করোনায় তুঙ্গে অক্সিজেনের চাহিদা, লকডাউনের জেরে গোডাউনেই পড়ে সিলিন্ডার!
লকডাউনের জেরে মিলছে না গাড়ি, দক্ষ কর্মচারি; সমস্যায় অক্সিজেনের সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত রাজ্যের একাধিক সংস্থা...
সুদীপ দে: করোনার গ্রাসে বিশ্বের শতাধিক দেশ। ভারতেও ক্রমশ বাড়ছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, এখনও পর্যন্ত ভারতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ১৪ হাজার ১৭৫, এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৫৪৩ জনের।
করোনা সংক্রমণ থেকে বাঁচতে দেশজুড়ে এখন লকডাউন চলছে। করোনা পরিস্থিতির মোকাবিলায় পশ্চিমবঙ্গেও একাধিক কড়া পদক্ষেপ করেছে প্রশাসন। রাজ্যের জেলায় জেলায় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলি যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে করোনা শনাক্তকরণ এবং আক্রান্তদের চিকিৎসা চালাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে চিকিৎসা পরিষেবার ক্ষেত্রে যে জিনিসগুলি অত্যাবশ্যকীয় হয়ে উঠেছে সেগুলি হল, মাস্ক, পিপিই, গ্লাভস, ভেন্টিলেটর আর অক্সিজেনের জোগান।
করোনা আক্রান্তদের মধ্যে শ্বাসকষ্ট হওয়াটা অন্যতম সমস্যা। কারণ, এই ভাইরাসের সংক্রমণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে আমাদের ফুসফুস। শরীরে পর্যাপ্ত অক্সিজেনের অভাবে ধীরে ধীরে সঙ্কটজনক হয়ে ওঠে রোগীর শারীরিক অবস্থা। এই সময় ভেন্টিলেটরের সাহায্যে রোগীর শরীরে প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের জোগান দেওয়া হয়। অর্থাৎ, করোনা আক্রান্ত রোগীকে বাঁচাতে ওষুধপত্রের সঙ্গে পর্যাপ্ত অক্সিজেনের জোগান অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু লকডাউনের জেরে মিলছে না গাড়ি, দক্ষ কর্মচারি। ফলে সমস্যায় পড়েছেন অক্সিজেনের সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত রাজ্যের একাধিক সংস্থা।
যেমন ব্যান্ডেলের একটি অক্সিজেন প্ল্যান্ট চালান দীপঙ্কর কুণ্ডু। তাঁর এই প্ল্যান্ট থেকে বর্ধমান, দুর্গাপুর, নদিয়া, হুগলি, উত্তর ২৪ পরগনা ও বহরমপুরের বেশ কিছু এলাকায় অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহ করা হয়। দীপঙ্করবাবু বলেন, “আগে প্রতিদিন এখান থেকে যত পরিমাণ অক্সিজেন সিলিন্ডার রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে নিয়মিত সরবরাহ করা হতো, এখন তার অর্ধেকও হচ্ছে না।”
কিন্তু এখন করোনা পরিস্থিতি সামাল দিতে তো অক্সিজেন সিলিন্ডারের চাহিদা আরও বেড়ে যাওয়ার কথা?
উত্তরে দীপঙ্করবাবু বলেন, “চাহিদা আছে, গোডাউনে অক্সিজেন সিলিন্ডার মুজুতও রয়েছে পর্যাপ্ত। কিন্তু সেগুলোকে ডিলার বা ডিট্রিবিউটারদের কাছে পৌঁছাবেন কী করে? লকডাউনে তো গাড়িই পাওয়া যাচ্ছে না। করোনার ভয়ে প্রয়োজনীয় দক্ষ কর্মচারি মিলছে না। আগের মতো অক্সিজেনের সরবরাহ করা যাবে কী করে বলুন!”
ব্যান্ডেলের মতোই মগরা, হওড়ার অক্সিজেন প্ল্যান্টগুলিরও একই অবস্থা। গোডাউনে গোডাউনে অক্সিজেন সিলিন্ডার পড়ে রয়েছে, অথচ সেগুলো সময় মতো, নির্দিষ্ট যায়গায় পৌঁছানো যাচ্ছে না।
একই রকম সমস্যার কথা শোনালেন গেল সোদপুরের অক্সিজেন সিলিন্ডারের ডিট্রিবিউটার প্রণবেশ সেনগুপ্ত। তিনি বলেন, “প্রায় ২৮ বছর ধরে উত্তর ২৪ পরগনার একটা বড় অংশে অক্সিজেন সিলিন্ডারের জোগান দিচ্ছি আমরা। এই রকম সমস্যায় আগে কখনও পড়িনি। অক্সিজেন সিলিন্ডার পড়ে আছে, কিন্তু গাড়ি আর কর্মচারির অভাবে সেগুলো জায়গা মতো পৌঁছাতে পারছি না। যে জায়গাগুলোয় এখনও অক্সিজেন সিলিন্ডারের জোগান দিচ্ছি, সেখানে সময় মতো দেওয়া যাচ্ছে না।” প্রণবেশবাবু আরও জানান, আগে যেখানে দিনে প্রায় ১৩০ থেকে ১৫০টি অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহ করা হতো, এখন সেখানে এই সংখ্যাটা কমে ৭০ থেকে ৮০ হয়ে গিয়েছে।
একই রকম সমস্যার কথা শোনা গেল আর এক অক্সিজেন সিলিন্ডারের ডিট্রিবিউটার সুবীর গাঙ্গুলির থেকেও। লকডাউনের জেরে বেজায় সমস্যার পড়েছেন তিনিও। একটি মাত্র গাড়ি, সাকুল্যে চার জন কর্মচারি নিয়ে কোনও রকমে অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহের কাজ চালাচ্ছেন তিনি।
করোনার জেরে অক্সিজেন সিলিন্ডারের চাহিদা অনেকটাই বেড়েছে। কিন্তু সব মিলিয়ে রাজ্যের প্রায় সব জেলাতেই অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত রাজ্যের একাধিক সংস্থা, প্ল্যান্টগুলির নাজেহাল অবস্থা পর্যাপ্ত গাড়ি আর দক্ষ কর্মচারির অভাবে। তাই পরিষেবা দেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও উপায় দেখছেন না তাঁরা। তবে হাজার সমস্যার মধ্যেও সিলিন্ডারের দাম বাড়াননি কেউই। সকলেরই এক কথা, ‘এই পরিস্থিতিতে দাম বাড়ানোর প্রশ্নই উঠছে না। বরং সময় মতো অক্সিজেন পৌঁছে দিতে পারলে কটা মানুষের হয়তো প্রাণ বাঁচানো যাবে!’