সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় ইস্যুতে সিপিএম-এ দ্বন্দ্ব প্রকট
"সুযোগ হারালাম। আর সময় দিলেন না সোমনাথবাবু। মিটিং শুরুর আগেই চলে গেলেন।"
মৌমিতা চক্রবর্তী
মৃত্যুর পরেও সিপিএমের অন্দরে বিতর্কের কেন্দ্রে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। কেন সোমনাথকে দলে ফেরানো সম্ভব হল না? তা নিয়ে লাল পার্টির অন্দরে অব্যাহত অসন্তোষ। রাজ্য নেতাদের একটা বড় অংশ এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় কমিটিকে চিঠি দিচ্ছে।
সালটা ২০০৮। সিপিএম পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হল বর্ষীয়ান নেতা তথা ১০ বারের সাংসদ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে। প্রথম ইউপিএ সরকারের উপর থেকে সিপিএম যখন সমর্থন প্রত্যাহার করে নিল, তখন পার্টি লাইনের বিপক্ষে গিয়ে নিজের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে অটল থাকেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। দল তাঁকে নির্দেশ দিয়েছিল, অধ্যক্ষের আসন থেকে পদত্যাগ করতে। কিন্তু, সেই দলীয় নির্দেশকে উপেক্ষা করেন বরাবর দলীয় অনুশাসন মেনে চলা সোমনাথ। অটল থাকেন নিজের দায়িত্বে ও সাংবিধানিক কর্তব্যের প্রতি। এরপরই সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয় সিপিএম পার্টি। কিন্তু বহিষ্কারের পরেও নির্দল স্পিকার হিসেবে কাজ চালিয়ে যান সোমনাথবাবু। আর এ ভাবেই সাংবিধানিক গণতন্ত্রে নিজেকে এক অনন্য চরিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন বোলপুরের প্রাক্তন সাংসদ।
আরও পড়ুন, আলিমুদ্দিনের নেতাকে দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়েন সোমনাথ পুত্র প্রতাপ! বিনয় দেখালেন বিমান
দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সোমনাথ চ্যাটার্জিকে বহিষ্কারের এই কঠোর সিদ্ধান্ত যে বাংলার মধ্যবিত্ত ভোটব্যাঙ্কে চরম প্রভাব ফেলবে তা হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলেন সিপিএম-এর রাজ্য নেতাদের একাংশ। সেই দলে ছিলেন জননেতা সুভাষ চক্রবর্তীও। কিন্তু নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাস, ২০০৯ সালে মৃত্যু হয় সুভাষ চক্রবর্তীর। এর ২ বছর পর ২০১১ সালে সত্যি হয় সুভাষ চক্রবর্তীর মতো আরও অনেক সিপিএম রাজ্য নেতাদের সেই আশঙ্কা। ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল সরকার।
এরপর থেকে রাজ্য রাজনীতিতে সিপিএম-এর ক্ষয়িষ্ণু গ্রাফ যত নীচে নেমেছে, ততই দলের অন্দরে জোরদার হয়েছে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মতো জনপ্রিয় নেতাকে দলে ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব। দলীয় সূত্রে খবর, সোমবার রাজ্য কমিটির বৈঠকে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে দলে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে ফের প্রস্তাব ওঠার কথা ছিল। কিন্তু সে সময় আর মিলল না। বার্ধক্যজনিত অসুখে ৮৯ বছর বয়সে সোমবার-ই প্রয়াত হন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিপিএম-এর এক নেতা আক্ষেপ করে বলেন, "আমরা সুযোগ হারালাম। আর সময় দিলেন না সোমনাথবাবু। মিটিং শুরুর আগেই তিনি চলে গেলেন। কোথায় মিটিংয়ে তাঁকে ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব উঠত, সেখানে শোকপ্রস্তাব পাঠের পর মিটিং স্থগিত করে দেওয়া হল।" ওই নেতা জানিয়েছেন, সোমনাথের মৃত্যুর আগেরদিন অর্থাত্ রবিবার রাতেও সিপিএম-এর অন্দরে সোমনাথবাবুকে দলে ফিরিয়ে আনা নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়। আলোচনা করেন রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর কয়েকজন সদস্য।
আরও পড়ুন, সোমনাথের প্রয়াণে রাজ্য কমিটির বৈঠক মুলতুবি করল সিপিএম
সিপিএম রাজ্য কমিটির সদস্য কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, "আমার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ ছিল। তাঁকে দলে ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা নানাভাবে চেষ্টা করি। কিন্তু শুধুমাত্র কেরালা লবির জন্য আমাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। কিন্তু এবার দলের বোঝা উচিত যে জ্যোতি বসু যেটা বলেছিলেন, সেটাই ঠিক। জ্যোতি বসুর লাইন-ই আমাদের অনুসরণ করা উচিত।"
দলীয় সূত্রে খবর, রাজ্য নেতাদের একটা বড় অংশ কেন্দ্রীয় কমিটিকে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চিঠিতে তাঁদের অসন্তোষের কথা উল্লেখ করা হবে। উল্লেখ করা হবে সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটি ও পলিটব্যুরোর কিছু ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্তের কথা। ৮০ বছরের বিমান বসুকে যেমন ব্যতিক্রমীভাবে পলিটব্যুরোতে রাখা হয়েছে, ঠিক তেমনটাই যে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বেলাতেও করা যেত তা স্পষ্ট করে জানানো হবে চিঠিতে। খুব শিগগিরই এই চিঠি দিল্লিতে পাঠানো হবে।
আরও পড়ুন, ‘বিচ্যুত সোমনাথকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত সঠিক’, বলেছিলেন কারাত
দৃশ্যতই সোমনাথ বিতর্কে বিব্রত সিপিএম। বিতর্ক যে সহজে পিছু ছাড়বে না, সোমবার তাঁর বাড়িতে গিয়ে প্রতি মুহূর্তে বুঝেছেন রাজ্যের সিপিএম নেতারা। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মরদেহের উপর সিপিএম-কে পতাকা রাখার অনুমতি দেয়নি পরিবার। এমনকি বিমান বসুকে বাড়ি থেকে চলে যেতেও বলেন সোমনাথবাবুর ছেলে প্রতাপ চট্টোপাধ্যায়। এখন রাজ্য কমিটির এই চিঠি কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে পৌঁছনোর পর, এটা নিশ্চিত যে কেন্দ্রীয় কমিটির আগামী মিটিংয়ে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় ইস্যুতে বড় ঝড় উঠতে চলেছে।