পেত্নীর সহিত প্রেত-যাপন
কথাটা পাড়তে দেবরাজের তো আক্কেল গুড়ুম। ঢিসুম করে না আমার নাকটাতে পাঞ্চ করে বসে। যা হিরো হিরো চেহারা। তা এমন মাচো ম্যানের কাছে সুন্দরী পেত্নীর হদিস থাকবে না, তা কি হয়!
দিব্যেন্দু ঘোষ
ভূত চতুর্দশীতে তেনাদের কথা বলার আগে একটিবার মনের দরজায় টোকা মেরে নেওয়া। সেই খাড়া বড়ি থোড় আর থোড় বড়ি খাড়া। সেই চোদ্দ শাক। সেই চোদ্দ পিদিম। সেই চোদ্দ পুরুষ। অশুভ শক্তিতে খেদানোর চিরকেলে রেওয়াজ। চোদ্দ পুরুষের অতৃপ্ত আত্মাকে নাকি তুষ্ট করতে হয়। তবে, প্রশ্ন একটাই। পুরুষ কেন? নারীদের কথা একটু বেশি বললে ক্ষতি কী ! কেন নয় চোদ্দ নারী? চোদ্দ নারী বলতে কি আপত্তি আছে? তেনাদের কিন্তু থাকতে পারে। ওই যে, যাঁরা ঘাড় মটকান। আরও অনেক কিছু মটকান। আত্মাকে তুষ্ট করতে না পারলে সটান ঘাড়ে টান। মটাং করে একটা আওয়াজ। ব্যস। ওনাদের এর বেশি আর কিছু করতে হয় না। করুক গে যাক। প্রেতাত্মা আমার ঘাড়ে ভর করলে ভারী বয়েই গেছে। উম্, দিনের আলোয় বুক ফুলিয়ে ফুট কাটা সোজা। ভূত চতুর্দশীতে রেতের বেলায় বলেই দেখুন না ! চামড়া ছাড়িয়ে আমড়া গাছে তেনারা টাঙিয়ে রাখবেন মাত্র কয়েক সেকেন্ডে।
হাওয়ায় হিম। আর ভূত দেখে রক্ত হিম। সব ব্রহ্মদত্যি, পেত্নী, শাকচুন্নীদের এদিন পার্টি টাইম। পেত্নী বা শাকচুন্নীদের কথা বললে কেমন যেন হার্টের ধুকপুকুনিটা বেড়ে যায়। আর সেই শাকচুন্নীর দল যদি সিলিম আর সেকসি হয়, তো কথাই নেই। বেল গাছে মিনি স্কার্টে সুশোভিত পেত্নীর দল যদি পা ঝুলিয়ে কেত্তন করে, তো সেই গাছের নীচে হাজার বার যাওয়া আছে। হোক না ন্যাড়া মাথা। একবার নয়। চোদ্দবার যাব। চোদ্দ শাক খেয়ে যে বুকে আর বাম উরুতে বেজায় বল। উরু ঠিক আছে। কিন্তু বাম উরু কেন? বলছি একটু পর।
পেত্নীর সহিত প্রেত-যাপন বলে কথা!
যম-প্রদীপের আলো দেখলে কি পেত্নীর মুখ একটু কালোপানা হয়ে যায়? যমরাজ প্রসন্ন হয়ে যদি মৃত ব্যক্তির আত্মাকে মুক্তই করে দেন, তাহলে যে সহ-বাসটাই মাটি। সে গপ্পে আসার আগে একটু পুরাণের পাতা ওল্টাতেই হয়।
দানবরাজ বলি যখন স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল দখল করে নিলেন, তখন নির্বিচারে শুরু হয়ে গেল হত্যালীলা। তাঁর আক্রোশ থেকে পার পেলেন না দেবতারাও। মানুষ তো দূর ছাই, বলির তাণ্ডব ঠেকাতে দেবগুরু বৃহস্পতি ভগবান বিষ্ণুকে একটা উপায় বাতলে দিলেন। বামনের ছদ্মবেশে তখন নেমে এলেন বিষ্ণু। তিন পা সমান জমি ভিক্ষা চাইলেন রাজা বলির কাছে। দানবরাজ কিন্তু শুরুতেই বুঝেছিলেন এই বামন আর কেউ নন, স্বয়ং বিষ্ণু। কিন্তু এর পরেও না বোঝার ভান করে বামনের পাল্লায় পড়ে ঠিকই রাজি হলেন চুক্তিতে। দুই পা দিয়ে স্বর্গ ও মর্ত্য দখল করে ফেললেন বিষ্ণু। এরপর নাভি থেকে বেরিয়ে এল আরেক পা। সেটি রাখলেন বলি রাজার মাথার ওপর। সঙ্গে সঙ্গেই পাতালে নেমে গেলেন দানবরাজ। সেই থেকে পাতালই হল তাঁর আবাস। তবে জেনেশুনে জমি দান করায় আর ভগবানের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করায় বলির জন্য একটা বিশেষ সুবিধা রেখে দিলেন বিষ্ণু। প্রতি বছর মর্ত্যে, অর্থাত্ পৃথিবীতে তাঁর পুজো করবে মানুষ। সেই থেকে কালীপুজোর আগের রাতে বলি রাজা পাতাল থেকে উঠে আসেন পুজো নিতে। তাঁর সহচর হিসাবে থাকে হাজার হাজার ভূত। প্রেতাত্মা আর অশরীরি।
প্রেতাত্মা আর অশরীরীর হাত থেকে কি পরিত্রাণ নেই? ওই যে চোদ্দ শাক। ওল, কেঁউ, বেতো, সর্ষে, কালকাসুন্দে, নিম, জয়ন্তী, শাঞ্চে, হিলঞ্চ, পলতা, শৌলফ, গুলঞ্চ, ভাটপাতা আর শুষনি। এই চোদ্দ শাক একসাথে ভেজে মচমচিয়ে খান। যে জল দিয়ে চোদ্দ শাক ধুয়েছেন, সেই জল বাড়ির অন্ধকার কোণে ছেটান। লাঞ্চে চোদ্দ শাক ভাজা, সূয্যিমামা পশ্চিমে হেলে পড়লে চোদ্দ প্রদীপ, দরজায় চোদ্দ ফোঁটা। ব্যস। ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো ফুড়ুত্। তেনারা কি উড়তে পারেন? লাখ টাকার প্রশ্ন। তাহলে এক গাছে থেকে আরেক গাছে ঝটাকসে ল্যান্ড করেন কী করে ! ওনাদের ঠ্যাং নাকি লম্বা হয়। ইল্লি আর কী ! যখন বেঁচে-বর্ত্যে ছিল, তখন কী সুন্দর ছিল পা দুটো। ফর্সা। গোছালো। পেলব। মখমলি। আর আঙুলগুলো? ঠিক যেন পদ্মডাঁটি। সেক্সি কি আর সাধে। মৃত্যুর পর সেই ঠ্যাং গেল লম্বা হয়ে? বললেই হল ! সিড়িঙ্গে, ধিড়িঙ্গে পা দুটো বেল গাছের ডাল থেকে ঝুলে থাকলে সটান মাথায় এসে ঠেকে। বেঁচে থাকতে মাথায় ঠেকানোর জো ছিল না। এখন তো সেই বেল গাছ।আর আমি ন্যাড়া। তবুও বেলগাছের নীচে যাই চোদ্দবার। সুন্দরী পেত্নীর মিনিস্কার্টের ঘের মাপতে।
সেই পেত্নীর সহিত প্রেত-যাপন !
কথাটা পাড়তে দেবরাজের তো আক্কেল গুড়ুম। ঢিসুম করে না আমার নাকটাতে পাঞ্চ করে বসে। যা হিরো হিরো চেহারা। তা এমন মাচো ম্যানের কাছে সুন্দরী পেত্নীর হদিস থাকবে না, তা কি হয়! একটু পরেই বুঝলাম, ঠিক লোককেই পাকড়েছি। টাইটেল যদিও পাকড়াশি নয়। তবুও পাকড়েছি তো। দেবরাজ রাজি। চন্দ্রাভিযানে! আসলে অভিযানটা এমন দিনে, যেদিন চন্দ্র ঠিক তার অবস্থান বুঝে উঠতে পারে না। খালি লুকিয়ে পড়ার তাল খোঁজে। ঘোর অমাবস্যা না হলে যে তেনারা দেখা পান না। তাই অমাবস্যায় দেবরাজদের সঙ্গ নিলাম। অতিপ্রাকৃত ব্যাপার-স্যাপার নিয়েই যাদের কাজ-কারবার। ডিটেকটিভস অফ সুপার ন্যাচারাল। দেবরাজের সঙ্গে ঈশিতা, সুমন, অরিন্দম, শুভজিত্ আর কনিষ্ক।
উল্টোডাঙায় উল্টোরাত
দেবরাজ বলল, চলো উল্টোডাঙা। পেত্নীর সঙ্গে দেখা হওয়ার সমূহ চান্স। উল্টোডাঙা! আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। ভাববেন না আবার, আমিও মরে ভূত হয়ে গেছি, আর টপ করে আকাশ থেকে খসে পড়লাম। পেত্নীর সঙ্গে রাত না-কাটিয়ে মরেও শান্তি পাব না। বেগুনকোদর বা বোলপুরের রায়বাড়ি কিংবা ভানগড় প্রাসাদ বা কালিম্পঙের মর্গান হাউস ছেড়ে শেষে কিনা উল্টোডাঙা! ধুমধাড়াক্কা সব ঘরবাড়ি, রাস্তায় বেজায় হুল্লোড়, বাস-ট্যাক্সির গমগমাগম, কু ঝিক ঝিক ট্রেনের আওয়াজ ছাড়িয়ে ভূত গলার নাগাল পাওয়ার তো কথাই নয়। কিন্তু দেবরাজ কনফিডেন্ট। ছানা নিয়ে নাকি বাস করে এক বাইজি। থুড়ি পেত্নী। মনটা কেমন যেন ছ্যাঁক করে উঠল। পেত্নী ছেড়ে রাতবিরেতে শেষকালে বাইজির খপ্পরে পড়লে নাচ না-দেখিয়ে ছাড়বে না। সেই ইংলিশ প্রবাদ বিশ্বাস করতে পারছি না..... Dead men tale no tales. মানে অশরীরিরা নাকি গল্প বলে না। আরে বাইজির সঙ্গে মোলাকাত হলে গপ্পো না-বলুক, নাচ তো দেখাবেই, সঙ্গে ছম্মক ছল্লো গান।
তো ঘোর অমাবস্যার রাতে উল্টোডাঙার সেই জমিদারবাড়িতে হানা দিলাম। ভাঙাচোরা কাঠের দরজা। মাকড়সার জালে ঢাকা। শ্যাওলা ধরা ইটের পাঁজা। ভেতরে ঢুকতেই কয়েকটা কুচকুচে কালো চামচিকে ছাদ থেকে খসে পড়ল।সঙ্গে সঙ্গেই পিছনের দিকে কুয়োয় কে যেন লাফ দিয়ে পড়ল ঝপাং করে। কোথাও কোনও ঝড়-বাদল নেই। অথচ টানা বারান্দার একেবারে শেষে লোহার গেটটায় যেন ক্যাঁচ করে আওয়াজ হল। ছুটে গিয়ে দেখলাম, গেটে তালা। জং পড়ে গেছে। জলসাঘরের মাঝে দাঁড়াতে আস্তে আস্তে ইতিহাস জীবন্ত হয়ে উঠছে। নোনা-ধরা দেওয়াল থেকে যেন ঠিকরে আসছে মেহের আলির কণ্ঠস্বর.... তফাত যাও! সব ঝুট হ্যায়! ওপাশের অন্ধকার জাঁকিয়ে বসা সিঁড়ি থেকে ছুটে আসছে ওয়াল্টার ডে লা মেয়ার-এর অমর কবিতা "দ্য লিসনার্স'-এর আবৃত্তি। সঙ্গে ঘুঙুরের শব্দ। বুকফাটা আর্তনাদ....ছেড়ে দাও আমায়.......না....ছেড়ে দাও। ককিয়ে উঠল এক দুধের শিশু। কী হচ্ছে এসব! দরদর করে ঘাম বাইছে। শিরদাঁড়া বেয়ে নামছে ঠান্ডা স্রোত। দেবরাজ বলে উঠল, ম্যাগনেটিক ফিল্ড ফ্লাকচুয়েট করছে। হু হু করে নামছে টেম্পারেচার। ঠিক তখনই বিশাল ঘরের এক কোনায় খসে পড়ল ছাদের চাঙড়। ছাদে কে যেন হেঁটে বেড়াচ্ছে। ছাদে ওঠার ইচ্ছা স্থগিত রাখতে হল।
রমণীর দীর্ঘশ্বাসের শব্দ যেন হিস হিস করে কানে এসে ঢুকছে। শরদিন্দুর ভূত-অন্বেষী বরদার কথা মনে পড়ছে। তিনি থাকলে বেশ হত। দেবরাজরাও দক্ষ সন্ধানী। নানা রকম যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করে। আমি ফ্লাক্স থেকে ঘন ঘন চা খাচ্ছি আর সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছি। একটু যেন চোখটা জুড়িয়ে এসেছিল। চোখ খুলতেই আত্মারাম খাঁচাছাড়া। কেউ কোত্থাও নেই। মিশমিশে অন্ধকার চিরে শুধু একটা অবয়ব। এক সুন্দরী রমণীর মুখ যেন হাওয়ায় ভাসছে। ঘুলঘুলির ফাঁক দিয়ে নেমে এল যেন। শুধু একটা আবছা নারী-মুখ। কী করব বুঝে উঠতে না পেরে দৌড়নোর চেষ্টা করলাম। দড়াম করে দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়লাম। চোখ খুলতে দেখলাম এক নারীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে। একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে মুখটা। সম্বিত ফিরতেই চিত্কার করে জ্ঞান হারালাম।
কানে যেন কোনও নারীকণ্ঠের আলাপ....অত্যাচারী জমিদাররা আমায় নিয়ে এসেছিল নাচ দেখবে বলে। তারপর ওরা আমার সর্বনাশ করে। তারপর ওই পেছনের কুয়োয় ফেলে দেয়। আমি একা নয় বাবু, আমার মতো আরও অনেক মেয়ের অতৃপ্ত আত্মা ওই কুয়োয় গুমরে মরছে। এই জমিদার বংশ শেষ হয়ে যাওয়ার অভিশাপ দিয়েছিলাম। কিন্তু ওরা থামেনি।
চোখ খোলার চেষ্টা করলাম। বাড়িময় তখন লক্ষ ঘুঙুরের আওয়াজ। কখনও ঠিক আমার পাশে। কখনও আবার সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছে। কখনও ছাদে। তারপর ঝপাং করে একটা শব্দ। সব চুপ। নিস্তব্ধ। নিঝঝুম। যেন পিন পড়লেও শব্দ শোনা যায়। ঠিক তখনই দেবরাজদের দেখলাম। ওরা নাকি এখানেই ছিল। তাহলে এতক্ষণ দেখতে পাইনি কেন? ঠিক তখনই ঘরের কোণে দেখা গেল এক জোড়া ঘুঙুর। তাতে ধুলোর আস্তরণ। কই, আমরা যখন ঘরে ঢুকেছিলাম, তখন দেখিনি তো। কিচ্ছু ছিল না কোথাও। দেবরাজের হাতের ইনফ্রা রেড থ্রি সিক্সটি ডিগ্রি ক্যামেরায় তখন একের পর এক ছবি উঠতে শুরু করেছে। ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক ফিল্ড ডিটেক্টর, ইলেকট্রনিক ভয়েস ফেনোমেনা, এক্সটারনাল থার্মোমিটার, মোশন সেন্সর, আলট্রা ভায়োলেট লাইট টর্চ....দেবরাজের কোনও কথাই কানে ঢুকছে না। সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে একটা নারী-মুখ। টানা টানা চোখ। টিকলো নাক। দুগালে মিষ্টি দুটো টোল। রক্তবর্ণ দুই ঠোঁট আর নিটোল এক চিবুক। তার নীচে আর কিচ্ছু নেই। নেই কোনও শরীর। সব অ-শরীর।