শৈশবে কাকার সঙ্গে যেতাম হালখাতায়, যৌবনে বান্ধবীরা শোনাত রবীন্দ্রনাথ, বদলে গেল কলকাতা!
রন্তিদেব সেনগুপ্ত
রন্তিদেব সেনগুপ্ত
উত্তর কলকাতার মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম। উত্তর কলকাতার অলিগলিতে কেটে শৈশব। ট্রাম লাইন ধরে ভোকাট্টা ঘুড়ি ধরতে ছুটেছি। গরমের দুপুরে ছাদে দিদির সঙ্গে খেলেছি এক্কাদোক্কা। বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁকে যেত জুইঁ ফুল, বেলফুল বিক্রেতারা। এগুলি সব হারিয়ে গিয়েছে। হারিয়ে গিয়েছে সেই শৈশব। সেই সময় নববর্ষ অন্যরকম ছিল। পাড়ায় পাড়ায় দোকানে হত হালখাতা। মনে পড়ছে কাকার হাত ধরে আমিও যেতাম। হালখাতায় গিয়ে দুটো জিনিস পাওনা ছিল। রামকৃষ্ণের ছবি দেওয়া একটা রঙিন ক্যালেন্ডার, ছোট্ট মিষ্টির বাক্স। তাতে থাকত চারটি দরবেশ। আর খেতে দিত জুসলার সফটড্রিংক। জুসলা খাওয়ার লোকে কাকার সঙ্গে চলে যেতাম। সে সময় অনেক না পাওয়া ছিল, তবে ছোট ছোট আনন্দগুলি ছিল। এগুলো নিয়েই ভালো ছিলাম।
তার পর গেলাম কলেজে। গ্রীষ্মের বিকেলে কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিট ধরে হাঁটা যে কতটা রোমাঞ্চকর, উত্তর কলকাতার মানুষরা জানেন। নববর্ষের সন্ধ্যায় বসতাম হেঁদুয়ার গোলদিঘিতে। বান্ধবীরা শোনাত রবীন্দ্রনাথ সংগীত। অল্প পয়সা থাকত। তাই দিয়ে বাদাম কিনে খেতাম। কোনওদিন পকেটে একটু বেশি থাকলে বসন্ত কেবিনের মোগলাই পরোটা। বর্ণময় ছিল পয়লা বৈশাখ। সত্যিই কলকাতাটা পাল্টা গেল! শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটা লাইন আছে,'ভুল ভুল ভুল হল, নিতান্ত উদভ্রান্ত হল খেলা, পাথরে পাথরে মেরে চলে গেল ছেলেবেলা।'
আমাদের শৈশব চলে গেল। যৌবন চলে গেল। ভোকাট্টা চলে গেল। সরস্বতী পুজোর দিন সকালে ছুটে যেতাম পাড়ার প্যান্ডেলে। দুর্গাপুজোয় সারাদিন কাটাতাম মণ্ডপেই। কলকাতা পাল্টে গেল। উত্তর কলকাতায় আর রাতে জুইঁফুল বিক্রি করতে আসে না। কুলফি মালাই আসে না। নববর্ষে পাড়ার দোকানেও আর ভিড় দেখি না। আমার ছোট্ট নাতনির সঙ্গে আমার শৈশবের বিস্তর ফারাক। খুব অল্প নিয়েই খুশিতে থাকতাম। রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে বলি,'অল্প লইয়া থাকি, তাই মোর যাহা যায় তাহা যায়।'
গতবছর থেকে অতিমারিতে আক্রান্ত বিশ্ব। সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে চলছে মানব সভ্যকা। এই সময়ে একটাই চাওয়া, মানুষ ভালো থাকুক। দ্বেষ, হিংসা, হঠকারিতা, আত্মপ্রবঞ্চনার উর্ধ্বে উঠে মানুষের মতো বাঁচুক। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের লাইন মনে পড়ছে,'মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও।' নতুন বছরে পশ্চিমবঙ্গের বয়স হবে ৭৫ বছর। আমরা সবাই নতুন বাংলাকে দেখতে চাইব। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন,'নেশন মানে নির্দিষ্ট একটি সীমারেখার ভিতরে জনপদ, অরণ্য ও নদী নয়। অতীত ঐতিহ্যকে মনে রেখে বর্তমান সংকটের সময়ে দেশগঠনে সচেতন জনগোষ্ঠীর একত্রে কাজ করাই নেশন।' নববর্ষের প্রার্থনা হোক, নতুন করে দেশগঠনের কাজে একত্রে যেন কাজ করতে পারি।
আরও পড়ুন- দুঃখ-শোক-শঙ্কার মধ্যে সবুজের ইঙ্গিতও রয়েছে! এই নববর্ষে ঘোষিত হোক তারই জয়গান