Rabindranath Tagore: তুমি কি কেবলই 'এলিট', ঠাটে লিখা? হায় ছবি, তুমি শুধু ছবি?
এরা কখনও ভুলেও বঙ্কিম পড়ে না; কিছু অতি-অতি-চেনা রবীন্দ্রসঙ্গীতই হাজারবার শুনলে-শোনালেও প্রায় কক্ষনও নজরুল-রজনীকান্ত শোনে না; এরা শান্তিনিকেতন চেনে, লাভপুরের খবর রাখে না; জোড়াসাঁকো জানে, ব্যারাকপুরের বনগ্রামের খোঁজ রাখে না!
সৌমিত্র সেন
এখন, একালের মানুষ, আমরা কী ভাবে দেখি রবীন্দ্রনাথকে? 'দেখি' না বলে কী ভাবে 'পাই'ও বলা চলে। ২৫ বৈশাখে এরকম একটা ভাবনা উঠে-পড়া খুব আশ্চর্যের নয় হয়তো।
কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীদের নিঃশর্ত উপভোগই বিধি প্রকৃত রসজ্ঞের। কোন বিশেষ পাঠকমন কোন বিশেষ শিল্পীমনের সঙ্গে কীভাবে অজান্তে আবদ্ধ হয়ে পড়ে, তার কোনও নিয়মবদ্ধ সমীকরণ হয় না। বাংলা উপন্যাসের আকাশ-বাতাস যখন শরৎসাহিত্যের তরতরে নিটোল গদ্যের অভিঘাতে স্বতঃস্পন্দিত, সেই ১৯৩৫-৪০ সময়পর্বে, তখন যদি কারও মন সহসাই জীবনানন্দের নতুন ধাঁচের উপন্যাসের চলনে সদামুগ্ধ হয়ে পড়ে, এবং সেই-মন সযত্নে শরৎসাহিত্যকে সরিয়ে রাখে, তবে কারও কিছু বলার থাকে না। শিল্পে বাছাই করার স্বাধীনতাই হল সব চেয়ে বড় স্বাধীনতা। রবীন্দ্রনাথ নিজে আধুনিক সময়কালের কবি (একইসঙ্গে পাঠকও তো!) হয়েও সদাসর্বদা ডুবে থাকতেন কালিদাসের কাব্যে, কালিদাসের টাইমফ্রেমে। এতটাই যে, তিনি বোধ হয় একরকম বাধ্য হয়েই লিখে ফেলেছিলেন এহেন পঙক্তি-- 'আমি যদি জন্ম নিতেম কালিদাসের কালে'!
কিন্তু যদি এই বাছাই করার এবং বেছে অবশেষে (কাউকে) গ্রহণ করার স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয়? মানে, যদি জনমনে উপর থেকে কিছু (কোনও লেখক-কবি-শিল্পীকে) চাপিয়ে দেওয়া হয়? এই 'চাপিয়ে দেওয়া' কথাটাকে এখানে অবশ্য খুব রূঢ় ভাবে গ্রহণ করার প্রয়োজনও নেই। সেই সুরে বলাও হচ্ছে না কথাটা। এখানে 'চাপিয়ে দেওয়া'টা হয়তো পদ্ধতিগত ভাবে খুব স্বাভাবিকও, মানে ইংরেজি শব্দমাফিক 'অবভিয়াস' আর কী! কিন্তু যে ভাবেই সেটা হোক না কেন, সেটা কি পাঠককে প্রভাবিত করে না?
দারুণ ভাবে করে। ভীষণ ভাবে করে। কী ভাবে?
ধরা যাক, আমজনতার নিজস্ব রবীন্দ্র-অভিজ্ঞতাই। আমাদের স্কুলপাঠ্যে ছোট্ট থেকেই আমরা ক্লাসে ক্লাসে রবীন্দ্রনাথ পড়ে-পড়ে বড় হই; এবং যেসব পড়ুয়ারা পরবর্তী কালে হিউম্যানিটিজ নিয়ে পড়াশোনা করেন, বা আরও পরিষ্কার করে বললে, সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁদের প্রায় চিরসম্বন্ধ রচিত হয়ে যায়, অনেকটা বরবউয়ের মতো; বরবউয়েরও হয়তো বিচ্ছেদ হয়; রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ঘটনাচক্রে সেটাও হওয়ার উপায় থাকে না আর। কেননা রবীন্দ্রনাথ 'অবভিয়াস'। বড় প্রতিভা মাত্রই এমন। যেমন শেক্সপিয়র, টিএস এলিয়ট, মির্জা গালিব। আমাদের প্রায় সব ধরনের সাংস্কৃতিক আঙ্গিকে, বিশেষ করে কাব্য়ে, গদ্যে, গানে রবীন্দ্রনাথের এমন একটা 'হিমালয়ান প্রেজেন্স' যে, আমরা প্রায় সারাজীবন এর থেকে সচেতন ভাবে বেরতে পারি না। বেরতে চেষ্টাও করি না!
আমরা কবিতা পড়তে গেলে বা পাঠ-আবৃত্তি ইত্যাদি করতে গেলে ৯৯ বার রবীন্দ্রনাথের কবিতাই পড়ি-বলি; আমরা গান শিখতে গেলে তাঁর রচিত গানই প্রথম 'তুলি'; আমরা নাচ শিখতে গেলেও তাঁর প্রবর্তিত নাচেই প্রথম অভ্যস্ত হই! এমনকী নাটক, ছবি-আঁকা, ছন্দ, ভাষাতত্ত্ব, শিক্ষা-- ইত্যাদি ক্ষেত্রেও তাঁর নাগাল এড়াতে পারি না। আর যুগ যুগ ধরে যিনি এমন সর্বগ্রাসী প্রতিপত্তি নিয়ে সদাজাগরূক তিনি আমাদের কাছে আর বাছাইয়ের স্বাধীনতার মধ্যে দিয়ে আসেন না, তাঁকে আমরা সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা ও মুগ্ধতায় আদ্যন্ত স্বীকার করে নিই, না করে পারি না। কোনও এক জাতির সাংস্কৃতিক যাপনে এমনটা যখন ঘটতে থাকে, তখন যাঁকে ঘিরে এটা হয়, তিনি ক্রমশ এক অতুলনীয় এলিট উচ্চতায় উঠে পড়েন, একটা আবশ্যিক সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞানের সঙ্গে চির-অন্বিত হয়ে পড়েন। তখন তিনি একই সঙ্গে 'মাস্ট' ও 'ম্যাসিভ', 'ক্লাস' ও 'ক্লাসিক'। তখন অনিচ্ছাকৃত ভাবে তিনি যেন পরোক্ষে গণমনে অন্য কোনও কবি-লেখক-সাহিত্যিক-শিল্পীর প্রবেশের পথরোধ করে দাঁড়িয়ে পড়েন।
আর যখনই এটা ঘটে, তখন এবার বিষয়টি উল্টো দিক থেকে দেখার পালা শুরু করতে হয়। যে-সময় পর্বের মধ্যে দিয়ে নানা ভাবে গৃহীত-বর্জিত-অভিনন্দিত-চর্চিত হতে হতে একজন ক্রমশ এই উচ্চতায় ওঠেন, সেই সময়-পর্বটা কেটে গেলে, তার পরের সময়কার মানুষজন তখন সেই কবি-শিল্পী-লেখকককে এক অপরিহার্য সাংস্কৃতিক আইকন হিসেবেই দেখেন, অনুভব করেন তাঁর দুর্মর সাংস্কৃতিক ওজন, তাঁর সার্বিক প্রতিপত্তি; তখন তাঁরাও চান কোনও না কোনও ভাবে এর সঙ্গে নিজেকে/নিজেদের যুক্ত করতে।
বিষয়টার একটু ব্যাখ্যা জরুরি। ধরা যাক, কোনও লেখক বা চিত্রপরিচালক বা অন্য বিশিষ্ট কেউ তাঁর নিজস্ব কোনও কথা বলতে চাইছেন। এটা করতে গিয়ে তিনি আর সব ছেড়ে দিয়ে আইকন ও এলিট হয়ে ওঠা সেই মানুষটিকেই সর্বাগ্রে ব্যবহার করেন। অনেক সময়ই এটা বোঝাতে যে, তিনি এই চর্চাটার মধ্যে ঘোরতর ভাবে আছেন। অর্থাৎ, এর মধ্যে দিয়ে তিনি তাঁর নিজের এলিটত্বও খানিক তুলে ধরতে চাইলেন। আমাদের ছায়াছবিতে কারণে-অকারণে এত-এত রবীন্দ্রসঙ্গীত কেন ব্যবহৃত হয় সবসময়? ছবির যে-সিচুয়েশনে বিশেষ সেই রবীন্দ্রগানটিকে ভাবা হচ্ছে, তার বদলে সেখানে কি সহজেই একটি অতুলপ্রসাদি বা দ্বিজেন্দ্রগীতি বা নজরুল-রজনীকান্ত ব্যবহার করা যায় না? গেলেও আমরা করি না, কেননা, আমরা জানি, দৃশ্যায়নে একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত থাকলে মানুষ সেটাকে যেভাবে নেবে, অন্য কাব্যগীতিতে সেটা ঠিক সেই ভাবে হবে না!
এটা একটা বিচ্ছিন্ন উদাহরণ। রবীন্দ্রসঙ্গীত এমন উচ্চমানের সৃষ্টি যে তাকে লক্ষ বার চর্চা করা যায়, ব্যবহার করা যায়। রবীন্দ্ররচনাও তাই। কিন্তু তাই বলে এলিটত্বের গোলকধাঁধায় ফেঁসে গিয়ে আমরা যদি নিরন্তর শুধু সেটাই করতে থাকি, তা হলে আমাদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যটাই নষ্ট হয়, সেটা একটা একরৈখিক বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। এটা যে কত বড় সত্যি, তা আজকের সমাজের তরুণ প্রজন্মের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। এরা সঞ্চয়িতা-গীতাঞ্জলির সামান্য কিছু পাতা ওল্টালেও কখনও ভুলেও বঙ্কিম পড়ে না; কিছু অতি-অতি-চেনা রবীন্দ্রসঙ্গীতই হাজারবার শুনলে-শোনালেও প্রায় কক্ষনও নজরুল-রজনীকান্ত শোনে না; এরা শান্তিনিকেতন চেনে, লাভপুরের খবর রাখে না; জোড়াসাঁকো জানে, ব্যারাকপুরের বনগ্রামের খোঁজ রাখে না!
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমাদের ভাষা-সংস্কৃতিতে যে চর্চা-উদযাপনটা হয়, সেটাই কাম্য; সেটা বরং আরও আরও গভীর-ব্যাপক-বিপুল-বিশাল হওয়াই বাঞ্ছনীয়; কিন্তু তাই বলে আমরা আমাদের ভাষা-সাহিত্য-সঙ্গীতের অন্য সব আঙ্গিক-অনুষঙ্গকে সম্পূর্ণ ভুলে চৌপাট করে ফেলব, এটাও কোনও কাজের কথা নয়। অথচ, সেটাই হচ্ছে। আমাদের সাংস্কৃতিক মানসে রবীন্দ্রনাথের স্থান এমন এক প্রশ্নহীন ঠাটে স্থিত হয়ে পড়েছে, তা এমন এক আলোকোজ্জ্বল এলিটত্বে পরিপ্লাবিত হয়ে থাকছে যে, রবীন্দ্রনাথকে আমরা আর নিজেদের যোগ্যতায় আবিষ্কার করার শ্রম স্বীকার করি না; অধিকাংশ সময়েই পরের মুখে ঝাল খেয়ে তাঁকে গ্রহণ করি, বাছাইয়ের স্বাধীনতার মুক্ত মননের পথে নয়। যা সার্বিক ভাবে আমাদের সাংস্কৃতিক দৈন্যেরই সূচক।
আরও পড়ুন: Mother’s Day: আনন্দময়ী, নারায়ণী, শ্যামাদের চেনেন তো? মাদার্স ডে'তে দেখে নিন, কোথায় থাকেন তাঁরা