বাঙালির দৈন্যতা রয়েই গেল কিন্তু যৌনতার জোয়ার এলো!
স্বরূপ দত্ত
আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে! সেই সহজ সরল চাওয়া বাঙালির আজও আছে কি? জানা নেই। কিন্তু সেই এক কথায় অনেক চাওয়ার কথা মনে পড়ে গেল আজও। অথবা ইদানিং মনে পড়ে, মাঝেমাঝেই। একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল (হিস্ট্রি টিভি এইট্টিন) রাতের দিকে একটা অনুষ্ঠান দেখায়। 'হাউ সেক্স চেঞ্জ দ্য ওয়ার্ল্ড'! প্রায় সবকটি এপিসোডই মন দিয়ে দেখলাম। বড্ড ভালো। সত্যিই তো, যৌনতায় জীবন পরিপূর্ণ কিনা তাও জানা নেই। কিন্তু গোটা জীবনে ক'ফোটা যৌনতা না থাকলে, সে যে রেডিয়াম ছাড়া পৃথিবী! অনেক আলো। কিন্তু এতটুকুও নয় যে, মাত্র আড়াই চামচের আলোর শক্তিকে ঢেকে দিতে পারে! তাই যৌনতা ওই আড়ালে থাকলেও তার ব্যপ্তি বড্ড শক্তিশালী। প্রমাণিত।
এবার আসি কেন, এমন ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা আবহাওয়ায়, যৌনতার ছোঁয়া দেওয়ার চেষ্টা? আসলে গত কয়েক বছর ধরে ঘুম থেকে উঠে খবরের কাগজে অনেক টুকরো খবরের মাঝে বড় বিজ্ঞাপন। এক অতৃপ্ত নারীর কাহিনি! কিংবা টেলিভিশন খুললেই চুবড়ি থেকে ফোঁস করে ওঠা সাপের ফণা! অথবা, ইন্টারেনেটে চোখ বোলালেই শরীরের রোম খাড়া করে দেওয়া ছবি, কথা। যৌনতার আকর্ষণীয় ইন্টেরিয়র ডিসপ্লে! এগুলো ভালো নাকি খারাপ, সে আলোচনা আজকের লেখার বিষয় নয়। সমাজে চলছে। আমি সমাজে রয়েছি। মানিয়ে চলতে হয়। চলছি। পা মিলিয়েছি দ্বিধা-বুকেই।
শুধু কয়েকটা প্রশ্ন মনে দানা বাঁধে। উত্তর জানতে ইচ্ছে করে। কে দেবে? আলোচনা করতে ইচ্ছে হল। আপনাদের মতামত জানতে ইচ্ছে করে। তাই কথাটা পেরে ফেলা। আচ্ছা বাঙালির তো কেমন যেন একটা পরিষ্কার-পরিষ্কার ইমেজের ছিল। বাঙালির নারী 'মৌন' থাকবে কিন্তু 'যৌন' আলোচনায় একদম 'চুল ভেজাবে না'! এখন মৌনতা আর সম্মতির লক্ষণ নেই, যৌনতাই হয়ে গিয়েছে সম্মতির লক্ষণ! কীভাবে বদলে গেল সবকিছু! প্রত্যেকটি মিডিয়ামের দৌলতে যে কথাগুলো বোঝানোর চেষ্টা হয়, তার এক কথার মানে তো এরকম যে- বাঙালির মেয়েরা এখন যৌনতায়ও কেমন যেন 'হুড়োহুড়ি করে কেনাকাটায় ব্যস্ত'!
অন্তত বিজ্ঞাপনগুলোর কথা শুনলে তেমনই মনে হয়। ১২ সংখ্যায় ডজন হয়। এক ডজন গল্প পড়েই বড় হতে হয়েছে নানা লেখকের। বড্ড তৃপ্তির ছিল সেই ১২। কীভাবে চোখের সামনে মেয়েদের বলতে দেখছি, 'বাব্বাঃ ১২ বার!' অথবা, 'সাতদিনে তিনবার খাট ভেঙে ফেলার গল্প'! কিংবা 'এই বয়সেও কাজে দেয়'। এই পর্যন্ত বলে একটা নিজের 'স্ট্যান্ড' পরিষ্কার করে দেওয়া। তা হলো, এগুলো ভালো না খারাপ তা নিয়ে আমার এই লেখায় কোনও মত নেই। এমনটা ঘটছে। দেখতে পাচ্ছি। শুনছি। বেশ খানিকটা পথ পেরিয়ে একটু জিরোতে বসব যখন, তখনই না হয় হিসেব করব-এগুলো সমাজকে কোন পথে নিয়ে গেল। তাই যা চলছে চলুক। আর চলবেই যখন তখন আর নিঃশব্দে কেন! কলরব থাকুক না, যৌনতাতেও।
বলতে চাইছি যেগুলো। চেনা শব্দগুলো জড়িয়ে গেল কীভাবে যৌনতার সঙ্গে, ভাবলে খানিকটা অবাক হই বইকি! জাপান মানে ছিল হিরোসিমা, নাগাসাকি। জাপান মানে ছিল মারুতি, সুজুকি। জাপান মানে ছিল সামুরাই। জাপান মানে ছিল হারাকিরি। সম্মান-বীরত্ব। আজ যে জাপানি সৈন্যও মুখ থেকে বেরোনোর আগে কানে বেজে ওঠে ফণা তোলা সাপের ওই চেনা বিন! রকেট বানানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালাতাম কাগজ দিয়ে। পুজো, উত্সবে সবথেকে বেশি টানতো ওই বাজিটাই। একটা বোতলের মধ্যে থেকে সাঁ করে ছিটকে বেরিয়ে চলে যেত দূর আকাশে। আমার উড়ে যাওয়া, গতি, বুকের আগুনকে অনুভব করতাম। রকেট ছিল অজানাকে জানার একটা মাধ্যম। সেটাও যে যৌনতার কক্ষপথে এভাবে আস্টেপৃষ্ঠে বোঁ বোঁ চক্কর লাগাতে থাকবে, কে ভেবেছিল! আমার বীরত্বের শব্দগুলো যৌনতার গভীর সমুদ্রে এভাবে সাবমেরিন হয়ে যাবে, ভাবিনি বেড়ে ওঠার দিনগুলোয়!
এখন এই তথ্যগুলো হাতের মুঠোয় আসতে কয়েক মুহূর্তই সময় নেয়। ভারতে পর্ন দেখে সবথেকে বেশি কলকাতার মানুষ। মানে দাঁড়ালো এক কথায়, আজকের বাঙালি শুধু মাছে-ভাতে সন্তুষ্ট নয়। তাঁর জীবনে, যৌন নদীতে ভাটার কোনও জায়গা নেই। তার যৌবনে রোজ ওঠে যৌনতার টইটম্বুর জোয়ার! এমন নয়, যৌনতার 'সম্মানচিত্রে' শুধু কলকাতা বা বাঙালিই আছে। বলিউড এখন দেখাচ্ছে গুড্ডুর সোনার গান! বাজি রেখে বলছে, সিক্কা হিলবেই হিলবে! ছেলেবেলায় সেই ঈশপের গল্প অনেক কল্পনা এঁকে দিত চোখে-বুকে। মনের শিড়দাঁড়া তৈরি করে দিত এই বলে-জীবনে গরিব কাঠুরিয়ার মতো বলতে হবে, সোনার কুড়ুল নয়, ওই কাঠের কুঠারই আমার। কিন্তু সোনার কুঠার এখন নবাব বাড়ির জামাইয়ের সোনার যৌনাঙ্গে পরিণত হয়েছে। ভালো-খারাপের প্রশ্ন নেই। অবাক লাগা আছে।
প্রত্যেক জিনিসকে খারাপ না বলে, তার থেকে প্রথম দৃষ্টিতে বরং একটু ভালো ছেঁকে নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের। সেই সূত্র ধরেই- যৌন সম্পর্ক কেন মৌন থাকবে চিরকাল! যৌনতা কেন গুহাচিত্রে পুরু হয়ে ফুটে উঠেও মৌনতা বজায় রাখবে! বুক ভাঙবে তবু মুখ খুলবে না, এদিনকে বিদায় জানানো হয়েছে। যৌনতার মিছিল লম্বা হচ্ছে, তাতে দু পা পথ চলেই দেখি না, কোন মোহনায় গিয়ে পড়ি। জার্নির তো সবে শুরু। সমাজ তো বেশ মজাই পাচ্ছে। শুধু এই যৌন মিছিলে পা মেলাতে গিয়ে নিজের দুটো কথা বলা। তা হলো, আমাদের বাঙালি ঘরের মেয়েরা আগের থেকে অনেক বদলে গিয়েছে গত কয়েক দশকে। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত মত বলে, কয়েকটা বেসিক জায়গায় ওরা আজও সেই আগের মতো। আজও ওরা আমাদের পথ চেয়ে বসে থাকে। কখন একটু বাড়ি যাবো। তারপর দুমুঠো খাবে। যদি কোনও অতিথি বাড়িতে আসে, তাঁকে পেট ভরে খাইয়ে, নিজের জন্য কিছু বাঁচলে তবে খায়। মন বলে, শুধু অভাবে নয়, আজও শুধু মানবিকতার খাতিরে ওরা এখনও থালা-বাটির টু-টাং দুটো শব্দ প্রিয়জনকে শুনিয়ে দুঢোক জল গিলে রাতের বিছানায় শুয়ে পড়ে!
আর আমার মূল বক্তব্যটা এখানেই। যদি আপনিও অনুভব করেন চোখ বুজে যে, আপনার পরিচিত মহিলাটিও আপনার জন্য এত ত্যাগ করে, তাহলে বুঝবেন। যৌনতা তো একা একার নয়। যখন সমাজের বিছানাই 'ম্যাচ টাই' তখনই ডাবলস উইকেটে নেমে পড়া! জীবনে যতই 'এক্স' গার্লফ্রেন্ড বা বয়ফ্রেন্ড থাকুক, আজকের সেক্স কি আর শুধু 'এক্সে' চলে! একটা সঙ্গী তো চাই। রাজ্যে শিল্প নেই। অর্থনীতি দুর্বল। গরিব রাজ্যের গরিব মানুষ আমাদের। পুরুষ আজও সেই আদিম। তাই তো ধর্ষণ বাড়ছেই। অথচ, নারী মানবিকতায় আজও সেই একইরকম। আমি খেলে সে খায়। আমার দেরিতে তার বুক ধড়পড় করে। আমার আনন্দে তাঁর অপুষ্টির শরীরেও চওড়া হয় বুক! ওই কমপ্লান আর হরলিকসের বিজ্ঞাপনগুলো টেলিভিশনে কমে গিয়েছে আজকাল। হয়তো দেখা যায়। কিন্তু পরিমাণে কম। (ভাববেন না, ওদের প্রচার করছি। ওই প্রোডাক্টগুলো ভালো না মন্দ তাও জানা নেই। কিন্তু ওদের বিজ্ঞাপনগুলো বাড়ির মেয়েদের একটাবার নিজের শরীরকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা অন্তত বলতো)। ওই বিজ্ঞাপনে যে প্রতীকী মেয়েটি বলত, 'আই অ্যাম এ কমপ্লান গার্ল', সেই মেয়েটি আজ কি তবে, এই যৌনতার মহামিছিলে পা মিলিয়েছে! সেই হরলিকস অন্তত সারাদিনের এক পলক ফুরসতে বাড়ির মহিলাকে একবার মনে করিয়ে দিত, এই সংসারের জন্য তোমার শরীরটাও জরুরি।
আজ ওই বিজ্ঞাপনগুলো বেশ খানিকটা পিছিয়ে গিয়েছে। হয়তো 'যৌন পন্য'র দাপটে তারা আজ 'স্বীকৃত বিরোধী শূন্য!' বিজ্ঞাপন বলে দেবে না, ও বউ তোমার শরীরটাও সুস্থ রাখার অধিকার আছে তোমার। পুরুষের রোজগারের বাইরে ভাবার সময় কোথায়! তাহলে কী এই রাজ্যের অনেক ঘরেই রাতের বিছানায় দুটো শরীরের একটায় খালি পেটে জল আর একটায় ভরা পেট 'তেলের আশ্চর্য প্রদীপের হলকা শিখা!' তেল-জল যে কোনওদিনই মেশে না। এমন যৌনতা পরিপূর্ণতাও বা পাবে কোত্থেকে! রাজ্যের পুরুষ যেন শুধু নিজের 'চরকায়' তেল না দিয়ে সঙ্গীনীর পেটেও দুটো ভাত দেয়। পুষ্টি ছাড়া 'দুধভাত কুস্তিও' কি হয় নাকি! পেটে খেলে 'সব কিছুতেই' সয়। গ্রামের গরিব ঘরের মেয়ে বউদের রোজ অন্তত এক পো দুধের বন্দোবস্ত করে তবেই যৌনতার ডে-নাইট ম্যাচে 'বিছানায়' নামুক পুরুষ। পঞ্চাশ ওভারের ম্যাচ খেলতে গিয়ে পুরুষ বড়জোর টি-২০ ঢঙেই আউট হয়ে যাবে। এতে হয়তো সামান্য ল্জ্জা থাকবে। সম্পর্ক ভাঙবে। কিন্তু নারীরা বাঁচবে। ওরা না বাঁচলে, পুরুষকে আর আগলে রাখবে কে! সভ্যতার আদিম থেকে আজও ওদের খালি পেটে জলই যে আমাদের চিরকাল দুধে ভাতে রাখতে রাখতে, শরীরে অনেক 'তেল' জমিয়ে দিয়েছে।