ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়: ভোরবেলায় উঠে পড়া তাঁর বহু বছরের অভ্যাস। তার পরে বেশ কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি আর শরীরচর্চাও তাই। কিন্তু গত কয়েক বছরে তার সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে গরমাগরম চায়ের কিছু জমজমাট উপাখ্যানও। তবে সাতসকালের সে সব উপাখ্যান শুধু যে কেন্দ্রীয় চরিত্রটিকেই দিনভরের জন্য চাগিয়ে দিচ্ছে, এমন কিন্তু নয়। মাঝেমধ্যেই তা গরম করে দিচ্ছে গোটা রাজ্যের রাজনীতিকেও। কখনও বিতর্ক তৈরি হচ্ছে, কখনও সমালোচনা। কিন্তু সে যা-ই হোক না কেন, দিলীপ ঘোষের চায়ের কাপ কিন্তু বিজেপির জনসংযোগে তুফান তুলে দিচ্ছে। দল অন্তত তেমনই মনে করছে। 


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

আরও পড়ুন: 'যাঁরা সফল ব্যক্তি, তাঁদের রাজনীতিতে আসা উচিত' সৌরভ জল্পনা উস্কে মন্তব্য দিলীপের


'চা চক্রে দিলীপদা'--- এই সাদামাটা শিরোনামের কর্মসূচি| কোনও প্রস্তুতির দরকার পড়ে না| কোনও প্রশাসনিক অনুমতির প্রয়োজন হয় না| কোনও বড়সড় খরচের ব্যাপারও নেই। কিন্তু জনসংযোগের জন্য খাসা মঞ্চ। রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ যখন যেখানে থাকেন, তখন সেই এলাকাতেই 'চা চক্রে' অংশ নেন। নরেন্দ্র মোদীর 'চায়ে পে চর্চা'র অনুকরণেই দিলীপের এই চা চক্র। কিন্তু মোদীর সেই 'চায়ে পে চর্চা' শুধু ভোট মরসুমেই সীমাবদ্ধ ছিল। দিলীপের চা চক্র কিন্তু তেমন নয়। ভোট থাক বা না থাক, বছরভরই দিলীপ এই কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। এবং তাঁর ঘনিষ্ঠদের দাবি, অতি সাধারণ কর্মসূচি হলেও খুব অল্প সময়ে এবং অল্প পরিশ্রমে দারুণ জনসংযোগ হচ্ছে।


চা চক্রগুলিতে গিয়ে কী করছেন দিলীপ? যে এলাকায় যাচ্ছেন, সেখানকার বিজেপি কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে চা খাচ্ছেন। কৌতূহল বশত এলাকার সাধারণ জনতাও কিছুটা ভিড় জমাচ্ছে। চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে তাঁদের সবার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি। তার পরে সেই জমায়েতের সামনে নাতিদীর্ঘ ভাষণও দিচ্ছেন। তাতেই আসর জমজমাট। দিলীপের এক সর্বক্ষণের সঙ্গীর কথায়, “চা চক্রে যে হাজার হাজার লোকের ভিড় জমছে, তা নয়। দিলীপদা এটা খুব সকাল সকাল করেন তো। তাই খুব বেশি লোক জমা সম্ভব নয়। সেটা আমাদের লক্ষ্যও নয়। আমাদের লক্ষ্য হল বৈঠকি মেজাজের দিলীপ ঘোষকে বিভিন্ন এলাকার মানুষের সামনে তুলে ধরা। দিলীপদা কেমন মানুষ বা কতটা মাটির মানুষ, সেটা সাধারণ জনতাকে বুঝতে দেওয়া।"


আরও পড়ুন:  শহিদ দিবসে নন্দীগ্রাম যাচ্ছেন না Mamata Banerjee
 


দিলীপ ঘনিষ্ঠদের ব্যাখ্যা, বড় বড় জনসভায় প্রিয় নেতাকে দূর থেকে দেখতে হয়, কাছের মানুষ হিসেবে পাওয়া যায় না। কিন্তু চা চক্রের ছোট ছোট জমায়েতে দিলীপকে অনেকেই 'কাছের মানুষ' হিসেবে পাচ্ছেন বলে তাঁরা মনে করছেন। রাজ্যের সব প্রান্তেই দিলীপ ঘোষ এই কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। ফলে সাতসকালে স্রেফ খোশগল্প করেই দিলীপ ঘোষ বহু মানুষকে ছুঁয়ে ফেলেছেন বলে বিজেপি মনে করছে।


কলকাতায় যখন দিলীপ থাকেন, তখন প্রায় রোজ তাঁর প্রাতর্ভমণের সঙ্গী হন 'ওভারসিজ ফ্রেন্ডস অব বিজেপি'র পশ্চিমবঙ্গ শাখার কোঅর্ডিনেটর উর্মি বাঘেল। দিলীপের মতো এই উর্মিরও সঙ্ঘের সঙ্গে দীর্ঘ যোগ। ঘুমোতে যত রাতই হোক, সূর্যোদয়ের আগে উঠে পড়া উর্মিরও বহু বছরের অভ্যাস। ইকো পার্কে বা সুভাষ সরোবরের ধারে মর্নিং ওয়াক সেরে দিলীপ যে ভেজানো ছোলা-বাদামটা খান, সেটার ব্যবস্থাও উর্মিই করে রাখেন। 


এ হেন উর্মি বাঘেলের কথায়, “দিলীপদা যে সময় থেকে চা চক্র শুরু করেছেন, আমি সেই সময় থেকেই এটার মধ্যে থেকেছি। আমি দেখেছি, অনেক ক্ষেত্রে বড় বড় জনসভার চেয়েও এই ঘরোয়া মেজাজের কর্মসূচি মানুষকে বেশি করে কাছে টানে।" আর সেই ঘরোয়া মেজাজের সঙ্গে দিলীপের নিজস্ব মেজাজ তো রয়েইছে। উর্মি হেসে বলছেন, “প্রথমে গরমাগরম চা, তার পরে দিলীপদার গরমাগরম ভাষণ। কর্মসূচি তো জমে যেতে বাধ্য। “বিজেপির মণ্ডল স্তরের কর্মীরাই মূলত রাজ্য সভাপতির এই কর্মসূচিগুলির বন্দোবস্ত করেন। জেলা নেতারা কোথাও কোথাও তাতে যোগ দেন| বিজেপি সূত্রের খবর, দিন যত যাচ্ছে, বিভিন্ন মণ্ডল থেকে চা চক্রের অনুরোধ তত বেশি করে পৌঁছচ্ছে দিলীপের টেবিলে।


 দিলীপ কবে কোথায় থাকবেন, সেই হিসেব মাথায় রেখে বিভিন্ন মণ্ডলকে সম্মতি দেওয়া হচ্ছে। তার পরে নির্ধারিত দিনে মর্নিং ওয়াক সেরেই দিলীপ পৌঁছে যাচ্ছেন চা চক্রে। কখনও আবার পৌঁছে যাচ্ছেন হাঁটতে হাঁটতেই। চা কিন্তু কর্মীরা বাড়ি থেকে বানিয়ে আনছেন না। নিজেরাও বানাচ্ছেন না। তাতেও জনসংযোগের হিসেব মাথায় রাখা হচ্ছে। স্থানীয় কোনও চা বিক্রেতার কাছ থেকেই চা নেওয়া হচ্ছে। শুধু কাপটা বিজেপির নিজের। ‘চা চক্রে দিলীপদা’ লেখা সেই কাপ দিলীপের কনভয়ের একটি গাড়িতেই রাখা থাকে। বিজেপি ঘনিষ্ঠ এক ব্যবসায়ীর উপরে ওই কাপ ছাপিয়ে রাখার দায়িত্ব রয়েছে। ১৫০ থেকে ২০০টি কাপ কিনে নেয় সংশ্লিষ্ট মণ্ডল। আর ছাপিয়ে নেয় দিলীপের ছবি সম্বলিত একটি ব্যানার। কোথাও মঞ্চ বাঁধা হয়। কোথাও তারও দরকার পড়ে না। অর্থাৎ আয়োজন নেহাতই হালকা। কিন্তু বিনিময়ে যে জনসংযোগটা হচ্ছে, সেটা হেভিওয়েটই।


আরও পড়ুন:  'DDCAর অনুষ্ঠানে যাচ্ছি' রাজনীতির জল্পনা উড়িয়ে দিল্লি পাড়ি সৌরভের
 


দিলীপের চা চক্র ঘিরে গোলমাল বা বিতর্ক কম হয়নি। কখনও রাজারহাটে চা চক্রের আয়োজন ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে তৃণমূল। কখনও লেকটাউনে দিলীপের চা চক্র ঘিরে তৃণমূল-বিজেপিতে তুমুল সংঘর্ষ হয়েছে। কখনও আবার ক্যানিং স্ট্রিটের চা চক্র থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে বিতর্কিত শব্দ প্রয়োগ করে সমালোচনার মুখে পড়ে গিয়েছেন দিলীপ। কিন্তু কোনও পরিস্থিতিতেই চা চক্র বন্ধ হয়নি। সাতসকালের খোশগল্পের ছলে জনসংযোগের এই হাতিয়ার দিলীপ ঘোষ কিছুতেই হাতছাড়া করতে চাননি। কটাক্ষ মোদীর ‘চায়ে পে চর্চা’নিয়েও ছিল। আগে চা বিক্রি করতেন, এখন দেশ বিক্রি করছেন- এমন কটাক্ষ ভেসে এসেছিল খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তরফ থেকে।


অতএব দিলীপের চা চক্র-ও যে শ্লেষের মুখে পড়বে, তা বলাই বাহুল্য। এক চা-ওয়ালা দেশ বেচছেন, আর এক চা-ওয়ালা রাজ্যকে বেচে দেবেন- বলেছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। কিন্তু বিজেপির রাজ্য সভাপতি চা চক্রের সংখ্যা দিন দিন বাড়িয়েছেন বই কমাননি। রাজ্য বিজেপির মিডিয়া বিভাগ রোজ যে তালিকা প্রকাশ করে জানায় কোন নেতার কোন কর্মসূচি রয়েছে রাজ্যের কোন প্রান্তে, সে তালিকায় চোখ রাখলেই বোঝা যায়, কতটা সাড়া ফেলে দিলীপের চা চক্র। গত কয়েক মাস ধরে প্রায় রোজই দিলীপের দিন শুরু হচ্ছে চা চক্র দিয়ে। শুধু চা চক্রে নয়, আজকাল মর্নিং ওয়াকেও ভিড় জমতে শুরু করেছে দিলীপের চার পাশে। বিজেপি নেতারা রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির প্রশ্ন এড়িয়ে ফুরফুরে মেজাজে বলছেন- আর কিছু হোক না হোক, দিলীপদা অনেককেই সকালে ওঠা আর শরীরচর্চার অভ্যাসটা অন্তত ধরিয়ে দিচ্ছেন।