নবমীর গল্প- জন্মান্তর

Updated By: Oct 22, 2015, 12:47 PM IST
নবমীর গল্প- জন্মান্তর

জন্মান্তর

সৌম সিংহ

ক্যানভাসে আমি তুলি বোলায় এক মনে। সারাদিন, দিনরাত। অয়েল পেন্টিং আমার নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই নেশার কাছে হার মেনেছে সামাজিকতা, বন্ধুত্ব, সংসার, উত্সব, আনন্দ, সবকিছুই। আমি শুধু মনের রঙগুলি ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলি।

লোকে আমায় পাগল বলে। তা বলুক, আমার এখন আর কিছুই যায় আসে না। যেত-আসতো, যদি না প্রতিদিন দু’বেলা কেউ আমার খোঁজ না নিয়ে যেত। দু’বেলা ঘরের দরজার কাছে এসে মৃদু স্বরে বলত—আপনার জন্য চা নিয়ে এসেছি...

সে আমার কেউ নয়। আমি ওর নামও জানি না। তার সঙ্গে না আমার শারীরিক, না মানসিক সম্পর্ক। তবে রাত যত ঘন হয়, তার কথা না ভাবলে আমার ঘুমই আসে না। সারারাত ছটফট ছটফট। এক সময় চোখ যখন জুড়ে আসে, তখন সেই বিধবা তরুণী সাদা শাড়ি পড়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। আমি সমস্ত অয়েল পেন্ট তার শাড়ি-শরীরে ছড়িয়ে দিই। সে প্রতিবাদ করে না, খোলা চুলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। ভাল করে দেখি আমি—টানা চোখ, চিকচিকে কপোল—অনেকটা নবমীর রাতে দুগ্গা প্রতিমাকে যেমন দেখতে লাগে, ঠিক তেমন ওকে দেখতে।

তবে এসব সাঙ্গ হল। সব কিছুই তো আর একটা জীবনে পাওয়া যায় না। যেতে চাইনি, তবু যেতেই হল আমায়।

এখন আমার বয়স অনেকটাই কম। এখন আর অয়েল পেন্টিংয়ে নেশাগ্রস্ত নই। এখন আমি হোটেলে গান করি, গিটার বাজাই। ঘরের কোণায় বসে থাকা পাবলিক নই, আগের মতো আর অন্তর্মুখীও নই, ভীষণভাবে সামাজিক, হইচই করে থাকি সকলের সঙ্গে। তবে ছায়া ছায়া হয়ে ভাসতে থাকে সেই মুখ—সাদা শাড়ি, হাতে চায়ের কাপ...আমায় এসে বলছে—আপনার জন্য চা নিয়ে এসেছি... এক সময় ভিড়ের মাঝে সে মুখ হারিয়ে যায়...

এ বছর পুজোয় আমি শ্যামলেশদের গ্রামের বাড়িতে। গিটার নিয়েই চলে এসেছি। আসলে গ্রামের পুজো তো কোনওদিন দেখিনি, তাই। সবাই আমার গানে মুগ্ধ। সপ্তমী কেটেছে, অষ্টমী কেটেছে, আজ নবমী। কিন্তু কী আশ্চর্য এতো মানুষকে পেয়েও আমার মন ভাল নেই। আজ যেন খুব বেশিমাত্রায় ছায়া ছায়া হয়ে ভাসছে সেই মুখ। কখনও ছায়াটা স্পষ্টও হচ্ছে। মনে হচ্ছে উপরের চিকের আড়াল থেকে যেন লুকোচুরি খেলছে আমার সঙ্গে।

এখন বিকেল। আমি বসে আছি শ্যামলেশের ঘরে। এ বাড়িতে এই ঘরটাই আমার সব চেয়ে বেশি প্রিয়। এক মনে নানা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল। আচমকাই দরজার ওপাশে সেই শব্দ—আসব, আপনার জন্য চা নিয়ে এসেছি আমি...

আমি কোনও কথা বলিনা। নানা রঙা প্রিন্টেড শাড়ি পড়ে খোলা চুলে সে দাঁড়িয়ে আমার সামনে। ভাল করে দেখি আমি— টানা চোখ, চিকচিকে কপোল—অনেকটা নবমীর রাতে দুগ্গা প্রতিমাকে যেমন দেখতে লাগে, ঠিক তেমন ওকে দেখতে।

.