মহিলারা কি কর্মক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা পান?

মহিলারা কি কাজের জায়গায় বাড়তি সুবিধা পান? `আন্তর্জাতিক নারী দিবস`-এ এই বিতর্কতেই ফের উস্কে দিলাম আমরা। পক্ষে ও বিপক্ষে নিজেদের মতামত দিলেন অভিনেতা, রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন মহলের মানুষ।

Updated By: Mar 8, 2012, 04:16 AM IST

মহিলারা কি কাজের জায়গায় বাড়তি সুবিধা পান? 'আন্তর্জাতিক নারী দিবস'-এ এই বিতর্কতেই ফের উস্কে দিলাম আমরা। পক্ষে ও বিপক্ষে নিজেদের মতামত দিলেন অভিনেতা, রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন মহলের মানুষ।

পক্ষে

সুদীপ্ত সেনগুপ্ত (সাংবাদিক) : মেয়ে হওয়ার সুবাদে আমাদের দেশে কিছু মানুষ
কর্মজগতে সুবিধা পান তার কারণ, সেখানে অধিকাংশই পুরুষ। পুরুষরা, মেয়েদের
সান্নিধ্য পছন্দ করে এবং তা পায় না। মেয়েরা তাই অফিসে বেশি মনোযোগ পান,
বেশি নজর পান। পুরুষরা তাদের আগ বাড়িয়ে সাহায্য করে এবং যেহেতু সাধারণত
পুরুষের সংখ্যা অনেক বেশি, তাই অঙ্কের নিয়মে একজন নারীকে তুষ্ট করার জন্য
বহু পুরুষের মধ্যেই প্রতিযোগিতা চলে। তাই বুদ্ধি করে চলতে পারলে বিশেষ
কোনও ত্যাগ স্বীকার না করেই বাড়তি সুবিধা নেওয়া সম্ভব।

রাধিকানাথ মল্লিক (আইনজীবী) : হ্যাঁ, নিশ্চই মহিলারা বিশেষ সুযোগ পায়।
সম্প্রতি রাজ্য সরকার মহিলাদের জন্য ২ বছরের সবেতন মাতৃত্বকালীন ছুটি ঘোষণা
করেছে। এখন তো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জয়েন্ট ফ্যামিলি নেই। সেক্ষেত্রে
মহিলারা যদি বিশেষ সুবিধা পায়, তাহলে পুরুষদেরও পাওয়া উচিত্‍। নারী পুরুষকে
সমান বলা হয়, কিন্তু কীভাবে সেই সমতা রক্ষা হচ্ছে! নারী পুরুষ দুজনের
জন্যই দুটো ভিন্ন কর্মক্ষেত্র হওয়া উচিত্‍।  

সোমনাথ মুখার্জি (আইনজীবী) : প্রথমেই বলি কর্মক্ষেত্রে একটা বৈষম্য আছে।
করছাড় মহিলাদের বেশি, যেখানে পুরুষদের অপেক্ষাকৃত বেশি কর দিতে হয় একই কাজের
জন্য। এই বিষয়ে আমি কোনও যৌক্তিকতা খুঁজে পাই না। মেয়েদের সুরক্ষা দেওয়ার
জন্য অনেক আইন তৈরি হয়েছে কিন্তু যারা সেই সুরক্ষা দেবে সেই পুরুষদের জন্য
কিন্তু কোনও আইন করা হয়নি।
রেশমী রায় (গৃহবধূ) : কর্মক্ষেত্রে অবশ্যই মেয়েরা বেশি সুবিধা পায়।
সংরক্ষণের বিষয়ে সুবিধা পায়। নিজের যোগ্যতার জন্য পেতে চায় না। সবাই বলছে
মেয়েরা এগিয়ে গিয়েছে। মেয়েরা যদি সত্যি এগিয়ে থাকত তাহলে নিজেদের দায়িত্ব
নিজেরাই নিতে পারত। মেয়েরা ইচ্ছেমতো পোশাক পরবে, রাত দুপুরে মদ খাবে, নাইট
ক্লাবে যাবে। তার জন্য সতর্ক থাকতে হবে পুরুষদের। কিন্তু এই একই কাজ
পুরুষরা করলে তাদের লম্পট বলা হয়। যোগ্যতা দিয়ে যে এগোতে হবে সেটা নারীরা
ভুলে গিয়েছে। আগে নারীর একটা সম্মান ছিল, সত্বা ছিল, সেই কারণেই হয়তো রাজা
রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর মেয়েদের শিক্ষার কথা বলেছিলেন। কিন্তু এখন অন্যের
ওপর দোষ চাপিয়ে, দায় এড়িয়েই ভাল থাকতে চায় মেয়েরা। এভাবেই তারা পিছিয়ে
পড়ছে। নারীদের নিয়েই রাজনীতি হয় পুরুষদের নিয়ে হয় না। মহিলা ও শিশুকল্যাণ নিয়েই রাজনৈতিক দলগুলি বেশি প্রাধান্য দেয়। কিন্তু পরিসংখ্যানগত দিক থেকে
পুরুষদের আত্মহত্যার সংখ্যা নারীদের থেকে তিন গুণ বেশি। সেবিষয়ে কেউ ভাবে
না।

ডিএন হালদার (ব্যাংককর্মী): একই কর্মক্ষেত্রে বাড়ি যাওয়ার সময় অজুহাত
দেখিয়ে মহিলারা অনেক ছাড় পান। কিন্তু পুরুষদের ক্ষেত্রে হাজারো সমস্যার
সম্মুখীন হতে হয়। নারীদের ক্ষেত্রে এই শিথিলতা কেন হবে? নারীদের প্রাপ্য
আইনি সুযোগ ব্যবহার করে বহু পুরুষকে হেনস্থা করা হয়। তাই নারীদের বিশেষ
সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে ভাল করে বিবেচনা করা উচিত। সমান কাজ, সমান অধিকার।
কিন্তু মানুষের তৈরি আইনেই কর্মক্ষেত্রে সৃষ্টি হচ্ছে বৈষম্য। 

বিপক্ষে
শঙ্কর চক্রবর্তী (অভিনেতা) : মহিলারা কিছু ক্ষেত্রে বেশি সুবিধা পেতেই পেতেই পারে এবং যেটা তাদের দেওয়াও হয়, যেমন মাতৃত্বকালীন ছুটি। এরপরও যখন সন্তান ছোট থাকে তখনও কিছু বিশেষ সুবিধা পেতেই পারে। কর্মক্ষেত্রে মহিলারা পুরুষদের থেকে সেশি সুবিধা পায় কিনা সেটা একটা বিতর্কিত বিষয়। কিন্তু আমার মনে হয় সবক্ষেত্রেই যে মহিলারা বেশি সুবিধা পায় তেমন নয়।
দেবজ্যোতি মিশ্র (সুরকার): আমরা শহুরে পরিবেশে একথা বলছি কিন্তু সারা ভারতে দেখতে গেলে মহিলারা এখনও পুরুষদের থেকে অনেকটাই পিছিয়ে। মহিলারা যখন কাজ করেন তখন তার সঙ্গে কিছু প্রশ্ন উঠে আসে, যেমন তিনি কখন বাড়ি ফিরবেন! শহরে মেয়েরা মিড়িয়া থেকে শুরু করে সর্বত্র কাজ করছেন। কিন্তু সেটা খুবই সীমিত। সারা ভারতের ছবিটা কিন্তু এক নয়। সেক্ষেত্রে মহিলারা এখনও অনের পিছিয়ে। কর্মক্ষেত্রে দেখতে গেলে বেশিরভাগ সংস্থা, অফিসের হেড কিংবা প্রধান কিন্তু পুরুষই। সেই পরিসংখ্যানগত দিক থেকে মহিলাদের সংখ্যা যথেষ্ট কম। বিশেষ বিশেষ কাজে বৈষম্য দেখা যায়। যেমন, মায়া মমতার জন্য মহিলারাই নার্স হন। বাড়ির কাজের লোকও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মহিলারাই হন। মহিলাদের বিশেষ বিশেষ কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়।
শর্বরী দত্ত (ফ্যাশন ডিসাইনার) : আমি সম্পূর্ণ বিরোধী এই বক্তব্যের। মন থেকে বলছি না, অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। শহরে কিংবা গ্রামে যারা দিনমজুর, সেখানে মহিলারা পুরুষদের থেকে কম মজুরি পায়। ১০০ দিনের কাজেও তাই হয়। কখনও শুনিনি যে মহিলারা বেশি সুবিধা পায়, উল্টে এরকম শুনেছি যে তাদের কাজে দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। যদি কোনও ক্ষেত্রে কোনও সহকর্মী রোম্যান্টিক হয়ে তার জন্য কিছু সুবিধা দেয় সেটা অন্য বিষয়। সাধারণত আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে মেয়েরা অনেক কষ্ট সহ্য করেই কাজ করে। ১০ বছর আগেও আমেরিকায় কয়েকটি কর্মক্ষেত্রে একইরকম কাজে মেয়েরা কম সুবিধা পেত। আমি যখন কর্মক্ষেত্রে পা রেখেছিলাম তখন প্রথমে কোনও বৈষম্য বুঝিনি। পরে যখন সফলতা অর্জন করলাম তখন কিন্তু অনেকেই বাঁকা চোখে দেখেছে। 'ট্রেন্ড সেটার' হিসেবে সারা ভারতে আমি যথেষ্ট স্বীকৃতি পেয়েছি। ফ্যাশন জগতে ২০ বছর ধরে শীর্ষে থাকা 'নট আ ম্যাটার অফ জোক'।
তথাগত রায় (রাজনীতিবিদ) : নিজের পেশার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, যখন রেলের নির্মাণ বিভাগে কাজ করতাম, মহিলা বলে রোদে বেশিক্ষণ থাকতে পারবেন না, তারপর তাদের শৌচালয় নিয়ে সমস্যা থাকে। কিন্তু এমনও দেখেছি এই সমস্ত সমস্যা উপেক্ষা করে মহিলারা সারাদিন রোদের মধ্যে কাজ করেছেন। তার মানে এরকমও নয় যে সব মহিলাই এরকম কাজ করেন। এখনও মানুষের মধ্যে অনেক কুসংস্কার রয়েছে যে মেয়েরা সব কাজ করতে পারেন না। 'এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার'এর কাজে মেয়েরা নাকি উপযোগী নয় কারণ তারা অনেক বেশি নার্ভাস। কয়েকটি কাজ আছে যেমন নার্সিং, এয়ারহোস্টেস যে ক্ষেত্রগুলিতে মেয়েরাই উপযোগী। কিন্তু তাছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে পুরুষরাই এখনও বেশি সুবিধা পেয়ে থাকে। দুর্বা ব্যানার্জি প্রথম মহিলা পাইলট। মহিলারা কোনও দিক থেকেই পিছিয়ে নেই, কিন্তু জোর করে সেই জায়গাটা তৈরী করতে হয়েছে। মেয়েরা বেশি সুবিধা পায় এরকম নয়।
সমীক লাহিড়ি (রাজনীতিবিদ) : আমাদের দেশে তো দেখি মেয়েরা ভালো কাজ করেও যোগ্য স্বীকৃতি পায় না। রাজনৈতিক ক্ষেত্র থেকে প্রশাসনিক ক্ষেত্র সর্বত্রই তা প্রমাণিত। আইটি সেক্টরে মেয়ে বলে কাজ করতে দেওয়া হোত না। বিশেষ কোনও সুবিধা মহিলারা পায় বলে তো মনে হয় না। বরং কর্মক্ষেত্রে তাদের অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়। কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যও আছে, যেমন আগে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং মেয়েদের পড়তে দেওয়া হোত না। কিন্তু এখন দেওয়া হয়। মহিলারা ৬ মাস পর্যন্ত মহাকাশে থেকে আসছে, আর কী পরীক্ষা দিতে হবে তাদের! আর শারীরিক কিছু সমস্যার জন্য মেয়েরা সুযেগ পেতেই পারে। হাজার চেষ্টা করলেও যেমন পুরুষরা মা দতে পারবেন না। প্রাকৃতিক ও শারীরিক দিক থেকে সেরকম কিছু বৈষম্য আছে। সেই কারণে কিছু সুবিধা মহিলারা পেয়ে থাকেন।
নির্বেদ রায় (রাজনীতিবিদ) : মহিলারা যদি মহিলা বলে কোনও ক্ষেত্রে বেশি সুবিধা পেয়ে থাকে 'জেন্ডার' হিসেবে সেটা মহিলাদের কাছে খুবই অপমানজনক। প্রশাসনিক কাজেও মহিলারা অনেক বেশি মনোযোগী। সততার দিক থেকেও মেয়েরা পুরুষদের থেকে এগিয়ে সেটা প্রমাণিত। কয়েকটি ক্ষেত্রে শারীরিক কারণে বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু তাছাড়া মহিলাদের পিছিয়ে রাখার জায়গা নেই। আগে মহিলারা শুধু ঘর সামলাতো, সংসারের কাজ করত। কিন্তু এখন মহিলারা প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন। কিছু সামাজিক সমস্যা অবশ্যই আছে। মাতৃত্বকালীন ছুটি, সন্তান যখন ছোট থাকে সেই সময় কিছু অতিরিক্ত সুবিধা পেয়ে থাকেন মহিলারা। যে সব মহিলারা রাতে কাজ করেন তাদের কিছু বেশি সুবিধা দেওয়া হতে পারে নিরাপত্তার কারণে। সেইটুকু দিতেই হয়। তাছাড়া যদি মহিলা হিসেবে কিছু বেশি সুবিধা পায় তবে সেটা মহিলাদের কাছে খুবই অপমানজনক।

 
   
 

.