সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে নানান জানা-অজানা কথা Arth-এ
আর্থ-এর মঞ্চে সৌমিত্র স্মরণ।
নিজস্ব প্রতিবেদন: আর্থ-এর মঞ্চে সৌমিত্র স্মরণ। আলোচনায় অংশ নেন পরিচালক অশোক বিশ্বনাথন, অতনু ঘোষ, সুমন ঘোষ, অভিনেত্রী সুদীপ্তা চক্রবর্তী, বাচিকশিল্পী সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। তাঁদের কথায় উঠে এল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কথা, তাঁর শিল্পী সত্ত্বা, রাজনৈতিক মতাদর্শ সহ নানান বিষয়। সত্রাজিৎ সেনের কথায়, আমরা যে ব্যক্তিকে নিয়ে আলোচনা করছি তিনি আর আমাদের মধ্যে নেই। অথচ তারপরেও উনি আমাদের মধ্যে রয়েছেন।
অশোক বিশ্বনাথন (পরিচালক)- সৌমিত্রদার ছেলে সৌগত আমার স্কুলের বন্ধু। সেই সূত্রে ওঁদের বাড়িতে আমার যাতায়াত ছিল। বিশেষ করে সৌগতর জন্মদিনে। আর উনি প্রতিবছর ওই দিনটিতে একটি কবিতা পাঠ করতেন, সেটা আমার খুব মনে পড়ে। অল্প বয়স থেকেই সৌমিত্রদার সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ। অল ইন্ডিয়া রেডিও, শিশির ভাদুড়ি, পরবর্তীকালে 'অপরাজিত'র জন্য সত্যজিৎ রায়ের কাছে যাওয়া। প্রথমে প্রত্যাখ্যাত হলেও তারপর সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে একের পর এক ছবি। এটাই হয়ত সবাই জানেন। আবার উনি নাটকের সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলেন। নাটকের ক্ষেত্রে উনি ছিলেন সম্পূর্ণ একজন পরিচালক। নাটক লিখতেন, অনেকসময় বিদেশি নাটক অবলম্বনেও অনেক নাটক লিখেছেন। বিশেষ করে 'টিকটিকি' নাটকটি যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানেন। এই নাটকটি ভারতীয় পটভূমিতে উনি তৈরি করেছেন। উনি নাট্যকার, পরিচালক, কবি, অঙ্কনশিল্পী, সংস্কৃতির নানান দিকে ওঁর বিচরণ। উনি একটা মাধ্যম থেকে অন্য মাধ্যমে সহজেই যেতে পেরেছিলেন। তবে আমার দুটো প্রশ্ন, উনি কেন হিন্দি ছবি করলেন না? আর কেন কোনওদিন বাংলা ছবি পরিচালনা করেন নি?
অশোক বিশ্বনাথনের কথার প্রসঙ্গ ধরে অতনু ঘোষ বলেন...
অতনু ঘোষ (পরিচালক)- কেন উনি সিনেমা পরিচালনা করলেন না, এই প্রশ্নটা আমি ওঁকে বহুবার করেছি। সিনেমা উনি অসম্ভব ভালোবাসতেন। একেবারে শেষদিকে ৩০ সেপ্টেম্বর আমার সঙ্গে ওঁর (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) শেষ দেখা। একটা তথ্যচিত্রের জন্য সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। প্রশ্ন করেছিলাম, আপনার সিনেমার প্রতি ভালোবাসার মূল আকর্ষণ কী? উনি ভারী সুন্দর করে বলেছিলেন, ''সিনেমার স্টাইল। এই যে আমাকে সে বাঁদিক থেকে দেখবে, নাকি সামনে থেকে কি পিছন থেকে দেখবে। আমার গলাটা সে ব্যবহার করবে! নাকি আমাকে বহু দূর থেকে দেখা যাবে, অথচ গলাটাও হয়ত শোনা যাবে না। এই যে প্রতিনিয়ত পাল্টে যাওয়া একটা দৃষ্টিভঙ্গি, সেটা আমার কাছে আকর্ষণের একটা জায়গা।'' ওঁর কথায়, 'সিনেমার পরিচালনা একটা ফুল টাইম কাজ।' অভিনয় সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উনি যুক্ত থেকেছেন। ১৪ বছর সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন। এছাড়াও নাটক, কবিতা লেখা সহ বিভিন্ন কিছু করেছেন। কোথাও গিয়ে ওঁর মনে হত, পরিচালনার জন্য যে সময়টা দরকার, সেটা উনি দিতে পারবেন না। তবে সিনেমার ক্ষেত্রে ওঁর যে ভালোবাসা সেটা চিরস্মরণীয়। আমার 'ময়ূরাক্ষী' ছবির একটা দৃশ্য ছিল ওঁর ঘুম ভাঙবে। সেটা সকালবেলা, ছেলের স্পর্শে ঘুম ভাঙছে। কিছু কিছু বিষয় উনি একেবারে শটের আগের মুহূর্তে জিজ্ঞাসা করতেন। প্রশ্ন করলেন ''এ কী প্রায়ই ঘুমিয়ে পড়ে?'' এর আগে অনেক আলোচনা হয়েছে আমায় জিজ্ঞাসা করেননি। ওঁর কথায় ''নাটকে বহুবার মহড়া হয়, তবে সিনেমার ক্ষেত্রে সবটাই তাৎক্ষণিক।'' তাই শেষ মুহূর্তে প্রশ্ন করতেন, সেটাই ওঁর অভিনয়ে বেরিয়ে আসত।
ওঁর বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে অগাধ ভালোবাসা ছিল। কোথাও একটা ওঁর মনে হত, বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য কোথাও গিয়ে হয়ত ভালো লাগবে না। প্রাণের সাড়াটা ঠিক পাবেন না।
সুমন ঘোষ (পরিচালক) - 'আনন্দ' ছবিতে অমিতাভ বচ্চনের চরিত্রের জন্য হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় সৌমিত্রবাবুকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। উনি সত্যজিৎ রায়ের কোনও ছবি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন বলে করেননি। পরবর্তীকালে শশীকাপুর kalyug-এ কাজ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তবে উনি 'না' করেছিলেন। তবে এক্ষত্রে অতনু দা (পরিচালক) যেটা বললেন, সেটাই উনি বলেছিলেন। ''অভিনয় ভাষা নির্ভর। হিন্দিতে অত স্বচ্ছন্দ নই।'' বোম্বেতে গিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার বাড়তি লোভও ওঁর ছিল না। উনি অভিনয় ছাড়াও নাটক, ম্যাগাজিনের সম্পাদনা সহ বিভিন্ন কিছুতে যুক্ত ছিলেন। তবে সবটাই কলকাতা কেন্দ্রিক, সেটা ছেড়ে বোম্বেতে গিয়ে কাজ করার কথা ভাবেননি। অতনুদার বক্তব্য প্রসঙ্গে বলি, 'পিস হাভেন' ছবির শেষে উনি ভেঙে পড়বেন এমন একটা দৃশ্য ছিল। আমরা তাজপুরে ভোরে শ্যুট করব। সৌমিত্র কাকু রাতে ডাকলেন। ঘরে গিয়ে দেখলাম একা বসে আছেন। উনি বললেন ''আমার একটা প্রশ্ন আছে।'' বললেন, ''এই যে বলছ ভদ্রলোক শেষে কেঁদে ফেলছেন, সেটা কেন?'' উনি (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) মারা যাওয়ার পর এই কথাগুলো খুব মনে পড়ছিল। চরিত্রটা সৌমিত্রকাকুর মতোই। ওঁকে বলেছিলাম, মৃত্যুর আগের মুহূর্ত একজনের কী অনুভূতি হয়। সেটা ভাবো। তারপর, দৃশ্যে উনি প্রথমে ভেঙে পড়েন, তারপর হাউ হাউ করে কাঁদতে শুরু করেন। এটা ওনি চলে যাওয়ার পর বারবার মনে পড়ছিল।
সুদীপ্তা চক্রবর্তী (অভিনেত্রী)- অনেক ছোট থেকে ওঁকে দেখছি। ছোটতে প্রথমে ফেলুদা। পরে উদায়ন পণ্ডিত (হীরক রাজার দেশে)। আমার কাছে তখন উনি লার্জার দ্যান লাইফ ইমেজ। আমাদের বাড়িতে 'এখন' পত্রিকা আসত, বাবা পড়তেন। পত্রিকায় 'গুপী গাইন বাঘা বাইন' , 'হীরক রাজার দেশে'র চিত্রনাট্য ছিল। ওই যে ছড়া কেটে কেটে সেই সংলাপ গুলো পড়ে খুব খুশি হয়েছিলাম। আমার বাবা, বিপ্লব কেতন চক্রবর্তী 'প্রজাপতি' ছবির শ্যুটিং করছিলেন। সেখানে আমায় যাওয়ার কথা বললেন। খুব উৎসাহী হয়ে গিয়েছিলাম। শটের আগে সৌমিত্র জ্যেঠু পোশাক বদলাচ্ছিলেন, পিঠে লাল তিল দেখি। বাবার পিঠেও লাল তিল ছিল। আমি কোথাও কানেক্ট করতে পেরেছিলাম। তারপর থেকে বাবা ও সৌমিত্র জ্যেঠু এক হয়ে গেলেন। আমার বাবা চলে যাওয়ার সময় বলেছিলেন 'আমি এখনও আছি'। উনি চলে যাওয়ার পর সেটাই মনে পড়ছিল বারবার। এছাড়াও অনেক মুগ্ধতা আছে।
প্রসঙ্গক্রমে সত্রাজিৎ সেন বলেন, থিয়েটার ছিল ওঁর প্রথম ভালোবাসা। থিয়েটার বাদ দিয়ে উনি কোথাও কোনওকিছুর জন্য ডেট দিতেন না...
সুজয় প্রসাদ চট্টোপাধ্যায় (বাচিক শিল্পী) - ব্যক্তিগত কিছু শুনলে চুপ করে যাই। (সুদীপ্তার কথা প্রসঙ্গে) সুদীপ্তার কথা শুনতে শুনতে আমারও বাবার চেহারা মনে পড়ছিল। থিয়েটারের কথা বলব। সিনেমায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অনুরাগী ছিলাম না। তবে থিয়েটারের ক্ষেত্রে আমি অরুণ মুখোপাধ্যায়, বিপ্লব কেতন চক্রবর্তী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে revivalist মনে করি। পাবলিক থিয়েটারকে উনি পুনরুজ্জীবিত করেছেন। ১৯৭৮-এ 'নাম জীবন' করলেন। 'রাজকুমার', 'নীলকণ্ঠ', 'ন্যায় মূর্তি', 'ঘটক বিদায়' দেখেছি। পাবলিক থিয়েটারকে উনি রুচিহীনতা থেকে রুচিশীল জায়গায় নিয়ে গেলেন। থিয়েটারে ক্যাবারের নামে যেটা চলত সেটায় বদল আনলেন। তার অনেক পড়ে প্রাণোতপস্যা করলেন। থিয়েটারে ওঁর জার্নিটা আমার কাছে গবেষণার মত। উনি বাচিক শিল্পের ক্ষেত্রেও একটা নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিলেন। পাঠের প্রসঙ্গে আমায় বলেছিলেন ''বাইরের ঘরে বসে ভিতর ঘরের গল্প বলি, কবিতা বা পাঠের মাধ্যমে।'' তখন জীবনানন্দের 'সিন্ধু সারস' আবৃত্তি করে শোনালেন। বললেন, শিল্পী প্রথমেই সংবেদনশীল হতে পারেন না। সংবেদনশীলতায় পৌঁছতে সময় লাগে। সেটায় পৌঁছনোই বাচিক শিল্পী ও একজন অভিনেতার অভিযাত্রা।
উনি আমায় গান শুনে বলেছিলেন, ''এই যে তুমি গানের মধ্য়ে দিয়ে কমিউনিকেট করছ, সেটা কিন্তু করে যেও। গান কতটা করলে তা নয়, কথাগুলোতে পৌঁছতে পারাটাই বড়।'' এত আধুনিক কোনও অভিনেতা আর ভারতবর্ষ পাবে কিনা আমার জানা নেই। আর বেলাশেষে করতে গিয়ে আমার প্রাপ্তি, জীবনানন্দ দাসকে ওঁর সূত্র ধরে নতুন করে চেনা। অপর্ণা সেনের সঙ্গেও জীবনানন্দ দাসকে নিয়ে কাজ করেছি। তবে ওঁর কাছ থেকে নতুন করে দেখেছি।
প্রসঙ্গক্রমে বলেন, অশোক বিশ্বনাথন বলেন, যত দিন গেছে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিজেকে ভেঙেছেন, পরিবর্তন করেছেন।
সুজয় প্রসাদ চট্টোপাধ্যায় (বাচিক শিল্পী) -মাণিকবাবুর ছবির বাইরেও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের একটা আলাদা সত্ত্বা আছে। অতনু ঘোষের ছবির মধ্যে দিয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে আবিষ্কার করেছি। 'ময়ূরাক্ষী'তে উনি যে অভিনয় করেছেন, সেটা আবিষ্কার। সুদীপ্তাকে আবিষ্কার করেছি পিউপা-তে। মা বলেন, 'সংসার সীমান্ত' দেখার সৌভাগ্য হয়নি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সত্যজিৎ রায়ের ইকুইভ্যালেন্ট নয়।
সত্রাজিৎ সেন (পরিচালক)- ময়ূরবাহন চরিত্রর জন্য ওঁর ডেট নিয়েছি, ফাইনান্সের অভাবে ছবিটা হচ্ছিল না। প্রযোজকদের সঙ্গে উনি নিজেই কথা বলেছিলেন। ৪ ঘণ্টার বেশি শ্যুট করেননা, তাই বলেছিলাম যখন তুমি আসবে সিনগুলো করে নেব। জিন্স টি-শার্ট পরে ওঁর এনার্জি, অকল্পনীয়। ওঁকে যখন বাড়ি থেকে নিয়ে যেতাম, যাতায়তের সময় গাড়ির প্রতি ভালোবাসার কথা বলতেন। কোনও একটা শট হয়ত আমার ঠিক পছন্দ হয়নি, আরেকটা শট নেব। বলতে পারতাম না। আমার সহযোগী গিয়ে বলতেন, কালো কাপড়টা উড়ে গিয়ছিল, তাই আরেকবার দিতে হবে। উনি বলতেন, ''তাই, এবারও যে উড়বে না তার কি গ্যারান্টি?'' ভীষণ খাদ্যরসিক, ছিলেন।
সুমন ঘোষ (পরিচালক) - দ্বন্দ্ব বলে একটা ছবি করেছিলাম। যেখানে উনি নিউরো সার্জনের ভূমিকায় ছিলেন। সেটা আমার মনে হয় ওঁকে নিয়ে করা সেরা ছবি। ওঁর রাজনৈতিক মতাদর্শও ছিল। অনীক দত্তের ছবি আটকানোর সময় উনি প্রতিবাদ করেছিলেন। অতছ ইন্ডাস্ট্রির বেশিরভাগ লোকই চুপ। আমার অমর্ত্য সেনকে নিয়ে করা ডকুমেন্টরির সময়ও যখন সমস্যায় পড়েছিলাম, উনি মুখ খুলেছিলেন। যেসময়ও ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই চুপ ছিলেন।
সব শেষে সুদীপ্তা বলেন, উনি (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) একজন প্রকৃত শিল্পী। যিনি কখনো নিজের শিল্পী সত্ত্বাকে থামতে দেননি। প্রতিটা মুহূর্তে শিল্পের প্রয়োজনে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন।