Durga Puja 2022: না জেনেই বরাবর অসুর সম্প্রদায়কে অপমান করে এসেছি আমরা! এবার বন্ধ হোক...
Durga Puja 2022: আসলে মূলস্রোতের নিজস্ব সমাজ-রাজনীতি সব কালে সব দেশেই সমাজের 'অপর'-এর মাথার উপর ছড়ি ঘোরাতে চায়। মেনস্ট্রিম বরাবরই বর্গ-বিভাজনে বিশ্বাসী। যে কোনও বর্গহীন অস্তিত্বই সমস্যা তৈরি করে। সেই সমস্য়া থেকে বেরনোর শর্টকাট খোঁজে সে।
সৌমিত্র সেন: 'অসুর' শব্দটি নিয়ে মূলস্রোতের সংকটের শেষ নেই। বিষয়টিকে তারা না পারে গিলতে, না পারে উগরোতে। আপাতত, মেনস্ট্রিম একটা সহজ সমীকরণ ছকে ফেলেছে-- যা কিছু নেতিবাচক, যা কিছু খারাপ, যা কিছু অশুভ ও অমঙ্গলকর নির্দ্বিধায় তা-ই অসুর। তাই করোনা নামক অ-ভূতপূর্ব মারণ ভাইরাসটি যখন পৃথিবীকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল তখন দুর্গাপুজোয় তাকে 'অসুর' বানাতে দ্বিধা করেনি মেনস্ট্রিম। গত পুজোয় 'করোনাসুর' তো রীতিমতো হিট! আর চিরকালই পুজোর সময়ে বৃষ্টি হলে নির্ঝঞ্ঝাটে তাকে 'অসুর' বলেই দাগিয়ে দেওয়া হয়। কেন এমন হয়? আসলে মূলস্রোতের নিজস্ব সমাজ-রাজনীতি সব কালে সব দেশেই সমাজের 'অপর'-এর মাথার উপর ছড়ি ঘোরাতে চায়, ছড়ি ঘোরায়। মেনস্ট্রিম বরাবরই বর্গ-বিভাজনে বিশ্বাসী। যে কোনও বর্গহীন অস্তিত্বই তো সমস্যা তৈরি করে। বেঁধে না-দিলে তার চৌহদ্দিকে মাপা যায় না। সেটার বিপদও কম নয়। কেননা তখন সেই 'অপরে'র ইতিহাসের দিকে সদাজাগ্রত মন নিয়ে চেয়ে থাকতে হয়, তার ঐতিহ্যকে স্বীকার করতে হয়, তাকে মর্যাদাও দিতে হয়। সে বড় কঠিন কাজ। সীমার মাঝে অসীম বড় বেমানান। তার চেয়ে সীমা-রেখার খাঁচায় পুরে নাম দাগিয়ে তাকে এক পাশে ঠেলে রাখাই বেশি সুবিধা। রোগ-শোক-দৈবদুর্বিপাক-মহামারীকে 'অসুর' বলে চিহ্নিত করার বৃহত্তরের এই ভাবনা-রাজনীতি তাই জেনে বা না-জেনে 'অসুর' নামের এক সম্প্রদায়কে বরাবর অপমানই করে! যা আমাদের সকলের পাপ!
আরও পড়ুন: Durga Puja 2022: দেবতাদের ক্রোধাগ্নি ও তেজঃপুঞ্জ থেকে আবির্ভূত হলেন দেবী দুর্গা!
'অসুর' ভারতের একটি বিশেষ আদিবাসী উপজাতি। জানা গিয়েছে, লোহা গলানোর কাজ করতেন অসুররা। পোশাকি ভাষায় বলতে গেলে, এঁরাই ভারতের আদিম মেটালার্জিস্ট, ধাতুরসায়নবিদ। পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, বিহার-- এই তিন রাজ্যের সরকারি তপশিলি উপজাতির তালিকার একেবারে প্রথম নামটিই 'অসুর'। ১৯৯১ সালের জনগণনা অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে অসুর সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা ৪৮৬৪ জন। এর মধ্যে উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ারেই এঁদের সংখ্যা ছিল ৩১০৮ জন। ঝাড়খণ্ডের রাঁচি, সাঁওতাল পরগনার মতো জায়গা থেকে অসুরদের উত্তরবঙ্গে এনেছিল ইংরেজরা। পরে দীর্ঘদিনের বসবাসের সুবাদে উত্তরবঙ্গে অসুরদের কথ্যভাষা বদলে গিয়েছে। তাঁদের কেউ আর এখন আসুরি ভাষায় খুব একটা কথা বলেন না।
পড়ুন, বাঙালির প্রাণের উৎসবে আমার 'e' উৎসব। Zee ২৪ ঘণ্টা ডিজিটাল শারদসংখ্যা
পুজোর আবহে বারবার এই অসুরদের দিকে নেতিবাচকতা ছুঁড়ে দেওয়া হয়। হিন্দু বাঙালি যখন সাড়ম্বরে দুর্গাপূজা উদযাপন করে, সেই সময়ে শোক পালন করেন অসুর বংশীয় আদিবাসীরা। কোথাও অরন্ধন পালন করা হয়, কোথাও জানলা-দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকেন তাঁরা-- যাতে দুর্গাপুজোর মন্ত্র বা ঢাকের শব্দ তাঁদের কানে না যায়, যেন প্রতিমাকে দেখতে না-হয়; যাতে দুর্গোৎসবের উল্লাস তাঁদের কোনও ভাবে স্পর্শ না করে! কেন এই ছোঁয়াচ বাঁচানো? তাঁদের লোককথা অনুযায়ী, আর্য দেবী দুর্গা এই সময়েই তাঁদের রাজা মহিষাসুরকে ছলনা করে হত্যা করেছিলেন। রাজাকে হারানোর শোক হাজার হাজার বছর ধরেও ভুলতে পারেননি তাঁরা। গবেষকেরা বলেন, আর্যরা ভারতে আসার পরে কোনোভাবেই মহিষাসুরকে পরাজিত করতে পারছিল না। তারা তখন এক কৌশল নেয়। মহিষাসুরকে বধ করার জন্য তারা এক নারীকে ব্যবহার করে। মহিষাসুর ছিলেন অত্যন্ত বলশালী ও প্রজাবৎসল। আদিবাসীদের প্রচলিত লোকগাথা বলে, এ হেন রাজাকে হত্যা করেন গৌরবর্ণা এক নারী! রাজা মহিষাসুরের সময়ে মেয়েদের অত্যন্ত সম্মান দেওয়া হত। মেয়েদের সঙ্গে কখনও কেউ যুদ্ধে লিপ্ত হতেন না, নারীর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণে নিষেধ ছিল। অনার্য মহিষাসুরের বা তাঁর সম্প্রদায়ের এই আদর্শকেই ব্যবহার করে মহিষাসুরকে হত্যা করে তথাকথিত ভদ্র সম্প্রদায়। অথচ, হিন্দু পুরাণে মহিষাসুরকেই 'ভিলেন' হিসেবে দেখানো হয়।
আরও পড়ুন: Durga Puja 2022: ঋষি বিশ্বামিত্র একবার কার্তিক-গণেশকে প্রশ্ন করেন, তাঁদের মায়ের নাম দুর্গা কেন?
মহিষাসুরকে 'ভিলেন' বানানোর মেনস্ট্রিমের এই চিরাচরিত অভ্যাস নিয়ে পুরাণবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীকে প্রশ্ন করা হলে তিনি খুব রসস্নিগ্ধ সুরে প্রথমে বলেন, 'অসুর ও দেবতা কিন্তু একই বাপের ছেলে'! এরপর নৃসিংহপ্রসাদবাবু ব্যাখ্যা যোগ করেন, 'দেবাসুর দ্বন্দ্ব অনেকদিনের। দেবতাদের বিপরীতে অসুরদের স্থাপিত করা হয়েছে। যা কিছু শুভ, যা কিছু মঙ্গলকর তা দেবতা; আর এই দেবতার বিপরীতে যা কিছু অশুভ, যা কিছু অমঙ্গলকর তাই অসুর। কিন্তু বিষয়টি আদৌ তেমন নয়। এটা এভাবে দাগিয়ে দেওয়াও ঠিক নয়। চণ্ডীতে আছে, দেবী স্বয়ং বলছেন, আমি যেমন মহতের মধ্যে আছি, তেমনই দুষ্কৃতীদের মধ্যেও আছি।' শেষে পুরাণবিদ মনে করিয়ে দেন, 'আসলে আমাদের সকলের মধ্যেই অসুর রয়েছেন।'