পাহাড়ে ভাঙন!
মৌপিয়া নন্দী
২০১৩-র অগাস্টের শেষদিক। কাকভোরে খবর এল গ্রেফতার হয়েছেন বিনয় তামাং। কট্টরপন্থী মোর্চা নেতা, গুরুংয়ের বিশ্বস্ত অনুগামী। প্রায় মাসখানেক ধরে পাহাড়ে চলতে থাকা মোর্চার আন্দোলনের কোমর ভাঙতে বড় ভূমিকা পালন করে এই গ্রেফতার। সে যাত্রায় আর দানা বাঁধতে পারেনি গোর্খ্যাল্যান্ডের আবেগ। ডিসেম্বরের ২০ তারিখ কলকাতায় মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে আবার GTA প্রধানের পদে ফেরার কথা ঘোষণা করেন গুরুং। ঘটনাচক্রে দিনদুয়েকের মাথায় জামিনও পেয়ে যান বিনয় তামাং। মোর্চার সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ডের অলিখিত পদের অন্যতম দাবিদার যে তিনি হয়ে উঠেছেন, তা বুঝতে বাকি থাকেনি কারও।
এবার পাহাড়ে অশান্তির আঁচ ছড়াতে শুরু করার পর থেকেই সেই সম্ভাবনাটা বাস্তব রূপ নিতে শুরু করে। ১৫ জুন পাতলেবাসে পুলিস হানা দেওয়ার পর বিমল গুরুং, বিনয় তামাং বেশ কয়েকদিন আত্মগোপন করেন। এরইমধ্যে পাহাড়ে তৈরি হয় যৌথ মঞ্চ। এই যৌথমঞ্চের প্রথম দুটি বৈঠকের পরই মোর্চা নেতৃত্ব বুঝে যায় হেভিওয়েট নেতারা বৈঠকে না থাকায় আন্দোলনের রাশ হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা দিচ্ছে। সেসময়ই আন্দোলনের পুরোভাগে এসে দাঁড়ান বিনয় তামাং। ২৭ জুন GTA চুক্তিপত্র পোড়ানো হয় তাঁরই নেতৃত্বে। ২৯ জুন কালিম্পংয়ে মোর্চার ডাকা তৃতীয় সর্বদল বৈঠকে শেষ মুহূর্তে যোগ দিয়ে বনধ তোলার চাপ প্রতিহত করান এই বিনয় তামাংই। ঠান্ডা মাথা, ক্ষুরধার রাজনৈতিক বুদ্ধি, পাহাড়ের অন্য দলগুলির মধ্যে গ্রহণযোগ্যতার কথা মাথায় রেখে তার ওপরই আন্দোলন সামনে থেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব ন্যস্ত করেন গুরং।
২০১৭-র অগাস্টের শেষে হঠাতই কহানি মে টুইস্ট! মুখ্যমন্ত্রীর ডাকে নবান্নে বৈঠকে যোগ, বনধ তোলার সিদ্ধান্ত ঘিরে এখন দুই বিপরীত মেরুতে পাহাড়ের দুই বিগ বি। বিমল-বিনয় বিবাদে নতুন করে কালো মেঘের ছায়া পাহাড়জুড়ে। কিন্তু কেন হঠাত্ এই ফাটল? শুধুই কি ক্ষমতার লোভে বিশ্বাসঘাতকটার সেই চিরাচরিত ছক? অন্তরালে থাকা গুরুংয়ের অনুপস্থিতিতে পাহাড়ের রাজনীতির নির্ণায়ক ভূমিকায় থাকার প্রলোভন কি গ্রাস করল লো প্রোফাইল থাকতে চাওয়া বিনয়কে? আপাতভাবে সম্ভাবনাটা জোরালো হলেও, বিনয় তামাংকে কাছ থেকে দেখেছেন যাঁরা তাদের মধ্যে কিছু সংশয় থেকেই যাচ্ছে। কট্টর গোর্খ্যাল্যান্ডপন্থী বিনয় সরকারি কোনও পদ বা দলে প্রাধান্যের মোহে গুরুংকে বাইপাস করে সরকারের কথায় উঠবেন বসবেন, এতটা সরলীকরণ কি যথার্থ?
বিনয়ের ভাবনাচিন্তায় চাণক্যের প্রভাব স্পষ্ট। তাহলে কি ভোলবদল কৌটিল্যভক্তের ভেবেচিন্তে নেওয়া সুনির্দিষ্ট কোনও পদক্ষেপ? গুরুংয়ের রাজনীতি অনেকটাই মুড-নির্ভর। মুহূর্তের সিদ্ধান্তে নিয়ে ফেলেন মস্ত বড় সিদ্ধান্ত। আগুপিছু বিবেচনা না করেই, চলতি বনধও তার ব্যতিক্রম নয়। নানা মামলার ফাঁসে জর্জরিত গুরুং নিজেই দার্জিলিং ছাড়া। লাগাতার বনধের জেরে ঘরে-বাইরে পাহাড়প্রমাণ চাপ। তাহলে কি আন্দোলনের পন্থা নিয়েই মতান্তরের সূত্রপাত? গত আড়াইমাসে দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্সিয়ং চষে ফেলা বিনয় তামাং বিলক্ষণ বুঝেছেন, গোর্খাল্যান্ডের গাজর ঝুলিয়ে মাসের পর মাস বনধের জোয়াল পাহাড়বাসীর কাঁধে ফেলে রাখলে তা বুমেরাং হতে পারে। GNLF -এর মত দল যখন দীর্ঘদিন পর আবার পাহাড়ে ডালপালা ছড়াচ্ছে, তখন নিষ্ফল বনধ টেনে নিয়ে যাওয়ার চড়া এবং চিরস্থায়ী মাশুল গুনতে হতে পারে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চাকে। সেই দেওয়াল লিখন পড়েই কি স্রোতের বিপরীতে হেঁটে, বিশ্বাসঘাতক তকমা পেয়েও অনড় বিনয় তামাং?
ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ নাকি বাস্তবের মাটিতে পা রেখে সময়োপযোগী অথচ অপ্রিয় পদক্ষেপ? বিনয়ের আচরণের সঠিক ব্যাখ্যা হয়ত মিলবে ভবিষ্যতে। আশু যে প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য আগ্রহী অপেক্ষা, কার হাতে থাকবে দল তথা পাহাড়ের আন্দোলনের রাশ? পাহাড়ের স্বঘোষিত মুকুটহীন রাজার মিলিয়ে যেতে যেতেও খানিকটা রয়ে যাওয়া ক্যারিশমা নাকি কৌটিল্যভক্তের মস্তিষ্ক, শেষ কথা বলবে কে?