সিদ্ধপীঠ, মহাপীঠ, বক্রেশ্বর ধাম! সুপ্রাচীন তপোভূমি থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে তিন মাহাত্ম্যের ছটা
বক্রেশ্বরের সঙ্গে জড়িয়ে ঋষি অষ্টাবক্রের কাহিনি। কথিত আছে, অষ্টাবক্র মুনি প্রথমে কাশীতে উপাসনার সংকল্প নেন।
ধ্রুবজ্যোতি অধিকারী, কমলাক্ষ ভট্টাচার্য: লাল মাটির দেশে, লাল ধুলোর মাঝে এই যাত্রা বড় মনোরম। একেবারে তুচ্ছ, অতি নগণ্য উপকরণের মধ্যেও উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে অজস্র সুন্দরের অঢেল আয়োজন। এসব দেখতেই দেখতেই আমাদের বক্রেশ্বরে পৌঁছে যাওয়া।
মূল প্রবেশদ্বার থেকে মন্দিরে যাওয়ার যে পথ, তার দুধারে বিস্তৃত দোকান। বীরভূম জেলার সিউড়ি সদর মহকুমার শহর বক্রেশ্বর। সুপ্রাচীন তপোভূমির এক অঙ্গ থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে তিন মাহাত্ম্যের ছটা--- সিদ্ধপীঠ, মহাপীঠ এবং বক্রেশ্বর ধাম। এক যাত্রায় তিনের পুণ্য অর্জনের আকাঙ্খা নিয়ে দূরদূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা আসেন।
বক্রেশ্বরের সঙ্গে জড়িয়ে ঋষি অষ্টাবক্রের কাহিনি। কথিত আছে, অষ্টাবক্র মুনি প্রথমে কাশীতে উপাসনার সংকল্প নেন। কিন্তু কাশীর বিশ্বনাথ স্বয়ং তাঁকে গৌড়দেশের গুপ্তকাশী বক্রেশ্বরে গিয়ে সাধনা করতে বলেন। বিশিষ্ট তীর্থ ভ্রমণ লেখক শিবশংকর ভারতী তাঁর ভারতের মন্দিরে মন্দিরে বইটিতে লিখেছেন, অষ্টাবক্র মুনি শ্রীকৃষ্ণের সমসাময়িক।
মহাভারতীয় যুগকে ভিত্তি করলে ঋষি অষ্টাবক্রের বিদ্যমানতা এবং তীর্থ হিসেবে বক্রেশ্বরের প্রসিদ্ধি প্রায় চার হাজার চারশো আটান্ন বছর বলা যায়। বক্রনাথের মন্দিরে ভগবানের চেয়েও উচ্চাসনে রয়েছেন তাঁর ভক্ত। গর্ভৃগৃহে পিতলের ধাতু মণ্ডিত উঁচু যে শিলা রয়েছে তা অষ্টাবক্র মুনির। এর ঠিক পাশেই কিছুটা নিচে বক্রেশ্বর মহাদেবের ছোট শিলা। পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক তথ্যের নিরিখে আজকের বক্রনাথের মন্দির সাতশো বছরের বেশি পুরনো। নির্মাণ করিয়েছিলেন রাজা নরসিংহ দেব। বাংলায় সুলতানি শাসনে মন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর রাজা দর্পনারায়ণ সতেরোশো একষট্টি খ্রিস্টাব্দে তা সংস্কার করেন।
সতীর ভ্রুসন্ধি বা মনঃস্থান পড়েছিল বলে, ভারতবর্ষের একান্ন পীঠের মধ্যে বক্রেশ্বরকে মহাপীঠ হিসেবে গণ্য করা হয়। তন্ত্রের ভাষায় ওই মনঃস্থানকে আজ্ঞাচক্র বলে। বাংলাদেশের দেবী ঢাকেশ্বরীর সঙ্গে বক্রেশ্বরের মহিষাসুরমর্দিনীর রূপের মিল রয়েছে। পীঠমালা, কালিকাপুরাণ ও তন্ত্রচূড়ামণি গ্রন্থে বক্রেশ্বরের উল্লেখ আছে। দেবীমন্দিরে বেদীর ওপরে ভ্রুসন্ধির প্রাচীন কালো পাথরটি রক্ষিত আছে। জনশ্রুতি, খাকী সম্প্রদায়ের এক মহাত্মা, যিনি খাকিবাবা নামে খ্যাত, তিনি বেদীতে এটির প্রতিষ্ঠা করেন। মাতৃমন্দিরের একদম গায়েই বটুকনাথ ভৈরবের অধিষ্ঠান। একটুখানি পাতালে প্রবেশ করলে তবে দর্শন মিলবে।
৫০০ বছর আগে বক্রেশ্বর ছিল ঘন জঙ্গলে ঘেরা নির্জন ভূমি। চৈতন্য ভাগবতে তার প্রমাণ মেলে। কাটোয়ায় সন্ন্যাস গ্রহণের পর মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য বলেছিলেন, 'বক্রেশ্বর আছেন যে বনে, তথায় যাইনু মুঁঞ্চি থাকিমু নির্জনে।' সেই সময়টায় তান্ত্রিক, ভৈরবী, অঘোরপন্থীদের দাপট ছিল বক্রেশ্বরে। শ্মশান আর জঙ্গলাকীর্ণ পরিবেশে বসতো তন্ত্রচক্র। মহাপীঠ বক্রেশ্বরকে বেষ্টন করে রয়েছে সাতটি উষ্ণ প্রস্রবণ এবং একটি শীতল জলের কুণ্ড। মাটির নিচ থেকে জলের নিরন্তর বিচ্ছুরণ হয়ে চলেছে। সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, সিলিকেট, ক্লোরাইড, বাইকার্বোনেট কী নেই এখানকার জলে!
কুণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পৌরাণিক কাহিনি। শরীরের আট জায়গা বেঁকে যাওয়ার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে শিবের সাধনা করেন ঋষি অষ্টাবক্র। তপস্যায় তুষ্ট মহাদেবের নির্দেশে সমস্ত তীর্থের জল সুড়ঙ্গপথে এসে ঋষির যন্ত্রণা জ্বালা নিরাময় করে। অষ্টাবক্রের শরীরিক জ্বালার সংস্পর্শে আসা জল থেকে বিভিন্ন তপ্তকুণ্ড সৃষ্টি হয়।
বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা অনুযায়ী, মাটির নিচে থাকা জল যখন তপ্ত আগ্নেয় শিলার কাছে অবস্থান করে এবং মাটির ওপরে উঠে আসে, তখনই এমন দৃশ্য দেখা যায়। অগ্নিকুণ্ডের জলের তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশি --- আশি ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। এই জলে এমন সব খনিজ পদার্থ আছে, যা খেলে অম্লরোগ সারে। তাই এই জল বিক্রিও হয়। অগ্নিকুণ্ডের জলে হিলিয়াম গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। পাশেই রয়েছে তার গবেষণাগার।
সৌভাগ্যকুণ্ডের আকর্ষণ সবচেয়ে বেশি। শীত পড়লেই গরম জলে স্নানের মজা নিতে পর্যটকরা এখানে হাজির হন। সৌভাগ্যকুণ্ডের পাশে রয়েছে একটি প্রাচীন কালী মন্দির। খাকিবাবার শিষ্য, পূর্ব বর্ধমানের দাঁইহাট গ্রামের হরিনারায়ণ মুখোপাধ্যায় এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এ যেন অনাদিকালের ঘুম ভাঙানোর জায়গা। ঘুরতে ঘুরতে হঠাত্ যে দৃশ্য চোখে পড়ল, তা দেখে মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। দিনশেষে সূর্যদেবের ছুটি। এবার তাঁর ঘুমোতে যাওয়ার পালা...মন্দিরের ভিতর থেকে ভেসে আসছে মন্ত্রোচ্চারণের সুছন্দ ধ্বনি।