ফিতের ফাঁসে জীবন হাসফাঁস
স্বরূপ দত্ত
যখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি, তখনই প্রথম নামটা শুনেছিলাম তাঁর। রাধানাথ সিকদার। কী করেছিলেন ভদ্রলোক? এভারেষ্টকে মেপে ছিলেন! ওই একই ক্লাসে পড়াকালীন শুনে ফেলেছিলাম আরও দুটো লাইন। তেনজিং নোরগে এবং এডমণ্ড হিলারি। স্কুলে যখন শিক্ষকরা পড়াতেন, তখন ওঁরা অনেক বেশি রোমাঞ্চ অনুভব করতেন তেনজিং নোরগে বলার সময়। সেটা তাঁদের কন্ঠস্বরেই টের পেতাম। কিন্তু আমার মনে সেই ছেলেবেলা থেকেই আসন পেতে বসে পড়ছিলেন মানুষটা। রাধানাথ সিকদার। তখন আমার ওই ছোট্ট মাথায়, তেনজিংয়ের রোমহর্ষক অ্যাডভেঞ্চার ঢুকত না। আমায় টানতেন রাধানাথ। শুধু বসে বসে ভাবতাম, আরে এ কী মানুষ! যেটা পৃথিবীর সবথেকে উঁচু শৃঙ্গ, সেটার উচ্চতা মেপে দিলেন তিনি! ঘোর কাটত না কিছুতেই।
ওই ছেলেবলায় এত তো বুঝতাম না। আমি ততদিনে মাপ বলতে বুঝতাম, একটা ফিতে। যেটা বাবার ড্রয়ারে রাখা থাকে। ছুটির দিন বাবা যখন কোনও কাজ করে, তখনই মাঝে-মাঝে বের করত ওই গোলাকার বস্তুটা। আসলে ওটা ছিল মাপার ফিতে। একটা প্লাস্টিকের গোল মতো। ওটার পাশে নব একটা থাকতো। সেটা ঘোরালেই ভিতরের ফিতেটা বেরিয়ে আসতো। মেপে দেখতাম পাঁচ ফুট! আমার কাছে সেটা তো তখন অনেক লম্বা! পাশের ফাঁকা জমিতে কাকুরা নতুন বাড়ি করবেন। বাবার ফিতেটা নিয়েই কী সব মাপ ঝোঁক করতেন। আর আমি তখন বড় কাজের দায়িত্ব পেতাম! ফিতের কোনও একটা দিক আমাকে ধরিয়ে দিয়ে কোথাও চেপে ধরে রাখতে বলতেন বাবা, কাকু, জেঠুরা। ওই ছেলেবেলা থেকেই 'মাপতে' শিখে গেলাম আমি! আর ফিতেটা ছিল আমার বড় প্রিয় খেলনা। ভাবতাম, রাধানাথ সিকদার এই ফিতে দিয়ে কী করে মাপলেন প্রায় ২৯ হাজার ফুটের একটা পাহাড়কে! মাথায় ঢুকতো না কিছুতেই।
আজ যে অনেক বুঝে গিয়েছি তেমন নয়। তবে, এটুকু বুঝতে পারি যে, এতবড় জিনিস মাপার জন্য ওই ৫ ফুটের ফিতের কোনও দরকার নেই। লাগে শুধু গিজগিজে অঙ্ক ভর্তি প্রোফেসর ক্যালকুলাস বা রাধানাথ সিকদারের মতো মাথা! কিন্তু ক্লাস থ্রির আমি যে ওই ফিতেটাকেই কত বড় অস্ত্র ভেবেছিলাম। ওটা হাতে থাকলে আমার অন্তত জীবনে মাপের গোলমাল হবে না। সবকিছুর সঠিক মাপ বলতে পারব, একবারে। কী আনন্দ হতো। আস্তে আস্তে সেই দিনগুলো চলে গেল। ফিতের দরকার আর জীবনে তেমন পড়ত না। পাশের ফাঁকা জমিগুলোও ছিল না আর যে, নতুন করে জমি মাপতে হবে কাউকে! তাই আমার মন থেকে ফিতে ক্রমেই ফ্যাকাসে হয়ে গেল।
বছর কয়েক হল, সেই ফিতে আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে আমার জীবনে। বাড়িতে সকালবেলায় উঠে খবরের কাগজটা মেলে ধরলেই গড়ে অন্তত ৫-৭ টা ছবি দেখতে পাওয়া শুরু করলাম। যেখানে কোনও মেয়ে বা ছেলের পেটের ছবি। আর তাতে পেঁচানো রয়েছে ফিতে! এরপর টেলিভিশন খুললেও সেই একই ছবি। মেয়েদর ওই উন্মু্ত কোমল পেটে লেপ্টে থাকা ফিতে! তারপর বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে পড়লেই চারিদিকে হোর্ডিং! এবং সেখানেও ৫০ শতাংশ হোর্ডিং শুধু স্লিম থাকার। সেই উন্মুক্ত পেট, পিঠের দিকে ঢুকে যাচ্ছে আর তাতে পরশ হলুদ রঙা ফিতের! ট্রেনে-বাসের পোস্টারেও একই কাহিনি। শুধু মেয়েদের পেটগুলোই বদলে যায়। মুখ তো দেখা যায় না। গলার নিচ থেকে কোনওমতে কোমর পর্যন্ত দেখা গেলই হল। ব্যাস, শুধু একটা গায়ে হলুদ ফিতে জড়িয়ে দিলেই হল। অনেকদিন দেখতে দেখতে বড় বিরক্ত লাগে মনটায়। হতাশা আসে।
ছেলেবেলায় আমার সবথেকে শক্তিশালী অস্ত্রটার এ কী পতন হয়েছে! আমার যে ফিতে দিয়ে নাকি একসময় এভারেস্ট মাপা যেত, সেটা দিয়ে এখন মেয়েদের ২৮ ইঞ্চি পেট মাপা হয়! বুঝতে পারি না, কীভাবে ব্যাখ্যা করব। মন বলে, বড্ড অহংকার হয়েছিল আমার ফিতের! এভারেষ্টে চড়তে উঠেছিল। পতন তো অনিবার্য ছিলই। যাক, তবু পেটে সয়েছে, আমার সাধের ফিতে! সবশেষে আর একটা কথা বলার। এইসব আগডুম-বাগডুম ভাবতে ভাবতে রাতে যখন চোখ জুড়ে আসে, তখন আরেকটা পেটের কথা মনে পড়ে। ওই ক্লাস থ্রিতেই বইতে দেখেছিলাম ছবিটা। দামোদর শেঠ। বাঙালির পেট আর দামোদরের থাকবে কীভাবে? পেটকে যে দাম দেওয়ারই কেউ নেই। তবু, আশায় আছি। হয়তো এই বাংলারই কত গ্রামের কত আধপেটা খাওয়া মেয়ে বহুদিন পর একটা বড় ঢেকুর ওঠার মতো খাবার খেতে পেলে, ঘরের এক কোণে গিয়ে লাজুক চোখে নিজের পেটটায় একটা সুতুলি দড়ি দিয়েই ফিতের মতো করে একটু মেপে দেখবে। অনেকদিন পর তাঁর পেটটা বেশ ভরেছে.....আমি নিশ্চিত, আমার কল্পনার সেই ফিতে অতীতের এভারেষ্টের মতো আগামীর পেট ভরার ভালোলাগার অনুভূতিও মাপতে পারবে...আর যদি সত্যিই কোনওদিন সেটা হয়, মনের আনন্দের গৃহপ্রবেশে ফিতে কাটব আমি! ততদিন এই ফিতের ফাঁসে জীবন করুক হাঁসফাঁস।
আরও পড়ুন বিশ্বজুড়ে পাড়ায় পাড়ায় জঙ্গিদাদের কোচিং সেন্টার চলছে!