Asit Bandopadhyay Birth Anniversary: মঞ্চাভিনয়ে ব্রেখটীয় দ্বৈত আর তা থেকে উদ্ভাসিত কূট কৌতুক! কীভাবে পারতেন এই মানুষটি?
Asit Bandopadhyay Birth Anniversary: নীরবে চলে যাচ্ছে এক বিরল মানুষের জন্মদিন। ১৯৩৬ সালের আজকের দিন, এই ৪ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেছিলেন অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়। কে এই অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়? এক কথায় তাঁর পরিচয়, তিনি বাংলার নাট্যজগতের মানুষ। কিন্তু তাঁর বহুমাত্রিকতার পরিমাপ কঠিন।
সৌমিত্র সেন
নীরবে চলে যাচ্ছে এক বিরল মানুষের জন্মদিন। ১৯৩৬ সালের আজকের দিন, এই ৪ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেছিলেন অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়। কে এই অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়? এক কথায় তাঁর পরিচয়, তিনি বাংলার নাট্যজগতের মানুষ। তবে তাঁর কাজের ক্ষেত্র বহুধাবিস্তৃত, ব্যাপক; বহুচারী তিনি। তবে, সাধারণ মানুষ হয়তো তো সেভাবে মনে রাখেনি তাঁকে। নাট্যজগতের মানুষও কি সেভাবে রেখেছেন?
আসলে প্রদীপ যিনি জ্বালান মানুষ মূলত তাঁকেই মনে রাখে। সেটা শুধু এজন্য নয় যে, তিনি প্রকাশ্যমঞ্চে আসেন, তাঁকে দেখা যায়; বরং এজন্যও যে, তাঁর মুখে প্রদীপের আলোটা ঠিকরে পড়ে, তিনি হয়তো তুলনায় আর-একটু বেশি উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন। কিন্তু তার আগের সময়পর্ব জুড়ে এই প্রদীপের ব্যবস্থা যিনি করেছেন, তেল বা ঘিয়ের জোগাড় যিনি করেছেন, সলতে পাকিয়ে দিয়েছেন, তিনি রয়ে গেলেন মঞ্চের আড়ালেই। সেভাবে প্রকাশ্যে এলেন না বলে, হয়তো মানুষ তাঁকে সেভাবে আলাদা করে মনেও রাখল না। যিনি প্রদীপ জ্বালানোর আগে সলতে পাকানোর কাজ করেছেন, এ তাঁর কোনও খামতি নয়; খামতি বরং মানুষের, তাদের স্মৃতির ক্ষমতার (বা অক্ষমতার), যারা তাঁকে সম্মানের সঙ্গে মনে রাখতে ব্যর্থ হল। বঙ্গ নাট্যসংস্কৃতি, নাট্যামোদী মানুষ, সমস্ত সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষ অসিতবাবুর কাছে সেই অপরাধে অপরাধী। সেকথা ফিরে একবার মনে করবার দিনও আজ।
আরও পড়ুন: কলকাতার নাট্যক্ষেত্রে অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় যেন কর্ণ
না, শুধুমাত্র একটি নাট্যগোষ্ঠী স্থাপন করা বা তার শুরু থেকেই তার সঙ্গে যুক্ত থাকার ইতিহাসদত্ত পুঁজিটুকুই অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের একমাত্র সম্বল নয়, হতে পারে না। তাঁর পোশাকি পরিচয়টাই বিস্তৃত। তিনি একাধারে নট, নাট্যকার, চিত্রনাট্যকার, নির্দেশক এবং অভিনেতা। তবে 'নান্দীকার' তাঁর ব্যক্তি-ইতিহাসের তাঁর নাট্য-যাপনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ফলে, সেই চেনা-অচেনা ইতিহাসটুকুতে একবার নজর দেওয়া যাক। কলকাতার নাট্যকর্মী হিসেবে নান্দীকারের সর্বক্ষণের নাট্যকর্মী ছিলেন অসিতবাবু। ইতিহাস বলছে, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আরও কয়েকজনকে নিয়ে অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ই 'নান্দীকার' প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দলের প্রথম নির্বাহী সদস্যের কমিটি নির্বাচিত হয়েছিল। তার সভাপতি ছিলেন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সেক্রেটারি অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়। সেটা ১৯৫৯ সাল। ১৯৬০-১৯৭২ পর্যন্ত নান্দীকার এর প্রথমদিকে র সবকটি প্রযোজনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন-- 'নাট্যকারের সন্ধানে ছটি চরিত্র', 'শের আফগান' , 'মঞ্জরী আমের মঞ্জরী' , 'যখন একা', 'বিতংস' এবং 'তিন পয়সার পালা'। 'নান্দীকারে'র জন্য দুটি নাটক পরিচালনাও করেছিলেন।
আরও পড়ুন: Padma Bhushan Vani Jairam: পদ্ম ভূষণে সম্মানিত আধুনিক ভারতের 'মীরা'! চেনেন অসাধারণ এই সংগীতশিল্পীকে?
১৯৭৩ থেকে একটু পথবদল। অসিতবাবুর সঙ্গে কোচবিহারের একটা যোগসূত্র ছিলই। সত্তর দশকের গোড়ার দিকে তিনি কর্মসূত্রে সেখানে গেলেন এবং সেখানকার নাট্যচর্চার সঙ্গে যুক্তও হলেন। পরে কোচবিহার থেকে বদলি হয়ে চলে যান শিলিগুড়িতে। সেখানে 'মিত্র সম্মিলনী'র নাট্যচর্চার সঙ্গে যুক্ত হন। তাঁর হাত ধরেই মিত্র সম্মিলনী নাটকের স্বর্ণযুগে প্রবেশ করেছিল। উত্তরবঙ্গের নাট্যদৃশ্যে বিপ্লব ঘটিয়েছিল মিত্র সম্মিলনী। ১৯৭৮ নাগাদ অসিতবাবু কলকাতায় ফেরেন। ফিরে আবারও পথবদল। এবার তিনি যাত্রার দিকে ঝুঁকলেন। প্রায় ৭০টি লোকনাটক রচনা করেন, পরিচালনা করেন, মঞ্চায়িত করেন। এসবের পাশাপাশি সিনেমাতেও তাঁকে পেয়েছে বাঙালি। মৃণাল সেনের 'কলকাতা ৭১', 'মৃগয়া', 'মহাপৃথিবী'তে অভিনয় করেছিলেন। নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়র 'পরশুরামের কুঠার', 'আত্মজা' ও 'শিল্পী'তে এবং চিদানন্দ দাশগুপ্তের 'আমোদিনী'তে অভিনয় করে বিশেষ প্রশংসা পেয়েছিলেন।
কিন্তু তাঁর সিদ্ধি ছিল হয়তো নাটকই। নাট্যক্ষেত্রে তিনি অনন্য। কতটা অনন্য? নাট্য-তাত্ত্বিক নাট্যবিশেষজ্ঞ শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় 'নান্দীকারে'র 'তিন পয়সার পালা'-য় ভিখিরি ব্যবসার কুলপতি মহা চতুর ধান্দাবাজের ভূমিকায় অসিতবাবুর অবিস্মরণীয় অভিনয় নিয়ে পরবর্তীকালে স্মৃতিচারণ করেছেন। তিনি নজর করেছেন 'ব্রেখটীয় অভিনয়ের সেই ধারালো দ্বৈত যাতে অভিনয়ে বাস্তবচিহ্নিত একটা চারিত্র্য আর তার সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থান এক দ্বান্দ্বিক সহাবস্থানে ইতিহাসের তথা সমাজ বিবর্তনের একটা সত্যকেই উন্মোচিত করে, তুলে ধরে কীভাবে শোষণ নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে উঠে মানুষের ব্যবহারধর্মে ওতপ্রোত হয়ে যায়; আর সেই দ্বৈত থেকে উদ্ভাসিত হয় এক কূট কৌতুক।'
অথচ একটি পত্রিকায় 'নান্দীকারের গোড়ার কথা' শীর্ষক একটি লেখা অসিতবাবু শুরুই করছেন এইভাবে-- 'আমি নাট্যব্যক্তিত্ব নই, ইতিহাসবিদও নই-- তবু এই পত্রিকার কর্মকর্তারা নান্দীকার নাট্যসংস্থার জন্ম, উত্থান ও বিস্তার সম্পর্কে আমাকে লিখতে অনুরোধ করলেন কেন তা জানি না।' এ লেখার পাঠকদের ওই 'আমি নাট্যব্যক্তিত্ব নই' বাক্যাংশের প্রতি নজর দিতে অনুরোধ করব। অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং বলছেন, তিনি একজন 'নাট্যব্যক্তিত্ব' নন! তা হলে 'নাট্যব্যক্তিত্ব' বলতে কাকে বা কাদের বোঝায়? না, ব্যাখ্যা করার জন্য আর তিনি নেই আমাদের পরিসরে। কোভিড তাঁকে কেড়ে নিয়েছে বছরদুয়েক আগে। কিন্তু একটা বিষয় বোঝাই যায়, কেন মানুষ তাঁকে বা তাঁদের মতো মানুষদের মনে রাখতে ব্যর্থ হয়। কারণ, তাঁরাই নিজেরাই নিজেকে তুলে ধরার, মনে করানোর কাজটিকে অবহেলা করেন; কাজটাকে আরও অনেকের মতো 'জরুরি' মনে করেন না। বরং নিজের আদিগন্ত শিল্পচর্চার মধ্যে এতটাই নিমগ্ন তাপস হয়ে থাকেন, নিজের কারুবাসনায় এতটাই আশ্লিষ্ট থাকেন যে, এই শৌখিন মজদুরির কারুকাজে আর তত মন দিতে পারেন না!