মেঘ মুলুকের আপন দেশে...
ভাবছিলাম বেরিয়েই পড়ি। ভাবছিলাম, কিন্তু ভাবনাতেই থেমে থাকছিল সবকিছু। কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় শুটিং করে বেড়াচ্ছি আর বৃষ্টি এসে ভাসিয়ে দিচ্ছে সবকিছু। প্রতিটি সিডিউলি ঘেঁটে ঘন্ট। একদিন গড়ের মাঠে এমনই এক বৃষ্টিভেজা ভোরবেলায় শ্যুট চলছে...সাম্নে অনাবিল ভিজে সবুজ, গীটার হাতে গানওয়ালা সুমন দা গাছের তলায় দু-পা ছড়িয়ে টুপি ছুঁড়ে দিচ্ছেন আকাশের দিকে...আর আমার চোখ ভিজে আসছে, মুহুর্তে গুলিয়ে যাচ্ছে সময়।
কৌশিক সেন
ভাবছিলাম বেরিয়েই পড়ি। ভাবছিলাম, কিন্তু ভাবনাতেই থেমে থাকছিল সবকিছু। কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় শুটিং করে বেড়াচ্ছি আর বৃষ্টি এসে ভাসিয়ে দিচ্ছে সবকিছু। প্রতিটি সিডিউলি ঘেঁটে ঘন্ট। একদিন গড়ের মাঠে এমনই এক বৃষ্টিভেজা ভোরবেলায় শ্যুট চলছে...সামনে অনাবিল ভিজে সবুজ, গীটার হাতে গানওয়ালা সুমন দা গাছের তলায় দু-পা ছড়িয়ে টুপি ছুঁড়ে দিচ্ছেন আকাশের দিকে...আর আমার চোখ ভিজে আসছে, মুহুর্তে গুলিয়ে যাচ্ছে সময়।
অদ্ভুত, অস্পষ্টভাবে বছর কুড়ি আমার কাঁচাপাকা চুলের মুঠি ধরে টান মেরে বলছে, `হাঁপিয়ে গেলি ছোঁড়া??` কাট্ বলতে ভুলে গেলাম, ক্যামেরা চলতেই লাগলো আর আমি আবছা অবসন্ন সকালে যুবক থেকে প্রৌড় হতে হতে আবার নতুন করে বেঁচে উঠলাম, গানওয়ালা আমাকে বাঁচিয়ে দিলেন এক অদ্ভুত ক্ষমতায়। বাড়ি ফিরতেই মেয়ে এসে বুকে ঝাঁপালো আর সমস্ত ফ্ল্যাট জুড়ে বিঠোফেনের সোনাটা আর জাকিরের তবলা একসাথে কত্থক নৃত্য করতে লাগল...আমি নব্বই-এর সাপলুডো খেলা পাগল ব্যাগ হাতে বেরিয়ে পড়লাম, জাহান্নমে, সঙ্গী হল আদুরে কন্যা আলোর মুকুট পড়ে আর এক মহাসুর্য লজ্জা পেয়ে মেঘ পাঠাল শিলং-এ, চেরাপুঞ্জিতে।
মোটামুটি ঠিক ছিল কলকাতা থেকে আসাম এসে প্রথমেই কাজিরাঙা দর্শনটা সেরে ফেলব। তা প্ল্যান-মাফিক সেখানে এক শৃঙ্গের রুস্তমির সঙ্গে ভালই আলাপ পরিচয় হল। পরদিন একটা বোলেরোতে চেপে রওনা দিলাম গুয়াহাটির উদ্দেশ্যে। ভেবেছিলাম ৪-৫ ঘণ্টাতেই আরামে পৌঁছে যাব গন্তব্যে। কিন্তু সে গুড়ে বস্তা বস্তা বালি। সৌজন্যে `অ-সাধারণ` খারাপ রাস্তা। প্রথম ৭০-৮০ কিলোমিটার মাখন নরম পথ পেড়িয়ে হঠাৎ যেন `পপাত চ`। তাই অভিজ্ঞতার দিব্বি, এই পথ দিয়ে যদি যেতেই হয়ে হাতে অতিরিক্ত ২-৩ ঘণ্টা সময় আর কোমর ব্যাথার জন্য মলম সঙ্গে থাকা আবশ্যক। সারা রাস্তাটাই এক মাথা বৃষ্টি সঙ্গে থাকায় আমাদের মনের কষ্ট কিছুটা কমে ছিল বটে। বৃষ্টি তবে যে কোমরের দায়িত্বটি নিতে পারবেনা তার গ্যারান্টি আমার রইল।
যাই হোক ৭ ঘণ্টার হ্যাঁচোর-প্যাঁচোরের পর অবশেষে গুয়াহাটি পৌঁছন গেল। এ এক মজার শহর। চটপট রাত ঘুমে যায়। অবিশ্যি ভোরে উঠে কমলা সূর্যকে গুড মর্নিংও বলে বড্ড তাড়াতাড়ি। আমাদের হোটেলটা ছিল গুয়াহাটির মার্কেট প্লেসে। এই জায়গাটা হ্যাণ্ডলুমের স্বর্গরাজ্য। পরদিন সকালটা তাই আমদের শপিং অভিযানেই কেটে গেল। স্বাভাবিক ভাবেই কেনাকাটির চক্করে ম্যানি ব্যাগের ওজন কমার ব্যাস্তানুপাতিক হারে বেড়ে গেল সঙ্গে থাকা লট বহরের ওজন। সংখ্যাতেও বেশ তিড়িং বিড়িং ভাবে বাড়লেন তারা। ওই দিন বিকেলেই গোধুলির নরম সোনা আলোতে ব্রহ্মপুত্রের বুকে লঞ্চ বিহার। বর্ণনায় গিয়ে সময় নষ্ট করব না। শুধু এটুকু বলব কিছু স্মৃতি শব্দের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে না।
গুয়াহাটিতে যখন আসাই হল কামাক্ষ্যা দর্শন আর বাকি থাকে কেন? এই মন্দিরের প্রত্যেক দেওয়ালেই পুরাণ-পুরাণ গন্ধ। শিব-সতীর `ইটারনাল` প্রেমের গপ্প, দক্ষযজ্ঞের স্মৃতি মাখানো কামাক্ষ্যাতে ঘোরাঘুরিটা ভালোই হল। তবে বছরের বেশির ভাগ সময়টা ইতি-উতি লাইনের মধ্যেই কেটে যায় বলে ঘুরতে গিয়ে আর লাইনে দাঁড়ানোটা পোষালোনা। তাই এই মন্দিরের গর্ভ গৃহটাকে সযত্নে পাস কাটিয়ে গেলাম। পরের দিন যাত্রা `মেঘ মুলুকের আপন দেশ` শিলং-এর উদ্দেশ্যে। যদিও রঙ ফানুসের বদলে এ যাত্রা চার চাকাকেই ভরসা করতে হল। হঠাৎ এক বন্ধুর ফোন। অরুণাচল থেকে ফিরছে। যেতে চায় শিলং। থাকার ব্যাবস্থা করে দিতে হবে। ফোন লাগালাম ট্রাভেল এজেন্টকে। ব্যাবস্থা হল এক আধা ফরাসী মহিলার গেস্ট হাউসে।
অবশেষে এসে পৌঁছলাম মেঘের দেশে। শিলং শহরটার ছত্রে ছত্রে ব্রিটিশ ঔপনেবেশিকতার ছাপ এখনও বেশ স্পষ্ট। ঝাঁ চকচকে রাস্তা ঘাট। কেতা দুরস্ত মানুষ জন। পুরনো ক্যাফে। কিউরিও শপ। তবে পুরোটাই মেঘের ভালবাসা-বাসিতে জড়িয়ে। বন্ধুতা ঝিম ঝিম বৃষ্টি আর ঘন সবুজ গাছ পালার সঙ্গে। তবে এতখানি ভাল লাগার সুরটা টুক করে কেটে গেল হোটেলে গিয়ে। একেবারেই পছন্দ হল না এই ঠাঁই। ভরসা দিতে সেই বন্ধু এসে হাজির। তার সঙ্গেই তিন জনে উড়ে গিয়ে জুড়ে বসলাম আমারই ঠিক করে দেওয়া গেস্ট হাউসে। সময়টা তখন মাঝরাত। এই বার মন খুশ। তারপর সারারাত জুড়ে ফায়ার প্লেস, হুইস্কি, আড্ডা আর গান। যৌবন, শীত, মেঘ আর বৃষ্টি রাতের মুহূর্তের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল সেদিন...।
পরের দিন সক্কাল সক্কাল শিলং-এর চার পাশ ভ্রমণ। বারাপানির মাহাত্ম্য যে কোন ট্রাভেল ম্যাগাজিনে ভালোই পাওয়া যায়। তাই তার পুনারাবৃত্তি আর করলাম না। তবে এলিফ্যান্ট ফলস আর শিলং পিকের কথা না বললে বড় অসম্পূর্ণ রয়ে যায় শিলং গাথা। বহু উল্লেখেও দীর্ণ হয়না এদের রূপ। শিলং পিকে মেঘেরা তো বাসা বেঁধে থাকে। লুকোচুরি খেলে নিজেদের সঙ্গেই। এলিফ্যান্ট ফলসে ছোট ছোট জলধারা চার পাশ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে একসঙ্গে। মিলে যায় এক জন আরেক জনের সঙ্গে। এত কিছুর পর শিলং ক্লাবের ব্রেকফাস্ট কোন এক অজানা কারনে বাদ পড়ে গেল আমাদের ট্রাভেল ডায়েরি থেকে। তবে সেই ক্ষতে কিছুটা প্রলেপ দিল গ্রিন উডের লাঞ্চ। যার স্বাদ এখনও জিবের ডগায় মাঝে মাঝে জানান দিয়ে যায়।
শিলং চারপাশ মোটামুটি শেষ করে পরদিন রওনা দিলাম চেরাপুঞ্জির পথে। তবে তার আগে ফরাসী-ভারতীয় ব্রেকফাস্ট। সসেজ, ব্রাউন ব্রেড, পোচ, জুস দিয়ে পেট পুজোটা ভালই হয়েছিল। যাই হোক, পেট ছেড়ে আবার পথে ফিরে আসা যাক। ধুপি গাছে ঢাকা রাস্তা। আবার বৃষ্টি। গাড়ির পিছন পিছন মেঘের ধাওয়া করা। তাই গাড়ি থামিয়ে রাস্তাতেই চলতে থাকল আনাড়ি হাতে এসএলআরের ক্লিক ক্লিক। ক্যামেরা বন্দি হল মুহূর্তরা। আশা ছিল এক রাশ বৃষ্টি পাব চেরাপুঞ্জীর বুকে। কিন্তু সেখানে গিয়ে ছোটবেলায় ভূগোল বইয়ের উপর গুচ্ছ রাগ হল। শুনলাম চেরাপুঞ্জীর সঙ্গে নাকি বৃষ্টির আড়ি বেশ কিছু কাল ধরেই। সময়ের অভাবে বৃষ্টি খোঁজে যাওয়া হল না মৌসিনরামে। অতএব ফিরে আসা আবার সেই শিলং-এ। সেখান থেকে তারপরের দিন আবার ছোট্ট বিমানে ব্যাক টু আদরের কলকাতা।