গন জুড়ে তাঁর যদি একটা বিরাট মূর্তি তৈরি করা যায় কেমন হয়? তাও আবার যে সে মূর্তি নয়, সোনার মূর্তি ! যুগ যুগ ধরে তাহলে মানুষ তাঁকে মনে রাখবে। যেমন ভাবনা তেমন নির্দেশ। রাজা হাক পাড়লেন রাজ্যের মন্ত্রীকে । নিজের মনের কথা খুলে বললেন তাঁকে। নির্দেশ দেওয়া হল যেভাবেই হোক মূর্তি বানাতেই হবে। একশো ফুটের সোনার মূর্তি। কিন্তু এত সোনা আসবে কোথা থেকে? রাজ্যের ভাঁড়ারে যে সোনা আছে তাতে এতবড় মূর্তি বানানো যাবে না। তাহলে কী করা যায়। রাজাই বাতলে দিলেন সে উপায়। বললেন, গরিব প্রজাগণকে বাদ দিয়ে ধনীদের কাছে যেতে হবে । তাঁদেরকে গিয়ে একবার রাজামশাইয়ের এই সাধের কথা জানালে তারা নিশ্চয়ই উদার হস্তে দান করবেন। রাজার নির্দেশ মত রাজ্যের দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল সেই বার্তা। রাজার সোনার মূর্তির জন্য সব জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। রাজ্যের প্রত্যেকটি বাড়িতে গিয়ে গিয়ে রাজার চর এই বার্তা দিয়ে এলেন। রাজার এই আবদারের কথা শুনে অনেকেই এগিয়ে এলেন। দান কলেন তাঁদের কাছে থাকা সোনাদানা। শুরু হল সেই বিশালাকার মূর্তি তৈরির কাজ। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা সোনা গলানো হতে লাগলো। বিশাল এক কড়াতে সেই সোনা গলানোর কাজ শুরু হল। এই বিরাট কর্মকাণ্ড দেখতে দূর দুরান্ত থেকে লোকজন আসতে শুরু করলেন।
প্রজাদের এই ভালোবাসা পেয়ে রাজা তো দারুন খুশি। মন্ত্রীর কাছে জানতে চান কতদিন লাগবে এই গোটা মূর্তিটি তৈরি করতে। মন্ত্রী জানান তা তো সময় লাগবে রাজা মশাই। একটু অপেক্ষা তো করতেই হবে। রাজার আর তর সয়না। একশো ফুটের মূর্তি তাও আবার রাজা মশাইয়ের, কারিগর যে সে হলে চলে? অনেক রাজ্য ঘুরে বেশ একজন দক্ষ মানুষকে খুঁজে আনা হয়েছে রাজা মশাইয়ের নির্দেশে। রাজার মন পেতে হবে। তাহলেই মিলবে সেই মত পারিশ্রমিক। ভালোই জানে সে কারিগর। তাই কাজে কোন খামতি রাখা চলবে না। সেইমত রাজার মূর্তি তৈরির কাজ চলতে লাগলো। রাজা দুবেলা করে দেখে যান কতটা কাজ এগোলো। কিছু দিন কাজ চলার পরই কারিগর জানাল এই সোনায় কাজ সম্পূর্ণ হবে না। আরও সোনা লাগবে। এদিকে রাজ্যের ভাঁড়ার তো শূন্য। প্রজারাও ভালোবেসে রাজা মশায়ের নামে দান করেছেন। তাহলে এবার উপায়? চিন্তিত হয়ে পড়লেন মন্ত্ৰী। রাজা মশাইকে সব কথা খুলে বলা হল। কি করা যায়, কারোরই মাথায় ঢুকছে না। সেনাপতি এসে বললেন, রাজা আদেশ দিলে আরও একবার প্রজাদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে দেখতে পারি। যদি তারা যদি কিছুটা সাহায্য করতে পারেন। রাজা প্রথমটা রাজি হলেন না, কিন্তু অনেক ভাবনা চিন্তার পর সেনাপতিকে নির্দেশ দিলেন প্রজাদের কাছে আরও একবার দরবার করতে। কিন্তু এটাও বারে বারে সুনিশ্চিত করলেন যেন কোন ভাবেই গরিব মানুষের থেকে এক কনাও যেন নেওয়া না হয়। নির্দেশ মিলতেই সেনাপতির সৈন্যসামন্তরা রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু যে ঘটনা এরপর ঘটল তা একেবারেই রাজার নির্দেশের বিপরীত। চলল অত্যাচার। যারাই দিতে অস্বীকার করলেন তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনার চেষ্টা হল। চারদিকে এক রণক্ষেত্র যেন। গোটা ঘটনাই সেনাপতির নির্দেশে ঘটতে থাকলো। ঘরে ঘরে ঢুকে মহিলাদের পর্যন্ত মারধর করা হল। এমনই এক বৃদ্ধার কুটিরেও হানা দিল রাজার সৈন্যরা। মা ও মেয়ে দুজনে থাকেন সেখানে। তাঁর সুন্দরী কন্যার বিবাহের জন্য রাখা হিরের হার। সেনাপতির চোখ পড়ল সেদিকে। অনেক ভয় দেখানোর পরও কোন ভাবেই সেই হার ছিনিয়ে নিতে পারল না তারা। সেদিনের মত বিদায় নিল সেই রাক্ষসের দল। রাজার কাছে বার্তা পৌছল প্রজারা খুশি হয়ে আবারও অনেক অনেক গয়নাগাটি গা থেকে খুলে খুলে দিয়েছেন। রাজা নিশ্চিত হলেন। এদিকে রাজ্যজুড়ে তখন রাজার নামে ছিঃ ছিঃ করছেন সমস্ত প্রজা। ধিক্কার জানাচ্ছেন এই পাশবিক ঘটনার।
পরদিন সকাল হতেই আবারও সেনাপতির পেয়াদারা এসে হাজির ওই বৃদ্ধার কুটিরে। এবার আর কোন বারণ তারা শুনবে না। জোর করে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা ওই হিরের হার। বৃদ্ধা ও তাঁর মেয়েকে মেরে ধরে কোন রকমে সে হার তারা নিয়েই ছাড়বে। মেয়েটির অনেক অনুরোধও তাদের কানে যাচ্ছে না। রাজার নির্দেশ এই হার দিতেই হবে। অবশেষে সেনাপতি নিজে এগিয়ে এলেন। মেয়েটির হাত থেকে হার ছিনিয়েই ঘোড়া ছোটালেন। মেয়েটিও পেছনে পেছনে দৌড় লাগলো।
ময়দানের মাঝে তখন সোনা গলানো হচ্ছে বিশাল কড়াতে। চারিদিকে লোকে লোকারণ্য। রাজাও হাজির সেই কর্মকান্ড দেখতে। এমন সময় হাজির হলেন সেনাপতি তাঁর দলবল। রাজা মশাইকে শোনালেন তার দয়ালু প্রজাদের কথা। হাতেই রয়েছে সেই হিরের হার। একে একে গয়নাগাটি গলানো হবে। সব জড়ো করে সেই ফুটন্ত কড়ায় ঢালা হচ্ছে। এমন সময় হাজির সেই মেয়েটি। যার হার ছিনিয়ে পালিয়ে এসেছে সেনাপতি। তাঁকে দেখা মাত্রই হারটি সেই বিশাল কড়াতে ছুঁড়ে মারেন সেনাপতি। সেইসাথে মেয়েটিও এক মুহূর্তে অপেক্ষা না করে ঝাঁপ মারে গরম কড়ায়। সমানেই দাঁড়িয়ে ছিলেন রাজামশাই। ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে গিয়ে মেয়েটির পা ধড়তে যান তিনি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের,তাঁর জুতটি রাজার হাতে চলে আসে। টগবগিয়ে ফোটা সেই গরম কড়ায় নিমেষে ঝলসে যায় মেয়েটি। চারিদিকে তখন একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। সবাই চুপ। বন্ধ সব কাজকর্ম। রাজা মশাই ওই একপাটি জুতো হাতে নিয়েই মাটিতে বসে পড়েন। এরই মাঝে হাজির ওই বৃদ্ধা। মেয়ের করুন পরিণতির কথা শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। রাজাকে সামনে দেখে অভিশাপ দিতে শুরু করেন। সেনাপতির সব কুকীর্তি রাজার সামনে পরিষ্কার হয়ে যায়। সেই মুহূর্তেই রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয় সে।
ঘটনার প্রায় একবছর পর সেই মূর্তি উন্মোচনের পালা। ময়দানের চারিদিকের লোক থৈ থৈ। রাজাও হাজির। খুশির পরিবেশ। একটা উৎসবের চেহারা যেন গোটা রাজ্য জুড়ে। রাজা মশাইয়ের সোনার মূর্তি দেখতে বিভিন্ন প্রদেশ থেকে মানুষ এসেছেন। এসেছেন অতিথিরা। রাজার নির্দেশে ধীরে ধীরে আবরণ উঠতে থাকলো। একশো ফুটের মূর্তি উন্মোচনে সকলেই উৎফুল্ল, বিস্মিত। কিন্তু একই! অদ্ভুত সুন্দর ওই মূর্তির বুকের মাঝে ওটা কি? সবাই বিস্ময়ের সঙ্গে তাকিয়ে। রাজা মশাই চিনতে ভুল করেন নি। সুদৃশ্য সোনার মূর্তির বুকে সেই হিরের লকেটটা। চক চক করছে একেবারে।
রাজার রাজ্যপাট চলে গেছে বহু বছর হল। ওই মূর্তিকে ঘিরে পরবর্তী সময়ে তৈরি হয়েছে মন্দির। বহু মানুষ আজও আসেন ওই বিশালাকার মূর্তি দেখতে। বহু কাহিনী জুড়ে আছে ওই মূর্তিকে ঘিরে।আসেন আরও একটা কারণে। কারণটা একটু হারহিম করা। ওই এলাকার মানুষ আজও বিশ্বাস করেন ওই মেয়েটি আজও নিজের জুতোর জন্য ওই এলাকায় ঘোরা ফেরা করে। তাই চারিদিকে পাহাড়ে ঘেরা ওই মন্দিরে যখনই কোন ঘন্টা বেজে ওঠে তার সাথে সাথেই একটা আওয়াজ গোটা উপত্যকায় ধ্বনিত হয়, “শিয়ে-শিয়ে-শিয়ে”। সে তাঁর ফেলে আসা ওই একপাটি জুতো আজও চায়। যা সেই রাজার হাতে রয়ে গিয়েছিল। আপনাদের গল্পের শুরুতেই বলেছিলাম শিয়ে অর্থাৎ চিনা ভাষায় জুতো।তাই যখনই ঘন্টার সেই ঢং শব্দ হয়, সকলে আজও পরিষ্কার শুনতে পান সেই আওয়াজ। ঢং- শিয়ে -শিয়ে-শিয়ে…….