কোপে পড়লে বুঝতে হবে, ঢিলটা ঠিক জায়গায় পড়েছে : অনীক দত্ত
রাজনীতির বাইরে কি কিছু রয়েছে?
রণিতা গোস্বামী
২৮ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পেতে চলেছে 'বরুণবাবুর বন্ধু'। তার আগে ছবির গল্প, বর্তমান রাজনীতি-সহ নানা খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে zee 24 ঘণ্টা ডট কমের সঙ্গে খোলামেলা কথা বললেন পরিচালক অনীক দত্ত।
'বরুণবাবুর বন্ধুর' মুক্তির দিনই সমাজের কিছু স্বার্থপর, ক্ষমতালোভী, আলগা পিরিত করা মানুষের মুখোশ খুলে যেতে চলেছে। আজকাল ৯০ শতাংশ মানুষই তো এই তালিকায় পড়েন। ছবিটা দেখার পর আপনি এই মানুষগুলির কোপে পড়বেন না তো?
অনীক দত্ত : এমনিতেই আমি বিভিন্ন কোপে পড়েই রয়েছি। সে ভয় পেলে তো কাজ করা বন্ধ করতে হয় (হালকা হেসে)। এক্কেবারে ক্ষমতালোভী মানুষদের কথাই যে আমি 'বরুণবাবুর বন্ধু'তে তুলে ধরতে চেয়েছি, তা ঠিক নয়। তবে ক্ষমতালোভীরা শুধু আজকাল নয়, সেই আদিম যুগ থেকেই ছিল। বড়জোর আজকাল একটু বেড়েছে বলতে পারো। মানুষ যে ধান্দাবাজ হয়ে উঠছে, সেটা হয়ত অনেকে নিজেও বুঝতে পারেন। পরিবার, বন্ধুত্ব সব সম্পর্কের মধ্যেই কোথাও যেন এই ধান্দাবাজিটা ঢুকে গিয়েছে। যেখানেই রাজনৈতিক ক্ষমতা, সেখানেই লোকজন ভিড় জমাচ্ছে। তবে রাজনীতিটা আজকাল এইরকম হয়ে উঠেছে বলেই আমরা এমন করছি, নাকি আমরা এইরকম বলে রাজনীতির এই অবস্থা সেটা বলা মুশকিল।
একটা কথা আমি বলব, 'বরুণবাবুর বন্ধু' সেই অর্থে কোনও রাজনৈতিক ছবি নয়। ছবিটা বরুণবাবু ও তাঁর পরিবারকে নিয়ে। এই রাজনীতিটা মূলত পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বরুণবাবু আজ সকলের কাছে ব্রাত্য হয়ে গিয়েছেন। নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। কারণ, তাঁর একটা মূল্যবোধ রয়েছে। আবার কিছুটা গোঁয়ার্তুমি, কিছুটা অভিমানও বলতে পারো। তবে এমন কী ঘটলো যাতে সেই বরুণ বাবুকে সবাই গুরুত্ব দেওয়া শুরু করলেন? এরমধ্যে গল্পের বিশাল কিছু যে উত্থান পতন রয়েছে, তা নয়। এটা রাজনৈতিক ছবি না বলে, সমাজকে পর্যবেক্ষণ বলা যেতে পারে।
অনীক দত্ত : যাঁরা বিখ্যাত ধান্দাবাজ, তাঁরাও খুব ভাল করে জানেন যে তাঁরা কী? আমাকে সেটা বলে দিতে হবে না। তবে তা সত্ত্বেও তাঁরা করেন। আজকাল মানুষের মধ্যে একটা ধারণা রয়েছে, যে সবাই তো ধান্দাবাজ, আমি করলে ক্ষতি কী? সব রাজনৈতিক দলের সবাই দূর্নীতিগ্রস্ত, সেটাও ঠিক নয়। অবশ্যই একটা তুলনামূলক ব্যাপার রয়েছে। সম্পূর্ণ সৎ বলে হয়ত কিছুই হয়না। বলা যায়, এর মধ্যে ধান্দাবাজিটা তুলনামূলক কম, ওর মধ্যে বেশি। তবে এই বিষয়গুলি আমরা কোথাও গিয়ে মেনে নিয়েছি। আমার মনে হয়না এটা নিয়ে কেউ বেশি চিন্তা করেন বলে। তাই কারোর কোপে পড়ার ভয় নেই। আর যদি পড়ি, তাহলে বুঝতে হবে ঢিলটা ঠিক জায়গায় লেগেছে। তাতে আমার অসুবিধা নেই। আমি বিভিন্ন কোপ সামলে এসেছি (হাসি)।
এই যে সবাই 'অসৎ' নয়, এটাকে তুলে ধরার জন্যই কি বরুণবাবুর চরিত্রটা তুলে ধরলেন?
অনীক দত্ত : না, ওকে দিয়ে বাকিদের চারিত্রিক দিকগুলো তুলে ধরাটাই উদ্দেশ্য। বরুণবাবুর মত মানুষরা হারিয়ে যাচ্ছেন। যাঁদের মতো চরিত্রগুলি আমি ছোটবেলায় দেখে বড় হয়েছি। সে সময় এনারা ছিলেন। কলকাতার একটা অন্য চরিত্র ছিল। যেটা আসতে আসতে সম্পূর্ণ বদলে যাচ্ছে। শহরটা পাল্টে গেছে। এখন একটা অদ্ভুত শহরে বাস করি। যে শহরটায় বড় হয়েছি, সেই শহরের একটা মেরুদণ্ড ছিল, বক্তব্য ছিল, বিশ্বাস ছিল। কিছু পাওয়ার জন্য ধান্দাবাজি চললে সেটা অনেকে প্রত্যাখ্যান করতেও জানতেন। অনেক কবি সাহিত্যিক, চিন্তাশীল মানুষকে দেখেছি, যাঁরা এই ক্ষমতার আসরকে তোয়াক্কা করতেন না। সেই মানুষগুলি কমে গেছে। তবে বরুণবাবুর মতো মানুষ আর নেই, তাও না। তাঁদের এখনকার সময় কী হাল হয়েছে, সেটাই ছবিতে তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে।
বরুণবাবুর চরিত্রটি কি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কথা ভেবেই লেখা?
অনীক দত্ত : হ্যাঁ, আমি যখন গল্পটা পড়ি, তখনই মনে হয়েছিল ওনার কথা। যে সময় গল্পটা পড়েছিলাম, সেসময় হয়তবা গল্পের মূল প্লটটা বিশ্বাসযোগ্য হত না। বর্তমান যুগে সেটা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠবে বলেই মনে হয়। আমি শুধু মূল গল্পের (রমাপদ চৌধুরীর 'ছাদ') ছাঁচটা নিয়েছি। বাকিটা এখনকার সময়ে ফেলে নিজের মতো করে চিত্রনাট্য লেখা। তবে যখন চিত্রনাট্য লিখেছি, তখনই মনে প্রশ্ন আসে, মুখ্য চরিত্রে অভিনয়ের জন্য আদৌ কেউ আছেন কিনা? তা না হলে পুরো চিত্রনাট্য লিখে ফেললাম, তারপর কাউকে ঠিক পেলাম না, সেটা যেন না হয়। এখন কী হয়, কোনও চরিত্রের জন্য প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ব্যক্তিকে কাস্টিংয়ের জন্য ভেবে রাখা হয়। তবে এক্ষেত্রে ২য়,৩য় অপশন ছিল না। তাই আমি সৌমিত্রদাকে গিয়ে বলি, উনি হ্যাঁ বলার পরই আমি আর উৎসব (মুখোপাধ্যায়) চিত্রনাট্য নিয়ে এগিয়েছি। উৎসবই অবশ্য বেশি লিখেছে, আমি শুধু কিছুটা ঠিকঠাক করে দিয়েছি।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অনেকদিন পর কোনও ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে, এটা অনেকদিন পর আপনার হাত দিয়ে ঘটলো।
অনীক দত্ত : আসলে ওনার অনেক বাধা নিষেধ আছে। উনি দিনে ৪ ঘণ্টার বেশি শ্যুটিং করতে পারেন না। সেই জন্য হয়ত অনেকটা সময় লেগে যায়। দিনগুলো বেড়ে যায়। মুখ্য চরিত্রে থাকলে, তা আরও বেশি। তা সত্ত্বেও আমি আমার প্রযোজককে সেটা বলি। কারণ ওনাকে ছাড়া ছবিটা হতই না। অনেক ভাল অভিনেতা রয়েছেন। তবে এটার জন্য উনিই পারফেক্ট।
উনি ছাড়া আর কারও কথা যদি ভাবতে হত...
অনীক দত্ত : এটা আমি ওনাকেই (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) জিজ্ঞাসা করেছিলাম। উনি সেটার উত্তর দিতে পারেননি। বলেছিলেন, এই মুহূর্তে কারোর কথা তো ভাবতে পারছি না। আসলে অনেক ব্যাপার আছে। শুধু ওনার বয়সের জন্য তো নয়। এই বরুণবাবুর চরিত্রটির মধ্যে একটা চিন্তাশীল ব্যাপার রয়েছে। একটা সাহিত্যচর্চা রয়েছে, যার সবটাই সৌমিত্রবাবুর নিজের রয়েছে। রাজনৈতিক বিষয়ে বরুণবাবুর নিজস্ব মতামত রয়েছে, সেটাও সৌমিত্রবাবুর ছিল। একসময় বাম রাজনীতির সঙ্গে ওনার যোগ ছিল। এখন অবশ্য জানি না ওনার নির্দিষ্ট কোনও বিশ্বাস রয়েছে কিনা!
পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মাধবী মুখোপাধ্যায়, অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়, বিদীপ্তা চক্রবর্তী, ঋত্বিক চক্রবর্তী, কৌশিক সেন, দেবলীনা দত্ত, চান্দ্রেয়ী ঘোষ, একসঙ্গে এত জনের সঙ্গে কাজ করার সুবিধা ও অসুবিধাও রয়েছে? শ্যুটিং ফ্লোরের কোনও অভিজ্ঞতার কথা কি বলবেন?
অনীক দত্ত : না, এর আগেও আমি একসঙ্গে অনেককে নিয়ে ছবি করেছি। খুব একটা অসুবিধা হয় না। তবে ৮০ জন লোকের একটা ইউনিট ঘুরে বেড়ালে চিৎকার-চেঁচামিচি তো হয়ই। তাতে হয়ত আমার মেজাজ অনেকসময় বিগড়ে যায়। আমি একটু একাগ্রভাবেই কাজ করার চেষ্টা করি।
আপনি শুনেছি শ্যুটিং ফ্লোরে খুব রাগী মানুষ, সেটা কি সত্যি?
অনীক দত্ত : না আমি একটু Seriously কাজ করি, তার মানে যে হাসি-ঠাট্টা করি না, তা নয়। তাহলে তো সৌমিত্রদা সেটা মেনে নিতেন না। রাগ যেখানে দরকার সেখানে রাগী। সেটা বয়োঃজ্যেষ্ঠরা আমায় বলেন, তুমি যেটা বলো সেটা সত্যিই দরকার। কারণ, অনেকের মধ্যে গয়ংগচ্ছ একটা ব্যাপার থাকে। সবাই যে শৃঙ্খলাপরায়ণ তা নয়।। আমাকে তো কাজটা ঠিকঠাক করতে হবে। তার জন্য রাগ করতে হলে করব, ঠাট্টা করতে হলেও করব।
আপনার সব ছবিতেই রাজনৈতিক গন্ধ থাকে। রাজনীতির বাইরে গিয়ে কি কখনও ছবি করার কথা ভেবেছেন?
অনীক দত্ত : না, রাজনীতির বাইরে কি কিছু রয়েছে? (পাল্টা প্রশ্ন) 'আশ্চর্য প্রদীপ'এ একটি লোক আর তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে গল্প বলেছি। তবে তার মধ্যেও রাজনীতি আসতে বাধ্য। আমি যদি Love Story করি, তাতেও সেই সময়ের রাজনীতি তো আসবেই। আজকাল লোকে ভয় পেয়ে অনেক কিছু দেখায় না। সেটা আলাদা । এই যে দিল্লিতে ঘটনা ঘটছে। এখন যদি কোনও ছবি করি তাতে সেটা উঠে আসতে বাধ্য। রাজনীতির বাইরে গিয়ে কিছুই হয় না।
এই যে বর্তমান পরিস্থিতি চলছে, দিল্লির জ্বলছে। তা নিয়ে কী মত?
অনীক দত্ত : দেখুন, এই নিয়ে দু লাইনে তো কিছু বলা যায় না। বললে অনেক কিছু বলতে হয়। এটার জন্য আলাদা একটা Interview হয়ে যায়। যদিও এই বিষয়ে অনেক মিছিল, সভায় আমি থেকেছি। শুধু একটা কথা বলব, ধর্ম নিয়ে রাজনীতির আমি ঘোর বিরোধী। বরাবরই শাসকরা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে এসেছে। আমার মনে হয়, কোনও দেশ খালি ধর্মনিরপেক্ষ নয়, ধর্মহীন হওয়া উচিত। আর এরমধ্যে সরকারের ঢোকাই উচিত নয়। এটাই আমার মত। একটা দল সংখ্যালঘুকে তোষণ করছে, অন্যজন সংখ্যাগুরুদের উস্কাচ্ছে, সেটার কোনওটাই ঠিক নয়।
সেই ক্রুসেডের সময় থেকে যত মারামারি, হানাহানি তার ৯৫ শতাংশ ধর্ম নিয়ে। এছাড়া আর বড় কোনও কারণ নেই। সে বসনিয়া হোক, গাজা স্ট্রিপ হোক, কিংবা ভারত-পাকিস্তান। ভলতেয়ার সাহেব বলেছিলেন, ''Religion was born, when the first scoundrel met the first fool'। scoundrelরা আমাদের মত গাধাদের ব্যবহার করে যা ইচ্ছা তাই করছে, আর সেটা খুব সফল ভাবেই হচ্ছে।
কখনও রাজনীতিতে এসে সরাসরি লড়াই করতে চাইবেন?
অনীক দত্ত : না না, আমি কখনওই সেটা চাই না। আমি কখনও সক্রিয় রাজনীতি করিনি, করতে চাই না। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়তাম সেখানে ছাত্র রাজনীতি ছিল না। তবে সাম্প্রতীক অতীতে এমন কিছু ঘটেছিল। যা নিয়ে আমার মধ্যে রাগ ঘনীভূত হয়েছিল। আমার রাজ্য ও আমার শহরের যে ক্ষতিটা রাজনীতির জন্য হয়েছে, আমি সেটা মেনে নিতে পারি নি।
প্রসঙ্গত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত বরুণবাবুর বন্ধু ছবিটি ট্রেলার মুক্তির সঙ্গে সঙ্গেই অনীক দত্তের এই ছবি ঘিরে সিনেমাপ্রেমীদের উৎসাহ বেড়েছে। কে এই 'বরুণবাবুর বন্ধু' তা নিয়ে কৌতুহলের শেষ নেই। তবে এই বন্ধুটি কে তা শুক্রবার ছবি মুক্তি পেলেই জানা যাবে।