সরকারি ফতোয়া ঘিরে ক্ষোভ বিভিন্ন মহলে, তীব্র নিন্দা শঙ্খ ঘোষের
সরকারি গ্রন্থাগারে কোন কোন সংবাদপত্র রাখা যাবে, তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে রাজ্য গ্রন্থাগার দফতরের সাম্প্রতিক নির্দেশিকায়। সরকারের বিশেষ পছন্দের তালিকায় রয়েছে মোট ৮ টি সংবাদপত্র।
সরকারি গ্রন্থাগারে কোন কোন সংবাদপত্র রাখা যাবে, তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে রাজ্য গ্রন্থাগার দফতরের সাম্প্রতিক নির্দেশিকায়। সরকারের বিশেষ পছন্দের তালিকায় রয়েছে মোট ৮ টি সংবাদপত্র। সেগুলি হল- সংবাদ প্রতিদিন, সকালবেলা, খবর ৩৬৫ দিন, একদিন, দৈনিক স্টেটসম্যান, সন্মার্গ, আখবার-ই-মশরিখ এবং আজাদ হিন্দ। নির্দেশিকায় স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে সরকারি গ্রন্থাগারগুলি শুধুমাত্র এই সংবাদপত্রগুলিই রাখতে পারবে। এর বাইরে অন্য কোনও সংবাদপত্র কেনার জন্য অর্থ বরাদ্দ করবে না সরকার। সরকারের পছন্দের তালিকা থেকে বাদ পড়েছে রাজ্যের প্রথম সারির একাধিক সংবাদপত্র। মানুষের পছন্দের তালিকার শীর্ষে থাকা আনন্দবাজার পত্রিকা, বর্তমান, আজকাল, ইংরাজি খবরের কাগজ দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, দ্য টেলিগ্রাফ, হিন্দুস্তান টাইমস, দ্য হিন্দুর মতো সংবাদপত্রগুলিকে ব্রাত্য করেছে সরকার। গ্রন্থাগারমন্ত্রী আব্দুল করিম এদিন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন কোনও অবস্থাতেই নির্দেশিকা প্রত্যাহার করা হবে না।
এই নির্দেশিকাকে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ বলেই মনে করছেন বর্ষীয়ান সাংবাদিকরা। এই ঘটনাকে সাতের দশকের জরুরি অবস্থার সময় সংবাদমাধ্যমের কন্ঠরোধের সঙ্গে তুলনা করেছেন তাঁরা। কড়া ভাষায় সরকারি নির্দেশিকার সমালোচনা করে সাংবাদিক শিখা মুখার্জি বলেন, "এটা এক ধরণের সেন্সরশিপ। ইংরেজিতে একটা কথা আছে 'থট পুলিসিং'। মানে চিন্তাভাবনার ওপরে এক ধরনের নজরদারি। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আমরা যখন জরুরি অবস্থাকে কালো অধ্যায় হিসাবে চিহ্নিত করি, তখন এই ধরনের নির্দেশিকা নিন্দনীয়।"
সাংবাদিক সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত বলেন, "মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করছেন সংবাদপত্র আটকে দিয়ে উনি পঞ্চায়েত নির্বাচন জিততে পারবেন। কিন্তু মানুষই শেষ কথা বলে। যে সার্কুলার বেরিয়েছে, আমি মনে করি তা মারাত্মক অপরাধ। গণতন্ত্রের প্রতি আঘাত। সংবিধানের প্রতি আঘাত।"
তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে কবি শঙ্খ ঘোষ বলেন, "এই প্রবণতাটাকে আমি বিপজ্জনক বলে মনে করি। পক্ষ-বিপক্ষ সমস্তরকম মত জানবার পথ খোলা রাখা উচিত। এর চেয়ে বেঠিক কাজ আর কী হতে পারে?"
সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, "সরকার নির্দেশিকা জারি করে মানুষকে কোনও কিছু যেমন পড়াতে পারে না, তেমনি কোনও কিছু পড়তে বাধাও দিতে পারে না। সরকারি গ্রন্থাগারের সামর্থ থাকলে তাদের সমস্ত খবরের কাগজই রাখা উচিত।"
সাহিত্যিক সুচিত্রা ভট্টাচার্য বলেন, "ব্যাপারটি অগণতান্ত্রিক, তাই কোনও ভাবেই মেনে নিতে পারছি না।"
অভিনেতা বাদশা মৈত্র বলেন, "এই সার্কুলার মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারে সরকারি হস্তক্ষেপ।"
নাট্যব্যক্তিত্ব রূদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত বলেন, "এসব বিষয়ে সরকার যত কম হস্তক্ষেপ করে ততই ভাল।"
কংগ্রেসী সাংসদ অধীর চৌধুরীর কটাক্ষ, "বাংলার মানুষ হার্মাদের সরকার হঠিয়ে উন্মাদের সরকার আনল কি না সন্দেহ হচ্ছে। অবিলম্বে এই সার্কুলার প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি।"
অভিনেতা কৌশিক সেন বলেন, "যে দলতন্ত্রের বিরোধিতা করে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসছে, তারা সেই দলতন্ত্রেরই পুনঃপ্রতিষ্ঠা করছে। এভাবে কোনও কাগজ পড়া আটকানো যায় না। গ্রন্থাগারে না পেলে মানুষ বাইরে থেকে কিনে পড়বে।"
তৃণমূল সাংসদ কবীর সুমন বলেন, "নীতি নির্ধারণের জায়গায় থাকলে আমি এই সিদ্ধান্ত নিতে দিতাম না। সরকার ক্ষমতা জাহির করছে। তবে, আমি এই সরকারকে ফ্যাসিস্ট বলতে পারব না। এটা একটা ভুল রাজনৈতিক পদক্ষেপ।"
রাজ্যসরকারের তরফে যে সংবাদপত্রগুলিকে গ্রন্থাগারে রাখার ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে তার তালিকায় প্রথমেই রয়েছে সংবাদ প্রতিদিনের নাম। যার সম্পাদক এবং অ্যাসোসিয়েট সম্পাদক ২জনেই তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভার সাংসদ। তালিকাভুক্ত হিন্দি দৈনিক সন্মার্গ এবং উর্দু দৈনিক আখবর-ই-মাশরিখের সম্পাদকও সম্প্রতি তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ হয়েছেন। বাংলা দৈনিক সকালবেলা উর্দু দৈনিক আজাদ হিন্দ যে গোষ্ঠী পরিচালনা করে, সেই গোষ্ঠীর মিডিয়া সিইও সংবাদ প্রতিদিনের অ্যাসোসিয়েট সম্পাদক। বাকি ৩টি বাংলা দৈনিক, খবর ৩৬৫দিন, একদিন এবং দৈনিক স্টেটসম্যানের পরিচালক বা কর্ণধাররাও রাজ্যের বর্তমান শাসকদলের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত।
বিভিন্ন সময় মুখ্যমন্ত্রী নিজেই সংবাদমাধ্যমকে তাঁর আক্রমণের নিশানা করেছেন। কিন্তু সরকারি নির্দেশিকা জারি করে পছন্দের সংবাদপত্র নির্দিষ্ট করে দেওয়ার ঘটনায় রাজ্যজুড়ে তৈরি হয়েছে তীব্র প্রতিক্রিয়া।