`নারী দি বস`
আরও চার, পাঁচটা এই দিবস সেই দিবসের সঙ্গে নারী দিবসকে গুলিয়ে ফেলার কোনও মানেই হয় না। এর একটা আলাদা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে। সেই শাস্ত্র থেকেই যে ভাবে মেয়েদের দমন করার চেষ্টা এখনও চলছে, তাতে এই একটা দিন দরকার। আমাদের চারপাশটাকে একটু খুঁচিয়ে দেওয়ার জন্য। আমি আছি, আমরাও আছি বলে দেওয়ার জন্য। আর আমার কাছে নারী দিবস নয় সমস্তটাই `নারী দি বস`।
অদিতি রায় (সাংবাদিক, সঞ্চালিকা)
আরও চার, পাঁচটা এই দিবস সেই দিবসের সঙ্গে নারী দিবসকে গুলিয়ে ফেলার কোনও মানেই হয় না। এর একটা আলাদা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে। সেই শাস্ত্র থেকেই যে ভাবে মেয়েদের দমন করার চেষ্টা এখনও চলছে, তাতে এই একটা দিন দরকার। আমাদের চারপাশটাকে একটু খুঁচিয়ে দেওয়ার জন্য। আমি আছি, আমরাও আছি বলে দেওয়ার জন্য। আর আমার কাছে নারী দিবস নয় সমস্তটাই 'নারী দি বস'।
আর নারী দিবস নিয়ে এত বিতর্ক কেন আমি বুঝি না। আমরা তো প্রতিদিন নতুন করে পৃথিবীর আলো বাতাস নি। সেভাবে দেখতে গেলে প্রতিদিন নতুন করে জন্মাই সবাই। তাই বলে কি আলাদা করে জন্মদিন পালন করি না? ৮ মার্চ অনেকটা জন্মদিনের মত। বছরের বাকি দিনগুলোতো বাঁচা মরার হিসাব থাকে না। এই দিনটা নিজেকে বিশেষ ভাবে উপলব্ধি করার জন্য প্রয়োজনীয়। তবে তার মানে এই নয় এই একটা দিন মেয়েদের খুব সম্মান জানালাম, বড় বড় কথা বললাম, আর চোখ দিয়ে ধর্ষণ করলাম মেয়েদের। বাকি ৩৬৪ দিন সব ভুলে গেলাম। কারও যদি এই দিনটা পালন করতে সমস্যা হয় সে করবে না। কিন্তু সেটা নিয়ে বাঁকা মন্তব্যেরও কোনও প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
যুগ যুগ ধরে মেয়েদের যে জোর করে পিছিয়ে রাখা হয়েছে, সে বিষয়ে তো কোনও সন্দেহ থাকতে পারে না। এবং এখনও তারা পিছিয়ে আছে এটাও ভীষণ সত্যি। সার্বিকভাবে একটি মেয়েকে সমাজে ভোগ্যপণ্য হিসাবে দেখা হয়। নিজের চেষ্টাতেই মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেই এগিয়ে চলার পথটা আরও সুদৃঢ় করতে তাদেরকে সামনে নিয়ে আসতে হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এখনও কিছু ক্ষেত্রে সংরক্ষণের প্রয়োজন আছে। ভিড় বাসে, ভিড় ট্রেনে আমাদের মত প্রিভিলেজড, শহুরে, শিক্ষিত আপাতদৃষ্টিতে স্বাধীন মেয়েরাও কিন্তু লেডিস সিট, লেডিস কামরার খোঁজ করি। নিরাপত্তার স্বার্থে।
আসলে সমস্যার শিকড়টা অনেক গভীরে বিস্তৃত। মেয়েরা যে অর্ধেক আকাশ এটা একটা মেয়ের সঙ্গেই পুরুষদেরও উপলব্ধি করতে হবে। এখনও একটি শিক্ষিত মেয়ে নিজের ফাটাফাটি কেরিয়ারের বলি দেয় বিয়ে নামের তথাকথিত সামাজিক ইন্সটিটিউসনের স্বার্থে। বর যদি বিদেশে চাকরি করতে যায় তাহলে মেয়েটিকে নিজের সাধের চাকরি বিসর্জন দিয়ে বরের সঙ্গী হতে হয়। হয়ত বেছে নিতে হয় অপছন্দের কোন পেশা। এর বিপরীতটা প্রায় ঘটে না বললেই চলে। অদ্ভুত ভাবে মেয়েদের ছোট থেকেই শেখানো হয় এগুলো খুব স্বাভাবিক ঘটনা। পারিপার্শ্বিকের স্বার্থে মেয়েদের ইচ্ছা, অনিচ্ছা, স্বকীয়তা বিসর্জন দেওয়াকে মাহাত্মের মতো কঠিন শব্দের আড়ালে খুন করা হয়।
আসলে সমাজে মেয়েদের ক্যাটাগোরাইজড করা, সেকি কী পড়বে, কী পড়বে না সবটাই এখনও পুরুষরাই ঠিক করে দেয়। আমি নিজের পেশার ক্ষেত্রে দেখেছি যখন একটি দূর্ঘটনায় আহত ও নিহতদের সংখ্যা বোঝাতে আমরা বলি মোট নিহতের সংখ্যা এত, তার মধ্যে এতজন শিশু ও এতজন নারী। আর বাকিরা তার মানে মানুষ? এখনও একটি মেয়েকে মানুষ বলার আগে আমরা নারী হিসাবে চিহ্নিত করি। সমস্ত প্রগতিশীলতা কোথায় যেন একটা বিন্দুতে এসে শেষ হয়ে যায়। এটা একটা সামাজিক ব্যাধির মত। বৃহত্তর সাংস্কৃতিক বিপ্লব আর যথার্থ আর্থ সামাজিক কাঠামোর আমূল পরিবর্তন ছাড়া এই ব্যাধি সারিয়ে তোলার অন্য কোনও পন্থা নেই।
অনুলিখন: রায়া দেবনাথ