শুধু কৌতুকশিল্পী নন, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন সম্পূর্ণ অভিনেতা, লিখলেন Subhasish
''জিভ বের করে কীভাবে নাম বলতে হয় শিখিয়েছিলেন, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের''
শুভাশিস মুখোপাধ্যায় : কৌতুক অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয় দেখে আমি ছোট থেকে বড় হয়েছি। তবে সেটা মূলত সিনেমাতে। আরও পরে ওঁর থিয়েটার দেখেছি, তখন উনি পেশাদার থিয়েটার আর্টিস্ট। যেটাকে একসময় হাতিবাগানের থিয়েটার বলা হত। হাতিবাগান অঞ্চলে যে ব্যবসায়ীক মঞ্চগুলি ছিল, যেমন স্টার থিয়েটার, রংমহল, বিশ্বরূপা, মিনার্ভা...। এইসব জায়গায় তখন বৃহস্পতি, শনি, রবিবার করে নাটক চলত, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় সেখানে অভিনয় করতেন। সেখানেই তাঁকে আমার মঞ্চে অভিনয় করতে দেখা। বিশেষ করে একসময় তাঁর একটি নাটক খুব জনপ্রিয় হয়েছিল 'জয় মাকালী বলি'। তুমুল ঝড় তুলেছিল সেই নাটক। তাতে উনি অনবদ্য। তখনও তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় হয়নি। তারপর কোনও একটা সময় 'গন্ধর্ব' নাট্যগোষ্ঠীর কর্ণধার দেবকুমার ভট্টাচার্যের মাধ্যমে ভানুদার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। দেবুদা আমাকে সেসময় বাংলা ছবির বিখ্যাত একজন অভিনেতা উজ্জ্বল সেনগুপ্তের (যিনি উৎপল দত্তের 'ঝড়' ছবির নায়ক ছিলেন) সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন, সঙ্গে শ্রাবন্তী মজুমদারের স্টুডিওতে অভিনয়ের জন্য দেবুদা ওঁর সঙ্গেও আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। তখন উজ্জ্বলদা রঙ্গনাথ-এ 'জয় মাকালী বলি'তে অভিনয় করছেন। সেখানেই প্রথম আমার ভানুদার সঙ্গে পরিচয়, উজ্জ্বলদাই আলাপ করিয়ে দেন। তারপর আর ভানুদার সঙ্গে আমার আর সেভাবে দেখা হয়নি।
আরও পড়ুন-''অনেক সুখ স্মৃতি, আর দেখা হবে না, এই বোধটা ভীষণ কষ্ট দিচ্ছে'', লিখলেন ঊর্মিমালা বসু
পরে হঠাৎ একদিন, শ্রাবন্তীদির স্টুডিওতে ভানুদার সঙ্গে আবারও দেখা। উনি এসেছেন ধুতি, বাংলা শার্ট পরা সেই চেহারা। উনি এসে বললেন, ''শ্রাবন্তী আছে? '' আমি বললাম রেকর্ডিং চলছে। শ্রাবন্তীদি দেখতে পেয়ে ওনাকে ভিতরে ডাকলেন। এরপর শ্রাবন্তীদি বললেন, ভানুদা বলছেন তোদের অভিনয় দেখবে। আমি তো ঘাবড়ে গেলাম। তখন আমার সবে শুরু। যাইহোক কী আর করা যাবে! একটা কমেডি নাটক চলছিল। সেখানে একটা দৃশ্য ছিল যেখানে আমি ডাক্তারের কাছে গিয়ে বলছি পেটের সমস্যা হয়েছে। ডাক্তার আমায় নাম জিজ্ঞাসা করলেন। চোখটা ধরে টানলেন। পেটটা টিপলেন, আমিও লেগেছে এমনটা দেখালাম। তারপর জিভটা দেখতে চাইলেন, ডাক্তার বললেন জিভের অবস্থা খুব খারাপ। এরপর বললেন নাম কী? আমি জিভটা ঢুকিয়ে নিয়ে নামটা বললাম। তখন হঠাৎ দেখি শ্রাবন্তীদি বলছেন, এই কাট কাট...। বললেন, ভানুদা কী বলছেন দেখ। ভানুদা তখন আমায় বললেন, 'ডাক্তর তোমায় কী জিগাইল?' আমি বললাম, ডাক্তার আমার চোখটা টেনে দেখলেন, পেটটা টিপলেন। তখন উনি বললেন, 'তুমি কী করলা?' বললাম, আমি একটা আওয়াজ করলাম। তারপর আমার নাম জিভ দেখাতে বলল, আমার নাম জিজ্ঞাসা করলেন। উনি ফের প্রশ্ন করেন, 'তুমি কীভাবে নাম কইলা?' আমি ফের বললাম, যেমন নাম বলি সেভাবে। তখন বললেন, 'নাহ, তুমি নামটা জিভ বার কইরাই কহো। ডাক্তার তোমারে জিভ বার করতে কইছে, ঢুকাইতে তো কহে নাই'। বলে উনি দেখিয়ে দিলেন, কীভাবে জিভ বের করে নাম বলব। সেটা অসাধারণ ভঙ্গিমা। অডিওতে সেটা করার কথা ভাবাই যায় না। আমি তো হাসছি, আর মনে মনে ভাবছি, এটা কী শিখছি! আমি তাঁর কাছাকাছি তো পৌঁছতে পারলাম না, তবুও আমার মতো করে করলাম। তখন ভাবলাম, উনি আমাকে ওটা নাই-ই শেখাতে পারতেন, আমি তো তখন নতুন। কত বড় মাপের মানুষ! এটা আমার কাছে একটা বিরাট পাওয়া, আশীর্বাদ। ভানুদাকে এভাবেই পেয়েছি।
তবে ভানুদাকে আমরা মূলত কমেডি অভিনেতা হিসাবেই জানি, তবে উনি সিরিয়াস চরিত্রও অসাধারণ। তাঁর 'অমৃত কুম্ভের সন্ধান' দেখলে সেটা বেশ বোঝা যায়। উনি খুববেশি সিরিয়াস চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পাননি, তবে যখন পেয়েছেন বুঝিয়ে দিয়েছেন কত বড়মাপের অভিনেতা উনি। কমেডিতে বাঙাল ভাষার মতো কথ্য ভাষাকে জনপ্রিয় করে দিয়ে গিয়েছেন। এই ভাষাকে পর্দাতে গেঁথে দিয়ে গিয়েছেন। পরে অনেকেই এই ভাষা ব্যবহারের সময় দেখেছি ভানুদার স্টাইল নিয়ে ফেলেন। তবে ভানুদার সংলাপ বলার ধরন, টাইমিং, আর ভানুদার হাতটা যেহেতু বড় ছিল, উনি হাতটা নানানভাবে ব্যবহার করতেন। আমরা উত্তম কুমারের ঘাড় ঘোরানোর কথা বলি, কিন্তু ভানুদাও অদ্ভতভাবে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেন। সেটা হাস্যরসের সৃষ্টি করত। আমি ভানুদাকে একজন সম্পূর্ণ অভিনেতা বলব। উনি শুধু কমেডিয়ান নন, সঙ্গে বড় মনের মানুষ। আজ ওঁর জন্মদিনে আমার শ্রদ্ধা রইল। উনি আজ থাকলে আরও অনেক কিছু পেতে পারতাম। শিখতে পারতাম, তবে সে সুযোগ আর হবে না।''