২০১৫-তে যে জিনিসগুলো ঘটল না
পার্থ প্রতিম চন্দ্র
বছরটা দেখতে দেখতে কেমন টুক করে কেটে গেল। বছরের হিসেবের খাতাটা ধুলো ঝেড়ে বের করতেই অবাক বনে গেলাম। আরে কী ব্যাপার, অনেক কিছুই তো বছরটায় ঘটল না। দেখুন সেগুলি এক নজরে--
১৫) সলমনের বিয়ে এ বছরও হল না-- সেই কবে থেকে মিডিয়া কানের কাছে শুধু ঘ্যান ঘ্যান করেই যাচ্ছে বিয়ে, বিয়ে, বিয়ে। কিন্তু কোথায় কী! সলমনের বিয়ের দাঁত এখনও উঠল না। ৫০ বসন্ত পেরিয়ে গেল তবু ব্যাচেলার বদনাম ঘুঁচল না। সেই গুজবেই আটকে থাকল ভাইজানের বিয়ে। তবে প্রতিবারের মত এবারও সবাই বলছেন, পরের বছর মানে ২০১৬-তে ভাইজান বিয়ে করবেনই। আসলে হিট অ্যান্ড রানের মামলার ঝামেলা মিটে গেছে, হবু বৌদি মানে রোমানিয়ান গার্লফ্রেন্ড লুলিয়া ভানতুরও ডোলি সাজিয়ে বসে আছে। শুধু ভাইই এখনও বজরঙ্গি হয়ে বসে, 'তেরে নাম' মুখে নিয়ে 'দিলওয়ালে' হতে পারেননি।
১৪) পৃথিবী ধ্বংস হল না--এই যাবে। এই গেল। এই গেল বলে। হতে হতেও হল না। সেই কবে থেকে শোনা যায় পৃথিবী এবার ধ্বংস হবে। ২০১২ সালে খবরটা এতও জোরালো হল হলিউড একেবারে ঝক্কাস একটা সিনেমা বানিয়ে দিল। তবে কী ১২ গেল, ১৩ গেল, ১৪ গেল। গুজবটা কোমর বেঁধে নেমে পড়ল। ১৫-তে এসেও বারদুয়েক শোনা গেল 'এই তো কাল, পরশু ধ্বংস, তার আগে তৈরি হয়ে নিন'। যাক বাবা এবছরটাও বেঁচে নেওয়া গেল। পৃথিবীটা এখনও পৃথিবীতেই থাকল।
১৩) দাউদ এখনও ধরা পড়লেন না--৬০ বছরের জন্মদিনটা করলেন একেবারে তাক লাগিয়ে। আর লুকোছাপা নয় পাকিস্তানেই যে তিনি রয়েছেন সেটাও প্রমাণ হয়ে গেল। তবু অধরা। তিনি হলেন শ্রীমান দাউদ ইব্রাহিম কসকর। ভারতের 'মোস্ট ওয়ান্টেড' অপরাধী। ক্ষমতায় এলেই তাকে খপ করে ধরে জেলে পুরে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে, এমন প্রুতিশ্রুতি দিয়ে দেশের মসনদে বসেছেন এক গুজরাটি। তবে দাউদের তাতেই বয়েই গেল। এখনও জন্মদিনে ছুরি দিয়ে কেক কাটছেন, আর বন্দুক দিয়ে শাসন করছেন।
১২) বলিউড এখনও বলিউডেই থাকল--সে তো বটেই বলিউড তো বলিউডেই থাকবে। যেমন আপনি থাকবেন আপনিতে, আমি আমিতে। তবু এ কথা বলা কেন? আসলে বলা উচিত ছিল ২০১৫-তে এসেও কোনও বলিউড সিনেমা অস্কার পেল না। ওটা তো দূর অস্ত, সামান্য ব্যাপারেও আমরা সেই তিমিরেই থাকলাম। বলিউডে নায়ক-নায়িকা-পরিচালকরা মাঝেমাঝে এমন সব দাবি করে বসেন তাতে মনে হয় এই বোধহয় হলিউডকে ছুঁয়ে ফেলল বলিউড। এই তো ক দিন আগে এক নায়ক (নামটা বললাম না, জানি ওটা আপনি ঠিক বুঝে নেবেন) হাত দুটো ছড়িয়ে ঢিলবালে সুর চড়িয়ে তাঁর ছবির প্রচারে এমন সব কথা বললেন, মনে হল এই তো হলিউডের সিনেমার মত দারুণ সব চোখধাঁধানো জিনিস দেখা যাবে। ও মা, সিনেমা হলে গিয়ে তো ভিড়মি খাওয়ার জোগাড়। কোনও গল্প নেই, অ্যাকশনের মাথামুন্ডু, হাসির যুক্তি নেই, ডায়লগের গাছপাথর নেই। আছে তো আছে, নেই টাও নেই। শুধু এই সিনেমাটা কেন বলিউডে বছরে যত সিনেমা তৈরি হল তার ৭০ শতাংশ কেন হল, কিসের খাতিরে হল, কি পেল। এসব প্রশ্নের কোনও যুক্তি নেই। অথচ এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। বাজেট আছে, দক্ষ-গুণিসব মানুষ রয়েছেন, বলিউড ছবিকে বেচার ভাল সব পন্থা রয়েছে। তবু কেন হলিউড বা আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া যাবে না তা ২০১৫-তে এসেও জানা গেল না।
১১) 'আচ্ছে দিন' এল না--বাবা এই 'আচ্ছে দিন' কথাটা এতবার শুনেছি যে কানও মাঝে মাঝে বলত আমি মুখ হয়ে গিয়েছি। সেই বিখ্যাত 'আচ্ছে দিন' ২০১৫-তে এসেও আমাদের কারও মালুম হল না। না, না, আপনাকে কোনও রাজনৈতিক দলের সমর্থক, অর্থনীতিবিদ, পরিসংখ্যানবিদ হতে হবে না। কেন্দ্রে নতুন সরকার আসার এখন দেড় বছর হয়েছে। তাতে আচ্ছে দিন আনা যায় কি না সেটা জানি না। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম, চাকরিবাকরির অবস্থা, কালবুর্গি হত্যা, শাসক দলের নেতাদের বাচনভঙ্গি দেখে স্পষ্ট বলে দেওয়া যায় 'আচ্ছে দিন' এখনও সেই 'বুরে দিনে'র রাস্তাতেই ঘুমোচ্ছে।
১০) এখনও আপনি একটা টুইটও করলেন না ---হ্যাঁ আপনি ফেসবুকে বছরে অন্তত হাজারখানেক পোস্ট, বহু ছবি আপলোড করেছেন। হোয়াটসঅ্যাপে দারুণ অ্যাকটিভ। বুঝি না বুঝি না করেও ইনস্টগ্রামেও খাতা খুলবেন খুলবেন করছেন। কিন্তু টুইটারে আপনি এখনও সচল হলেন না। যদিও বা টুইটারে আপনার অ্যাকাউন্ট আছে, তবু এখনও সেখানে নিজের একটা টুইটও করলেন না। আসলে টুইট করে আখেরে আপনার কী লাভ সেটা এখনও বুঝে উঠতে পারেননি। সমীক্ষায় প্রকাশ টুইটারে অ্যাকাউন্ট থাকা অন্তত ৭০ শতাংশ ভারতীয় কোনওদিন টুইট করেননি।
(যদি করে থাকেন তা হলে এটা আপনার জন্য নয়)
৯) ফেসবুকে 'ডিসলাইক' এখনও মানুষ করতে পারল না--- একটু কিছু হলে সেই কবে থেকে 'লাইক' করে করে পাগল হয়ে যাচ্ছে মানুষ। মোটা পিসি, রোগা কাকার মাঝে চুড়িদার পরে দাঁড়িয়ে থাকা কোনও মেয়ের ছবিতেও 'লাইক'। আবার বন্ধু মদ খেয়ে বমি করে ভাসিয়ে দেওয়ার ছবি, তাতেও 'লাইক। প্রেমিকার পোস্টেও 'লাইক', প্রেমিকার বান্ধবীর পোস্টেও 'লাইক'। মৃত্যুতেও 'লাইক', জন্মেও লাইক। বন্যায় 'লাইক', ঝড়েও 'লাইক'। এত 'লাইক' দিতে দিতে মানুষ এবার ক্লান্ত। মানুষ জন্মগত ইনোভেটিভ, অল্পতে বোরিং হয়ে গিয়ে নতুন কিছু করতে চায়। আর তাই এবার 'লাইক' নয় 'ডিসলাইক'-এর গুষ্টির পিন্ডি করতে চায়। পছন্দ না হলেই মানুষ নাক উঁচিয়ে ডিসলাইক দেবে এটাই তো ভাইরাল হওয়ার কথা। জেলাসি থেকে 'ডিসলাইক', চাপা ভাললাগা থেকে 'ডিসলাইক', রাগাতেও 'ডিসলাইক', জ্বালাতে 'ডিসলাইক'। তবে না গিয়ে মজা। তবু এত চেঁচামেচির পরেও জুকারবার্গ দা এখনও ফেসবুকের পাতে ডিসলাইক ডিস আনলেন না।
৮) ভারত এখনও অলিম্পিকের জন্য তৈরি হল না-- ভারত এমনিতে একটু লেট রাইজার। আর সেটা খেলাধুলোর কথা হলে তো কথাই নেই। এই তো দেখুন না ২০১৬ অগাস্টেই রিও অলিম্পিক। ভিতরের যা খবর তাতে চিন, আমেরিকা এর মধ্যেই সব প্রস্তুতি সেরে ফেলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, অলিম্পিকের মত মেগা ইভেন্টের জন্য অন্তত এক বছর আগে সব প্রস্তুতি নিয়ে তৈরি থাকতে হয়। কিন্তু ভারত অত শত ভাবে না। যখন হবে তখন দেখা যাবেই, বিশ্বাসী। মানে শোলের গব্বর সিংয়ের মত। যখন জয়-বীরু আসবে তখন দেখা যাবের এখন তো ডায়লগ দিয়ে যাই। সেইরকমই ব্যাপার আর কী। দেশের ছোট বড় সব প্রতিযোগীই বলছেন, তাদের অসহায়তার কথা। ২০১৫ সালের অবহেলাটা ২০১৬-এসে পস্তাতে হতে পারে।
৭) আইএসএল ফের হল, কিন্তু ভারতীয় ফুটবলের ঘুম এখনও ভাঙল না-- ঢাক পিটিয়ে উদ্বোধন হল। রবার্তো কালোর্স, জিকো থেকে বড় বড় সব ফুটবলার এলেন। অাম্বানির সুন্দরী বউ কাগজ দেখে দেখে মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রুতিশ্রুতি দিলেন ভারতীয় ফুটবল বদলে যাবে। ১২০ কোটি ভারতবাসী ভেবে নিল এবার বোধহয় বিশ্বকাপ দূরে নয়। কিন্তু কোথায় কী!!! ভারতীয় ফুটবলের ঘুম এখনও ভাঙল না। বছর ঘুরলেই দেশের মাটিতে অনুর্ধ্ব ১৭ বিশ্বকাপ। কিন্তু কোথায় কী। ওই দু একটা মিটিং, আর মাঠ পরিদর্শন। তার বাইরে শুধু...
৬) কালো টাকা এখনও দেশে ফিরল না--কোথায় কালো টাকা। সংসদে অনেক কথা হল। প্রতিশ্রুতি দিয়ে মসনদে বসা হল। কাগজ জুড়ে লেখা হল কালো টাকা কী ও কেন। ওয়েবসাইটে দেওয়া হল কালো টাকা ফেরানোর পাঁচ উপায়। কিন্তু কোথায় কী। টাকার রঙটা কালো বলেই অন্ধকারে থাকল।
৫) কেজরিওয়ালের সমস্যা এখনও মিটল না--আম আদমির আশীর্বাদ কুড়িয়ে কেজরিওয়াল ইতিহাস গড়ে দিল্লি দখল করলেন। ভারতীয় নির্বাচনে অন্যতম বড় জয়ের পর কোথায় দু দণ্ড জিরোবেন তার উপায় নেই। বছরভর নানা সমস্যায় কাটালেন কেজরি। কখনও তার মন্ত্রীরা ভুয়োডিগ্রি কাণ্ডে জড়ালেন। কখনও দলের বর্ষীয়ান নেতা বউ পিটিয়ে জেলে গেলেন। কখনও আবার নিজে লালুর সঙ্গে হাত মিলিয়ে সমস্যা পড়লেন। তবে কী অনেকেই বলেন, পেখম ছাড়া যেমন ময়ূর মানায় না, কেশর ছাড়া সিংহ বেমানান। তেমনই বিতর্ক ছাড়া কেজরি ঠিক আম আদমির ভাষা হন না।
৪) 'পাপ্পু' এখনও পাশ করল না--রাহুল গান্ধীকে তাঁর বিরোধীরা পাপ্পু নামেই ডাকে। তাতে অবশ্য রাহুলের ক্যারিশমা (যেটা ২০০৯ লোকসভা নির্বাচনে ছিল) বিন্দুমাত্র খাটো হয় না। কিন্তু দিল্লি, বিহারে বিজেপির মহাপতনের পরেও রাহুল এখনও পাশ মার্ক পেলেন না। পাবেনই বা কী করে। দুটো ক্ষেত্রেই তো সব ক্ষীর খেয়ে গেলেন কেজরি, লালু-নীতীশরা। মাঝেমাঝে ছুটি নিয়ে বিদেশ সফরে গিয়ে নম্বর আরও কাটা গেল।
৩) মঙ্গলে এখনও একটা ঘরও তৈরি হল না--কোথায় কী। বছরের শুরুতে এক সংস্থা রেশন কার্ড পর্যন্ত করে দিল। জায়গা-জমি কেনাকেটার চুক্তিপত্রও নেটে দেওয়া হল। মানুষ তাতে ফর্মও ভরল। কিন্তু কোথায় কী। মানুষ এখনও পৃথিবীতেই পচছে (না না শুধু বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য বলছি না)। মঙ্গল এখনও জঙ্গলের মতই বাস অযোগ্য হয়ে রয়েছে।
২) মদন মিত্র জেল থেকে এখনও বের হলেন না--না, না মন্ত্রীমশাই তকমা ঝেড়ে ফেলেও মদন মিত্রও এখনও শ্রীঘরেই রইলেন।। টুক করে একেবার ফাঁকতালে বের হলেন। কিন্তু আবার চোখ রাঙিয়ে দিলেন বিচারপতি ঢুকিয়ে। দাদার এখনও হাঁসফাস অবস্থা, আর ক টা মাস পরেই কত বড় নির্বাচন। তবু কোথায় কী! এদিকে সবাই ইলেকশনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, আর দাদা কোথায় কারেকশনের চেষ্টায় রয়েছেন।
১) জীবনটা বদলে গেল না--২০১৪ ডিসম্বরের ৩১ তারিখ যে স্বপ্নটা দেখে ছিলাম আমরা সবাই। সেটা পূর্ণ হল না। নিষ্ঠুর জগতের নির্মম সত্যিগুলো আমাদের ইচ্ছা, স্বপ্ন, ভাললাগাগুলোকে চেপেই রেখে দিল। জীবনটা রয়ে গেল সেই চেনা ছকেই। তবে এজন্যই বোধহয় জীবনটা এত সুন্দর। আবার এ বছর ৩১ তারিখ শুতে যাব সেই স্বপ্ন চোখে যে জীবনটা ২০১৬-তে বদলে যাবে। দেখা যাক কী হয়...