ফিরে এস ঋতুপর্ণ, নতুন বছরে রামধনুর লড়াই চাইছে তোমায়...
১১ ডিসেম্বর। বছর শেষের মাসের এই দিনটা হঠাৎ করে বদলে দিল এদেশের বহু মানুষের জীবন। তাদের ভালবাসার অধিকারে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের ছাপ্পা পড়ল। সৌজন্যে দেশের শীর্ষ আদালত। ২০১০সালের দিল্লি হাইকোর্টের রায় নস্যাৎ করে সুপ্রিমকোর্ট এই দিনই ঘোষণা করল, বহাল থাকবে ৩৭৭ ধারা। আদালত বলছে এই ধারার লিখিত কিছু নিয়মাবলীর উল্টোদিকে হেঁটে নিজের ভালবাসার জানান দিলেই সব্বোনাশ। একুশে আইনের দেশে ঢুকতে হবে জেলে। বৃহদার্থে সবার উপর এই আইনের কচকচি ন্যাস্ত হলেও আসলে ৩৭৭ ধারা সরাসরি আক্রমণ হেনেছে সমকামী, উভকামী, রূপান্তরকামী মানুষদের ভালবাসার অধিকারের উপর। নিজের পছন্দের মত যৌনসঙ্গী নির্বাচনের অধিকারের উপর।
১১ ডিসেম্বর। বছর শেষের মাসের এই দিনটা হঠাৎ করে বদলে দিল এদেশের বহু মানুষের জীবন। তাদের ভালবাসার অধিকারে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের ছাপ্পা পড়ল। সৌজন্যে দেশের শীর্ষ আদালত। ২০১০সালের দিল্লি হাইকোর্টের রায় নস্যাৎ করে সুপ্রিমকোর্ট এই দিনই ঘোষণা করল, বহাল থাকবে ৩৭৭ ধারা। আদালত বলছে এই ধারার লিখিত কিছু নিয়মাবলীর উল্টোদিকে হেঁটে নিজের ভালবাসার জানান দিলেই সব্বোনাশ। একুশে আইনের দেশে ঢুকতে হবে জেলে। বৃহদার্থে সবার উপর এই আইনের কচকচি ন্যাস্ত হলেও আসলে ৩৭৭ ধারা সরাসরি আক্রমণ হেনেছে সমকামী, উভকামী, রূপান্তরকামী মানুষদের ভালবাসার অধিকারের উপর। নিজের পছন্দের মত যৌনসঙ্গী নির্বাচনের অধিকারের উপর।
তবে, থেমে থাকেনি দেশ। প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে। রামধনু রঙিন পৃথিবীর দাবিতে, স্বাধীনতার দাবিতে, অস্তিস্ত্বের দাবিতে পথে নেমেছে মানুষ। এবং হ্যাঁ, শুধু সমপ্রেমী মানুষেরাই নন। তাদের সঙ্গে একই ভাবে প্রতিবাদ করেছেন বিসমপ্রেমী মানুষরাও। দু`জন ব্যক্তি মানুষের একান্ত পছন্দের পরিসরে আদালত, রাষ্ট্রের অন্যায় নাকগলানোর বিরুদ্ধে একুশ শতকের এদেশ তার পরিণত মনের জানান দিয়েছে। কিন্তু এই সব কিছুর মধ্যেও এসময়ের দেশ বড় অভাব বোধ করছে তাঁর। যিনি তাঁর অস্তিত্ব দিয়েই বার বার ভেঙেছেন সমাজের পুরুষতান্ত্রিক, হেটেরোনর্মাটিক দৃষ্টিভঙ্গীর চাপিয়েদেওয়া ঘেরাটোপ। দৃপ্তভাবে জানান দিয়েছেন তাঁর তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার। সমস্ত অন্যায় বিকৃত পরিহাস ফুৎকারে উড়িয়েছেন। তাঁর প্রতিভায় যেমন সমৃদ্ধ হয়েছে ভারতীয় সিনেমা জগৎ, তাঁ অনমনীয় ব্যক্তিত সাহস জুগিয়েছে সেই সব মানুষদের, যাদের তথাকথিত ভিন্ন যৌন অভ্যাসকে সমাজ গায়ের জোরে প্রান্তিক করে রাখতে চেয়েছে। সেই তিনি, ঋতুপর্ণ ঘোষ, মে মাসের এক মনখারাপের সকালে হঠাৎ করে ছেড়ে চলেগেছেন আমাদের। অনেক না বলা কথা, না বলা কাজ অপূর্ণ রেখেই। আজকের এই অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে ভীষণ ভীষণ ভাবে অভাব বোধ হচ্ছে তাঁর। তাঁর দৃপ্ত উপস্থিতির।
চিত্রপরিচালক হিসাবে ঋতুপর্ণের তুলনা তিনি নিজেই। কিন্তু অভিনেতা ঋতুপর্ণকে পাওয়া গেল একটু আলদা ভাবে। উল্টোপথে হেঁটে তাঁর প্রতিটি অভিনয়ের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠা করছেন প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের অধিকার, চাওয়াপাওয়া।
তাও বছর দশেক আগের কথা। ২০০৩। অভিনেতা হিসাবে ঋতুপর্ণের প্রথম আত্মপ্রকাশ উড়িয়া ছবি উড়িয়া কোথা দেখিলি মা কু-তে। তারপর বিরতি। তবে থেমে থাকেনি পরিচালনার কাজ। আর সেখানেই বারবার উঠে এসেছে পরিচালক ঋতুপর্ণের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অভিনয় সত্বা। উঠে এসেছে পুরুষের আবরণে বদ্ধ এক নারীর কথা। উঠে এসেছে পুরুষ খোলসে এক নারী মনের পছন্দ,অপছন্দ, প্রেম, বিরহ,যন্ত্রনা। রক্ষণশীল সমাজের সংস্কার কে রীতিমত চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে সিনেমার পর্দায় অভিনেতা হিসাবে দেখা গেল ঋতুপর্ণ ঘোষকে।
২০১০ সালে আর একটি প্রেমের গল্পে চপল ভাদুড়ির ভূমিকায় সেলুলয়েডে আত্মপ্রকাশ হল এক স্পর্ধিত অভিনেতার। পুরুষের শরীরে যে মন নারীর। তাকেই সম্মানের সঙ্গে স্বীকৃতি দিলেন অভিনেতা ঋতুপর্ণ ঘোষ। সমাজে সমকামী, উভকামী, রূপন্তরকামী মানুষদের অনুভূতি ভাষা খুঁজে পেল তাঁর অভিনয়ে।
পরের আত্মপ্রকাশ দুহাজার এগারোয় মেমরিস ইন মার্চ ছবিতে। সেখানেও নারীত্বের স্পর্ধিত উচ্চারণ। স্পর্ধিত উচ্চারণ সম্পর্কের রসায়নেও। ধরা বাঁধা ছকের বাইরে বেরিয়ে দুই মানুষের সম্পর্ককেই শেষ সত্যি বলে প্রতিষ্ঠা করলেন আসাধারণ অভিনয়ে।
২০১২তে আরও একবার পর্দায় এলেন ঋতুপর্ণ। তাঁর নিজের ছবি চিত্রাঙ্গদার হাত ধরে। ক্যামেরার পিছনেও তিনি। আরেকটি প্রেমের গল্প, মেমরিজ ইন মার্চের হাত ধরে এলজিবিটি আন্দোলনের একটা অন্য ধারা তৈরি হয়েছিল চিত্রাঙ্গদায় তা সম্পূর্ণতা পেল।
না, কোনও দিন রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে সামিল হননি তিনি। কিন্তু ঋতুপর্ণের সমগ্র অস্তিত্বটাই ছিল সমাজের বুকে তীব্র এক থাপ্পর। নিজের যৌন অবস্থান, ভাবনা সম্পর্কে তিনি ছিলেন অকপট। সেই ভাবনার প্রতিফলন ঘটেছিল তাঁর অভিনীত এই তিনটি সিনেমায়। একই বিষয় ভিত্তিক ট্রিলজিতে।
অবরুদ্ধ সমাজের সমালোচনায় বিদ্ধ হয়েছে তাঁর অভিনয় প্রতিভার সাক্ষর বুনে রাখা এই তিনটি ছবি। হয়ত এখনও সমাজ এই তিনটি ছবিকে সম্পূর্ণ বুঝে ওঠার মত প্রাপ্তমনস্কহয়ে উঠতে পারেনি।
ঋতুপর্ণ চলে গেছেন। রেখে গেছেন তাঁর সৃষ্টি। কিন্তু এই তিনটি ছবির মাধ্যমে তিনি হয়ত বেশ কয়েক কদম এগিয়ে দিয়ে গেলেন সমাজে জোর করে প্রান্তিক করে রাখা বহু মানুষের অধিকারের লড়াইকে। তাঁর শরিরী উপস্থিতি এখন আর আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু তাঁর `ভিন্ন` যৌনতার অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই তাঁর সৃষ্টির হাত ধরে আজ আরও বেশি বাঙময়।