একদিন ষোড়শীর বুকেও লাল ক্ষত চিহ্ন এঁকে দিয়ে সপ্তদশীতে ডুব দেবে তোমরা

Updated By: Jan 1, 2016, 06:03 PM IST
  একদিন ষোড়শীর বুকেও লাল ক্ষত চিহ্ন এঁকে দিয়ে সপ্তদশীতে ডুব দেবে তোমরা

স্বরূপ দত্ত

নমস্কার। তোমরা সবাই খুব ভালো থেকো। তোমাদের জীবনের সব চাওয়া, পাওয়ায় পরিণত হোক। তোমাদের জীবনে আসুক হাসি, আনন্দ, সাফল্য। আলোয় ঝলমল করে উঠুক তোমাদের জীবন। এত সব শুভেচ্ছার বহর দেখে ভাবছো নিশ্চয়ই আমি কে? এ মা। এখনও চিনতে পারোনি! সত্যিই? কি গো তোমরা? আচ্ছা থাক। তোমাদের উপর অভিমান করে আর যাবো কোথায়! আগামী ৩৬৫ টা দিন তো তোমাদের সঙ্গেই লেপটে থাকব। তোমাদের কত স্বপ্নের জাল বোনা হবে আমারই বুকের ওপর। এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছো আমি কে? এখনও পারোনি! হাঁদারাম, মাইরি।

আরে বাবা, আমি ষোড়শী। এবার চিনতে পারলে নিশ্চয়ই। এই যে তোমরা কাল রাত্তির থেকে সবাই মিলে 'হ্যাপি নিউ ইয়ার/হ্যাপি নিউ ইয়ার করছো', সে তো আমার জন্যই। আমিই হলাম ২০১৬। আরও ভালো করে বললে, শুধু ১৬। আর তোমার মনের কাছাকাছি আসার জন্য চুপি চুপি কানের কাছে এসে বলা। 'ষোড়শী। মানে সুইট সিক্সটিন'। সদ্য বাড়তে থাকা যুবতী। এবার তোমার সঙ্গে কাটাতে এসেছি পাক্কা একটা বছর। খুব মজা করব দুজনে হ্যাঁ?
ও, মনে পড়েছে। কালকে রাতে আমি যখন তোমার জীবনে এলাম, তখন দেখি ওই অন্ধকারে বসে কে একটা কাঁদছে। কাছে গিয়ে দেখি '১৫'! বেচারা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে অ্যাকসা। কী অভিমান, কী অভিমান। ওকে যে তুমি, তোমরা এভাবে বিদায় জানিয়ে দিলে, এটা কিছুতেই মানতে পারছে না। শেষে বললাম, বোকার মতো না কেঁদে, একসঙ্গে কাটানো ভালো দিনগুলো মনে করো। দেখবে, সব ঠিক হয়ে যাবে।

আমি কিন্তু মোটেই এরকম 'পনেরো' মার্কা ন্যাতানো নই। আমার বুকে অনেক আগুন। সে আঁচ তো বোধহয়, এখনই টের পেয়েছো? গোটা ৩১ ডিসেম্বর রাতটা বাইরে কাটালে। কই একটুও ঠাণ্ডা বা শীত ছুঁতে পেরেছে তোমায়? এখন থেকেই আমার এই উষ্ণতায় কীভাবে আগলে রাখা শুরু করেছি বলোতো? আর ওসব ঢং-ফং আমার আসে না। পরিষ্কার বাংলা বাস্তব বুঝি। তোমার সঙ্গে আমার ৩৬৫ দিনের সম্পর্ক। সে তোমার আমার সম্পর্ক যত ঘনই হোক শেষবেলায়। হাতছাড়া-ছাড়িটা হবেই। তখন তোমায় হাজার বোঝালেও আর সুইট সিক্সটিন মনে ধরবে না। তখন কে আর ষোড়শী? ঠিক গিয়ে আশ্রয় নেবে 'সপ্তদশীর'। সিনেমার শেষ যখন জানাই, তাহলে আর নিরুপা রায় মার্কা কেঁদে ককিয়ে হবে কী!
আমরা মানে এই সালরা, কেমন জানো? এক, তো আমরা তোমাদের মতো মানুষ নই। আমাদের মতো এক কথার বান্দা আর পাবে না কোথ্থাও। ঘরের দেওয়ালে দিব্যি টানিয়ে রাখো। দুধ, গ্যাস, ইলেকট্রিক বিল, সবকিছুর হিসেব ফ্যাস ফ্যাস করে জঘন্য হাতের লেখায় আমাদের বুকে চালিয়ে দাও। তোমাদের মুখে কালি পড়লে আর রক্ষে নেই। অথচ, আমাদের মুখ, বুক, শরীরের কোন কোষটায় আঁচড় রাখতে বাকি রাখো? তবু, আমরা নীরবে সব সহ্য করি। ওই ৩৬৫ দিনের সম্পর্কটাকে দাম দিই। তোমাদের তো অনেক আয়ু। কত শতায়ু হওয়ার স্বপ্ন তোমাদের চোখে। আমাদের যে ওই সাড়ে তিনশো দিনেরই জীবন।

শুনতে খারাপ লাগবে না, তোমাদের। কারণ, তোমরা তো আমাদের কখনও অনুভব করোনি। প্রয়োজনে কাজে লাগিয়েছো। কতবার বিভোরভাবে অপলকে তাকিয়ে থাকো। কিন্তু সব নিজেদের ভালো-মন্দর হিসেবের জন্য। চোখ পড়ে আমাদেরই শরীরে। অথচ, তোমরা তখন দিব্যি ভাবতে পারো, অন্য নারী বা অন্য পুরুষের কথা। আমাদের জ্বালাটা তোমরা বুঝবে না। ওই তোমাদের একটা সিনেমার ডায়লগ আছে না? 'তুম নেহি সমঝোগে রাহুল। কুছ কুছ হোতা হ্যায়'! ওরকম আমাদের মনও বলে, তোমরা কিস্যু বুঝবে না। বুকটা ফেটে যায়। তোমাদের ঘরের দেওয়ালে আটকে থেকে প্রতিনিয়ত তোমাদের দেখা আর তোমাদের কথা ভাবা ছাড়া, আমাদের জীবনে আছে কী বলো তো? জানি না, তোমাদের মানুষদের এমন পরিস্থিতিতে কেমন হয়। একবার ভাবো--যে তোমায় ভালোবাসে, যে সবসময় ভাবে এই ৩৬৫ দিনে তোমার যেন জীবন সাফল্যের হাইওয়েতে ফোর্থ গিয়ারে ছুটে চলে, সেই তার বুকেই লিখে রাখো, কবে তুমি ডেট করতে যাবে, অন্য কারও হাত ধরে! হাঃ, হাঃ, হাঃ।

পনেরো বলছিল, ও যে ঘরটায় টেবলের উপর থাকতো, সেই ঘরের ছেলেটির নাম ছিল তোতা। পনেরোর চোখের সামনেই তোতা কতদিন তার নিজের ময়নায় মিশে গিয়েছে, টেবল থেকে মাত্র এক হাত দূরের বিছানাটায়। পনেরোর চোখ ফেটে জল আসতো। কেউ সে চোখের জল দেখেনি কোনওদিন। পনেরোর এই কথাগুলো শুনে বোঝার চেষ্টা করছিলাম, তোমাদের মানে তোমাদের মতো মানুষদের তো কিডনিতে পাথর জমে। আর আমাদের ক্যালেন্ডারের সালদের পাথরের ঢিপি তৈরি হয়ে যায় বুকে। কেউ সরাবে না কোনওদিনও। তাই পনেরোকে কথা দিয়ে এসেছি, ওর মতো ভুল আর করব না। কাউকে ভালোবাসা তো দূর, কারও দিকে তাকাবোও না। আমার আয়ুই যদি তোমার দেওয়ালে ৩৬৫ দিনের হয়, তাহলে আর বোকার মতো মায়া বাড়াতে যাব কেন!
থাক, অত আদিখ্যেতা দেখাতে হবে না। পড়তে পড়তে এমন ভাব করছো যেন, আমাদের দুঃখ বুঝে উদ্ধার করে দিয়েছো। তোমাদের আমরা খোপে খোপে চিনি। গত ২০১৫ টা বছর ধরে আমাদের এতগুলো সাল কীভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে, কেউ কোনও খবর রেখেছো? আজ এসেছে বড় চিন্তা করতে।

তোমাদের মন আমরা বুঝি। তোমরা আমাদের সাজিয়ে তো রেখে দেবে। ঘরের পোষ্যকেও পরিবারের সদস্য বলেই স্বীকৃতি দেবে। অথচ, আমরা তোমাদের কেউ হব না কোনওদিন। তোমরা শুধু নতুন চেনো। তোমাদের সব ভালোলাগা, ভালোবাসা ওই নতুনেই। খ্যাঁদা, বোচা, তোমাদের সব চলে। কিন্তু তোমাদের নতুন চাই। নাহলে তোমরা 'চেচিয়ে চেচিয়ে বেচার কথা বলো!' মন-প্রাণ থাকলে কেউ কিছু বেচতে পারে গো! মন-প্রাণ থাকলে এত বছরে একটাবারও তো বলতে পারতে, থাক অনেক হয়েছে, আমাদের চাই না, 'নতুন' বছর। ওই পুরোনোটাই রেখে দেব দেওয়ালে। ওটা দেখেই জীবনের পুরনো হিসেবগুলো করবে। নতুনভাবে বাঁচবে, পুরনোকে বুকে নিয়েই। নেই গো। তোমাদের অত দম নেই।
আজ আমার তোমাদের বাড়িতে প্রথম দিন। এই ষোড়শী 'শালা আমাদের সব সালের' দিব্যি কেটে বলছি, এক ফোঁটা কষ্ট পাব না, ২০১৬-র ৩১ ডিসেম্বর রাতটায়। একটাবারও মনে পরবে না তোমাদের কথা। তোমাদের বাড়ির আয়ার মতো এসেছি। আয়ার মতোই থাকব। গোটানো অবস্থায়, শরীর থেকে এক ঝটকায় গার্ডারটা খুলে নিয়ে আগে দেখে নিয়েছো, আমার শরীরের কোথায় কোথায় লাল কালি। ওই লাল কালি যে তোমাদের আলস্যের। আরামের। ফাঁকিবাজির। আর আমার? ওই লাল কালিগুলো আমার পূর্বপুরুষের ক্ষতচিহ্ন। আমি শরীরে নিয়ে বয়ে বেড়াচ্ছি। একটা বছর পর যখন এক হ্যাঁচকায় আমায় সরিয়ে দিয়ে সপ্তদশীকে আমার যায়গায় আটকে দেবে, আমার শরীরে আরও অনেক লাল দাগ পড়বে গো। তোমাদের দেখার বা ভাবার সময় কোনওদিন ছিল না। সেদিনও থাকবে না। তোমরা তখন সপ্তদশীর নতুন শরীরে হাত বুলিয়ে ফের লাল রঙের ছোপ খুঁজবে।  

 

.